শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫


মা সারদা।

শ্রীমায়ের ভক্ত সরযূদেবী একদিন বিকেলে শ্রীমার ঘরে এসে বসেছেন, এমন সময় গোলাপমা এসে বললেন, একটি সন্ন্যাসিনী তাঁর গুরুর দেনা শোধ করার জন্য প্রার্থী হয়ে কাশী থেকে এসেছেন। ‘তোমাকে কিছু দিতে হবে’। শ্রীমা তখন হেসে বললেন, ‘আমাকে ধরেছিল। আমি কি কারও কাছে টাকা চাইতে পারি মা? বললুম, থাকো, হয়ে যাবে’। গোলাপমা বললেন, ‘হ্যাঁ, মা আমার শেষে হিল্লে করে দিয়েছেন’। শ্রীমা চুপি চুপি ভক্তকে বলেছেন যে, গোলাপমা তিনখানা গিনি দিয়েছে। কিছু পরে সেই সন্ন্যাসিনী ঘরে এলেন। তিনি প্রথমে বলরামবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানকার ভক্তরা তাঁকে যার যা সাধ্য দিয়েছেন। সন্ন্যাসিনীর পূর্বাশ্রমে বড় সংসার ছিল। তাঁর সাত ছেলে সকলেই কৃতী হয়ে সব বিষয়ের ভার নিলে তিনি সংসার ত্যাগ করেন।
সন্ন্যাসিনী তাঁর গুরুর দেনা নিয়ে শ্রীমাকে বলেন যে, বলা হয়, গুরুনিন্দা করতে নেই। তারপর মা সারদাকে প্রণাম করে বলেন, ‘তিনি বড় মকদ্দমাপ্রিয় ছিলেন। এখন বয়স হয়ে গেছে, আর পারেন না। ওদিকে পাওনাদার ডিক্রী পেয়ে ধরতে চায়। কি করি, তাই জন্যে ভিক্ষায় বেরিয়েছি’। একথা শুনে শ্রীমা একটি শ্লোক বলেন, যার ভাব হল, “উচিত কথা গুরুকেও বলা যায়, তাতে পাপ হয় না”। তিনি বললেন, ‘তবে গুরুভক্তি থাকা চাই। গুরু যেমনই হোক, তাঁর প্রতি ভক্তিতেই মুক্তি। ঠাকুরের শিষ্যভক্তদের কি ভক্তি দেখ দেখি! এই গুরুভক্তির জন্যে ওরা গুরুবংশের সকলকে ভক্তি তো করেই, গুরু দেশে, বিড়ালটাকে পর্যন্ত মান্য করে’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারা, পর্ব-৮২: মা সারদার ভক্ত যোগেন মায়ের কথা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল

সন্ন্যাসিনী রাত তিনটে থেকে বেলা আটটা অবধি ধ্যান, জপ করেন। তাই তিনি ধোয়া কাপড় চাইলেন। শ্রীমা তাঁকে ভাইপো ভূদেবের একটি কাপড় দিতে বললেন। সন্ন্যাসিনী সরযূদেবীকে জিজ্ঞাসা করেন যে, সে রাতে থাকবে কিনা, তাহলে তিনি তাকে কিছু উপদেশ দেবেন। ভক্তটি মনে মনে ভাবলেন যে, তাঁদের মা থাকতে আবার তিনি কি শেখাবেন। প্রকাশ্য বললেন, ‘না, আমার থাকা হবে না। আমার গাড়ি এসেছে’।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

সন্ধ্যারতির পর সে শ্রীমাকে প্রণাম করে বিদায় নিল। আর একদিন অনেকেই শ্রীমাকে প্রণাম করে চলে গেল। যোগীনমা এসে শ্রীমাকে প্রণাম করে ঠাকুরের সন্ধ্যারতি করতে বসল। শ্রীমা রাস্তার ধারের বারান্দায় বসে জপ করতে লাগলেন। পরে তিনি উঠে এলে সকল ভক্তেরা তাঁকে প্রণাম করে চলে গেল। তখন শ্রীমাকে একা পেয়ে সরযূদেবী জানতে চেয়েছিলেন যে, মহিলারা শারীরিক অশুচি অবস্থায় ঠাকুরের পুজো করতে পারে কিনা। শুনে শ্রীমা বললেন, ‘ হ্যাঁ মা, চলে। যদি ঠাকুরের উপর টান থাকে’। এই কথা সে ঠাকুরকেও একবার জিজ্ঞাসা করে। তখন ঠাকুর বলেছিলেন, ‘যদি পুজো না করার জন্য তোমার মনে খুব কষ্ট হয় তাহলে করবে, তাতে দোষ নেই। নয়তো কোরো না, মনে দ্বিধা এলে কোরো না’। সকলকেই যে মা সারদা এমন করতে বলতেন, তা নয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’

মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

কয়েকদিন পর আর এক মহিলা ভক্তকে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘এই অবস্থায় ঠাকুর, দেবতার কাজ কি করতে আছে? তা কোরো না’। লোকের মানসিক স্তর দেখে কাকে কখন কি বলতেন তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ ছিল না। অনেক রাত হয়ে গেলে যখন কেউ শ্রীমায়ের ভক্তটিকে নিতে এলো না, তখন সে মা সারদাকে বলে যে, না এলে এখানে থাকাই যাবে। শ্রীমা বললেন, ‘সে তো কোন ভাবনা নেই, তবে আজ পয়লা, অগস্ত্যযাত্রা। আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কোথাও থাকতে নেই’। ভক্তটি ভাবল যে, যদি অগস্ত্যযাত্রা হয়, সে তো ভালই। রাতে ঠাকুরের ভোগের পর সকলে প্রসাদ খেতে বসলেন। ভক্তটিকে বিকেলেই মা সারদা অনেক প্রসাদ দেওয়ায় সে আর খেতে চাইল না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর

গোলাপমা তাকে বললেন, ‘কেন গো, আমাদের বাড়ি এসে উপোস করে থাকবে কেন?’ শ্রীমা বললেন, ‘না না, দুখানি খাবে বৈকি’। এই বলে নিজে একটি রেকাবিতে চারটে লুচি, তরকারি, মিষ্টি এনে দিলেন। রাত প্রায় এগারোটার পর গৌরীমায়ের আশ্রমে ভক্তটিকে না দেখে শ্রীযুক্ত বিনোদ তাকে নিতে আসে। তখন ব্রহ্মচারি,সাধুরা সবাই শুয়ে পড়েছেন। মা সারদাকে প্রণাম করে বিদায় নিতে তিনি বললেন, ‘থাকা হলো না গো, তা আর একদিন এসে থেকো’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content