শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

বনবাসী রামের সন্ধানে ভরতের যাত্রাপ্রস্তুতি সম্পূর্ণ হল। ভোরবেলায় শয্যা ত্যাগ করেই ভরত, উত্তম রথে আরোহণ করে, রামের দর্শনলাভের ইচ্ছায় যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সম্মুখবর্তী অশ্বযুক্ত সূর্যতুল্য রথে, চললেন মন্ত্রী ও পুরোহিতগণ। নয় সহস্র সুসজ্জিত হাতি ইক্ষ্বাকুকুলনন্দন ভরতের অনুগমন করল। ষাট সহস্র রথে,ধনুক ও নানা অস্ত্রধারী যোদ্ধারা যশস্বী সত্যসন্ধ ভরতের সহযাত্রী হলেন। শত সহস্র অশ্বারোহী সেনা, সত্যপ্রতিজ্ঞ জিতেন্দ্রিয় ভরতকে অনুসরণ করলেন। রামের আগমনবার্তায় হর্ষোৎফুল্লা কৈকেয়ী, সুমিত্রা ও কৌশল্যা আলোকোজ্জ্বল রথে যাত্রা করলেন। আর্য জনতা লক্ষ্মণ-সহ রামকে দেখতে চললেন। তাঁরা রামের সম্বন্ধে বিচিত্র আলাপচারিতায় রত হলেন। আমরা সেই মেঘশ্যাম, মহাবীর, স্থিরচিত্ত, দৃঢ়সংকল্প,পৃথিবীর শোকনাশক, রামের দর্শন লাভ করব? মেঘশ্যামং মহাবাহুং স্থিরসত্ত্বং দৃঢ়ব্রতম্। কদা দ্রক্ষ্যামহে রামং জগতঃ শোকনাশকম্।। জনতার মুখে এক কথা, শোকনাশক রামের দর্শনলাভের ফলে, অন্ধকাবিনাশকারী সূর্যের মতো তাঁদের দৃষ্টিপথের অন্ধকার অপসারিত হবে। হৃষ্টচিত্ত নাগরিকগণ, প্রীতিভরে এমন বিবিধ শুভ আলোচনারত অবস্থায় পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে রওনা দিলেন।
রাজ্যের আরও যত বণিকগণ, প্রজাবৃন্দ, রাজার প্রিয় ব্যক্তিত্বরা, আনন্দিতমনে রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এ ছাড়াও মণিকার, সুনিপুণ কুম্ভকার, সূত্রধর (ছুতার), শস্ত্রজীবী, ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে নানাদ্রব্যনির্মাতা, করাতী (কাষ্ঠছেদক), মুক্তা প্রভৃতি রত্নাদির বেধক, কৃত্রিম অলঙ্কার প্রস্তুতকারী, দন্তকার (হাতির দাঁতের দ্রব্যনির্মাণকারী), সুধাকার, গন্ধদ্রব্যপ্রস্তুতকারী, বিখ্যাত স্বর্ণকার, কম্বলপ্রস্তুতকারী কারিগর, স্নানের জন্য উষ্ণজল সরবরাহকারী স্নাপক, চিকিৎসক, ধূপ ব্যবসায়ী, শৌণ্ডিক (মদ্যপ্রস্তুতকারী), রজক, সীবনকাজে নিযুক্ত(দর্জি), কৈবর্ত(মৎস্যজীবী), গ্রাম ও পল্লীর প্রধান, সস্ত্রীক নটগণ, সর্বজনস্বীকৃত স্থিতধী বেদবিৎ ব্রাহ্মণগণ, এমন সহস্র সহস্র মানুষ, গোবাহিত রথে ভরতের অনুগমন করলেন। সুবেশা, শুদ্ধবসনপরিহিত ও তাম্রবর্ণের অনুলেপন লিপ্ত, তাঁরা সকলে, নির্মল যানে আরোহণ করে, ধীরে ধীরে ভরতের অনুগামী হলেন। ভ্রাতৃবৎসল ভরত প্রিয় ভ্রাতাকে আনতে চলেছেন, তাই সহযাত্রী সেনারা সন্তুষ্ট ও হৃষ্ট। চতুরঙ্গসেনারা রথ, বাহন,অশ্ব ও হস্তী প্রভৃতিতে আরোহণ করে, শৃঙ্গবেরপুরে গঙ্গার নিকটে উপস্থিত হলেন। সেখানে রামসখা বীর গুহ, জ্ঞাতি পরিবৃত হয়ে সেই দেশ, সতর্কতার সঙ্গে পরিপালন করছিলেন।ভরতের অনুগামী সেই সৈন্যদল চক্রবাকশোভিত গঙ্গাতীরে যাত্রা শেষ করল। বিশ্রামরত সেনা ও পুণ্যতোয়া গঙ্গা নিরীক্ষণ করে বাক্যবিদ ভরত, অমাত্যদের বললেন, যদৃচ্ছাক্রমে চতুর্দিকে সৈন্যদের বিন্যস্ত করা হোক। তাঁরা এখানে বিশ্রাম লাভ করুক। আগামীকাল সমুদ্রগামিনী গঙ্গা উত্তরণ করা যাবে। ভরত, গঙ্গাজলে অবতরণ করে পিতার পারলৌকিক তর্পণ ক্রিয়া সম্পন্ন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। অমাত্যরা নিজেদের ইচ্ছানুরূপ পৃথক পৃথক সেনাসন্নিবেশ করলেন। ভরত গঙ্গাতীরে সুসজ্জিত সেনা সন্নিবেশ করালেন। রামের প্রত্যাবর্তনবিষয়ে চিন্তা করতে করতে সেখানে সেদিন অবস্থান করলেন ভরত।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

গঙ্গাতীরে চতুর্দিকে সৈন্য সমাবেশ দেখে নিষাদাধিপতি জ্ঞাতিবর্গকে বললেন, দৃশ্যমান এই সাগরপ্রতিম বিশাল সেনাবাহিনী, এর অন্ত কোথায়? তিনি বুঝতে অক্ষম। ওই কোবিদারপতাকাযুক্ত রথে দুষ্টমতি ভরত স্বয়ং এসেছেন। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের পাশবদ্ধ করবেন বা হত্যা করবেন। বদ্ধয়িষ্যতি পাশৈরথ বাস্মান্ বধিষ্যতি। পিতা রাজা দশরথ,পুত্র রামকে নির্বাসিত করেছেন। কৈকেয়ীপুত্র ভরত সহজলভ্য নয় এমন রাজ্যলক্ষ্মীলাভের লালসায় রামকে বধ করতে আসছেন। দাশরথি রাম, একাধারে আমার বন্ধু ও প্রতিপালক। তাঁর স্বার্থসিদ্ধির কারণে গঙ্গাতীরে সশস্ত্র হয়ে অবস্থান কর। নিষাদরাজ নির্দেশ দিলেন, ভর্তা চৈব সখা চৈব রামো দাশরথির্মম। তস্যার্থকামাঃ সন্নদ্ধা গঙ্গানূপেঽত্র তিষ্ঠত।।

মাংস ও ফলমূলভোজী বলশালী, নদীরক্ষায় নিযুক্ত, দাসেরা যেন গঙ্গা আশ্রয় করে অবস্থান করে। গুহ রাজা ঘোষণা করলেন, পাঁচশত নৌকায়, শত শত কৈবর্ত যুবক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বিরাজ করুক। যদি মনে হয়, ভরত রামের প্রতি সন্তুষ্ট, তবেই এই সেনাবাহিনী নিরাপদে গঙ্গা অতিক্রম করতে পারবে। এমন নির্দেশ দিয়ে, নিষাদরাজ গুহ মৎস্য, মাংস প্রভৃতি উপহার নিয়ে ভরতের নিকটে গেলেন। তাঁকে আসতে দেখে, শৌর্যবান সূতপুত্র সুমন্ত্র, যথাসময়ে ভরতকে সবিনয়ে অবহিত করলেন, সহস্র জ্ঞাতি পরিবৃত, নিষাদাধিপতির সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। তস্মাৎ পশ্যতু কাকুস্থ ত্বাং নিষাদাধিপো গুহঃ। অসংশয়ং বিজানীতে যত্র তৌ রামলক্ষ্মণৌ।। রাম লক্ষ্মণ যেথায় আছেন, তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন। সুমন্ত্রর সুপরামর্শানুসারে, ভরত, আদেশ দিলেন, শীঘ্রং গুহঃ পশ্যতু মামিতি। শীঘ্র গুহ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। ভরতের সম্মতি লাভ করে, আনন্দিত জ্ঞাতিপরিবৃত গুহ, সবিনয়ে ভরতকে বললেন, এই স্থানটি মনোরম আনন্দপূর্ণ, আমরা আপনার প্রজা, আমাদের নিবেদন—এই দাসের গৃহে বাস করুন। নিবেদয়াম তে সর্বং স্বকে দাসগৃহে বস।

নিষাদদের অর্জিত ফলমূল, আর্দ্র ও শুষ্ক মাংস, অতি উত্তম সব বনজ ও অন্যান্য দ্রব্য আছে।নিষাদপতি আশা করেন, এই সব গ্রহণ করে, সৈন্যদল এখানে রাত্রিবাস করতেই পারেন। বিবিধ ভোগ্যদ্রব্যে আপ্যায়িত হয়ে তাঁরা আগামীকাল সসৈন্যে এখান হতে প্রস্থান করবেন। আশংসে স্বাশিতা সেনা বৎস্যতীতি বিভাবরীম্। অর্চ্চিতো বিবিধৈ কাম্যৈঃ শ্বঃ সসৈন্যো গমিষ্যসি।।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ

নিষাদপতি গুহর এমন প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে, মহাজ্ঞানী ভরত, যুক্তিপূর্ণ ও যথার্থ কথা বললেন। নিষাদরাজ স্বয়ং ভরতের গুরুর সখা। তিনি উদার, তাই ভরতের সেনাদলের আপ্যায়নের এই প্রকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এই কথা বলে মহাতেজস্বী শ্রীমান ভরত, নিষাদরাজকে পথপ্রদর্শনের অনুরোধ জানালেন। গঙ্গাতীরবর্তী এই স্থানটি নিতান্ত গহন ও দুরতিক্রম্য, কোন পথ ধরে মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে যাব? কতরেণ গমিষ্যামি ভরদ্বাজাশ্রমং পথা। গহনোঽয়ং ভৃশং দেশো গঙ্গানূপো দুরত্যয়ঃ।।

বুদ্ধিমান রাজতনয় ভরতের এই অনুরোধ শুনে, হাত জোড় করে, গভীর অরণ্যচারী গুহ, তাঁকে আশ্বস্ত করলেন,এই স্থানটি সম্বন্ধে অভিজ্ঞ, একাগ্রচিত্ত দাসগণ, মহাবীর রাজপুত্রের অনুগমন করবেন, ভরতের অনুগামী হবেন স্বয়ং নিষাদপতিও। শুধু এক গভীর আশঙ্কা, যাঁর কোনও কাজ কষ্টকর নয় এমন রামের প্রতি কোন দুষ্ট অভিপ্রায় নিয়ে ভরত যাচ্ছেন না তো?ভরতের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিষাদরাজকে আশঙ্কিত করে তুলেছে।আকাশের মতো নির্মল স্বচ্ছহৃদয় ভরত কোমলবাক্যে গুহের শঙ্কা দূর করলেন। আমাকে অবিশ্বাস করা উচিৎ নয়। এমন দুঃসময় যেন না আসে যখন আমি কষ্টকর কোন আশঙ্কার কারণ হই। মা ভূৎ স কালো যৎ কষ্টং ন মাং শঙ্কিতুমর্হসি।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়

আরও বিশদে বললেন ভরত—জ্যেষ্ঠ রাঘব রাম, ভরতের পিতৃতুল্য,অরণ্যবাসী সেই রামকে ফিরিয়ে আনতে চলেছেন ভরত। *বুদ্ধিরন্যা ন মে কার্য্যা গুহ সত্যং ব্রবীমি তে।* ভরত তাঁর বক্তব্য, দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করে বললেন,সত্য বলছি এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য আমার নেই।ভরতের উত্তর শুনে, প্রসন্নমুখে আনন্দিত গুহ রাজা, ভরতকে অভিনন্দিত করলেন—এই জগতে আপনার তুল্য কাউকে দেখি না, এই অনায়াসে লব্ধ রাজ্যপরিত্যাগে আপনার এই অভিলাষ, আপনি ধন্য, ধন্যস্ত্বং ন ত্বয়া তুল্যং পশ্যামি জগতীতলে। অযত্নাদাগতং রাজ্যং যস্ত্বং ত্যক্তুমিহেচ্ছসি।। রামকে কষ্টকর জীবন থেকে ফিরিয়ে আনতে আপনার এই অভিপ্রায়, যার ফলে আপনার কীর্তি এই পৃথিবীতে লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হবে। শাশ্বতী খলু তে কীর্ত্তির্লোকাননুচরিষ্যতি। যস্ত্বং কৃচ্ছ্রগতং রামং প্রত্যানয়িতুমিচ্ছতি।।

গুহের বক্তব্য চলাকালীন সূর্যের কিরণ স্তিমিত হয়ে, রাত্রি উপস্থিত হল। গুহের আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট ভরত, সেনাবাহিনী সন্নিবেশিত করে, শত্রুঘ্নের সঙ্গে শয্যার আশ্রয় নিলেন। ভরতের চিন্তার শেষ নেই। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য লক্ষ্যপূরণ এবং এমন শোকের যোগ্য তিনি নন। রামের চিন্তায় শোকমগ্ন হলেন মহান ভরত। বনদহনের সময়ে অভ্যন্তরে অগ্নি প্রচ্ছন্ন থেকে তরু যেমন সন্তপ্ত হয়,তেমনই অন্তরের দহনজ্বালায় দগ্ধ হতে লাগলেন ভরত। তাঁর সারা শরীর থেকে ঘাম ঝরে পড়তে লাগল যেন সূর্যের তাপে গলিত হিম।

কৈকেয়ীপুত্র ভরতের দুঃখভার পাথরে আবৃত এক পর্বতসমান। তাঁর দীর্ঘশ্বাস যেন পর্বতের দ্রবীভূত ধাতু,দৈন্যভাব যেন সেই পর্বতের সারিবদ্ধ ঘন বৃক্ষরাজি,শোক ও শ্রান্তি যেন শিখরসমূহ, পার্বত্য অগণিত প্রাণীরা যেন প্রকৃষ্ট মোহপাশ, ভরতের কষ্ট ও বেদনা সেই দুঃখশৈলের ওষধি ও বেণু,এমন নিমজ্জনকারী পর্বতপ্রমাণ দুঃখে আক্রান্ত হলেন ভরত। ভীষণ দুঃখাহত ভরত, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিপন্ন অবস্থায় উপনীত হলেন। যেন জ্বরাক্রান্ত মনে,দলছুট বৃষের মতো তিনি শান্তি হারালেন। এরপরে মহানুভব ভরত, তাঁর অনুচরগণসহ,সমাহিত মনে, গুহর সঙ্গে মিলিত হলেন। গুহ ব্যথিতচিত্তে, তাঁকে, ধীরে ধীরে জ্যেষ্ঠ রামের সম্বন্ধে আশ্বস্ত করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক

পিতার শ্রাদ্ধাদি যথানিয়মে সম্পন্ন করেছেন ভরত। নেতৃত্বহীন রাজ্যে ভরতকে অভিষিক্ত করে সুস্থিতি বজায় রাখতে উদ্যোগী হয়েছেন রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ। দশরথপুত্র ভরত, জ্যেষ্ঠ রামের রাজসিংহাসনে অগ্রাধিকারে বিশ্বাসী। বিশ্বাসকে বাস্তবায়িত করতে ভরতের যত উদ্যোগে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন, স্বজন, অমাত্য বর্গ, আপামর প্রজাবৃন্দ। ভরত, রামচন্দ্রকে বনবাস থেকে ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়সংকল্প। তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন মায়েরা, মন্ত্রী, পুরোহিত, সেনাবাহিনী ও আর্য জনতা। একটি শুভ আয়োজন, তাঁর শরিক হতে কে না আগ্রহী? বিভিন্ন পেশার,বিভিন্ন জীবিকার মানুষ চলেছেন যাঁর প্রাপ্য তাঁকে সেটি ফিরিয়ে দিতে।

একই পথ, যে পথে একদা অরণ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন রাম। তখনও তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন আপামর প্রজাবৃন্দ। সে যাত্রা ছিল বেদনাবিধুর, বঞ্চিতের শোকে হাহাকার করে উঠেছিলেন সাধারণ মানুষ। জনতার মনের ধূমায়িত প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছিল চোখের জলে, দীর্ঘনিঃশ্বাসের হাহাকারময় অভিব্যক্তিতে। এ বার ভরতের সঙ্গে চলেছেন জনতা পরম আগ্রহে প্রাপককে তাঁর যোগ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে তাঁরা আনন্দে আলিঙ্গনাবদ্ধ, সুসজ্জিত, প্রসাধনের অনুলেপনে লিপ্ত তাঁদের বেশবাশ। এ যেন গণজাগরণ। প্রেক্ষাপট রাজতন্ত্র, অথচ জনতার সার্বিকসমর্থনে শাসনতন্ত্রের অধিকার ফিরিয়ে দিচ্ছেন আরও একজন জনপ্রতিনিধি, যিনি নিজে একজন উত্তরাধিকারী। প্রাপক, জ্যেষ্ঠ রামের,শাসকরূপে এই স্বীকৃতি, নিঃসংশয়ে আধুনিক শাসকবর্গের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় জনমতের গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।

ছবি: প্রতীকী।

রামের ছায়াসঙ্গী যদিও লক্ষ্মণ, ভরত যেন তাঁর ধার্মিক সত্তার প্রতিরূপ। বিশাল সৈন্যবাহিনীসহ ভরত, রামের শুভাকাঙ্খী নিষাদরাজ গুহকে আতঙ্কিত করে তুলেছেন। ভরতের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দিহান হয়েছেন গুহ। এখানেও সেই ভাগ্যবিড়ম্বিত ভরত, যাঁকে সন্দেহের তীরবিদ্ধ হতে হয়েছে বার বার। স্বচ্ছ সুন্দর রাজনীতির কূটচক্রান্তের আবিলতা যাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। মা কৈকেয়ীর দুর্নাম যাঁকে কালিমালিপ্ত করেছে, অখ্যাতির বোঝা ভরতকে শ্রান্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত করেছে। তিনি কিন্তু এই সব ঝড়ঝাপটা, অখ্যাতি সব কিছু কাটিয়ে নিজের অকলুষ চরিত্রমাধুর্যে সকলের বিশ্বাস অর্জন করেছেন, তাঁর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর বক্তব্যের দৃঢ়তায় বিমুগ্ধ নিষাদরাজ গুহ, তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।শেষপর্যন্ত তিনি নিজে ভরতকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন, এই মর্মে আশ্বস্ত করেছেন। ভরত প্রমাণ করেছেন, মন ও চিন্তার স্বচ্ছতার মাধ্যমে হয়তো অন্যের আস্থা অর্জন সম্ভব হয় কখনও।

স্বীকৃত উত্তরাধিকারী ভরত ভ্রাতৃবৎসল, তিনি রামের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছুক শুধু হৃদয়াবেগের টানেই নয়, তাঁর মনে, জননী কৈকেয়ীর দুষ্কর্মজনিত অন্তর্দহনজ্বালা নিরন্তর তাঁকে বিদ্ধ করেছে। নীতিপরায়ণ যে কোন পরম ধার্মিকের এমন জ্বালা থেকে নিস্তার নেই কোনওমতেই, যতক্ষণ না সেটির সংশোধন হচ্ছে ততক্ষণ এক চরম মর্মবেদনা তাঁকে বিদ্ধ করবেই। বিবেকবান ভরত তার ব্যতিক্রম নন।এমন ভরতদের শুধু যোগ্যতর ব্যক্তির জন্যে রাজপথ বিনির্মাণেই আনন্দ,অযাচিত সম্মানপ্রত্যাখ্যানেই তাঁদের আত্মতৃপ্তি, অনায়াসে লব্ধ জয়ের মালায় যোগ্যকে বরণ করে, তাঁদের যত আনন্দানুভব। ভরতের উত্তরসূরীদের রাজনৈতিক বোধ ও অনুভব কী এমন ভারতীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হতে পারে?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content