ছবি: প্রতীকী।
বোধিসত্ত্ব নানা জন্মে এই মাটির পৃথিবীতে জীবশরীরে আবির্ভূত হচ্ছেন। কখনও মানুষ, কখনও বা মনুষ্যেতর প্রাণী হয়ে নিজেকে শুদ্ধতর করেছেন। কখনও দেবতা হয়ে নেমে এসেছেন ধরণীর ধূলিতলে, কখনও শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে, কখনও নগরে-গ্রামে-পর্বতে জেগে উঠেছেন, কখনও সমাজশ্রেষ্ঠ, কখনও দীনহীন দুর্বল হয়েই পার্থিবজীবনের ক্লেদ থেকে আহরণ করেছেন হিরণ্যদ্যুতি, ঊষর মরু, ধূসর ধূলির বুকে কোন্ সংগোপন শান্তির বারিবর্ষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে ধীরে, মন্দমন্থর গতিতে।
সেবার হিমালয়ের কাছে নাগরাজ্যের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র হয়ে জন্মেছেন তিনি। তিনি মহাদর্দর, তাঁর ভাই খুল্লদর্দর। ভাইটি ছিল দুরাচারী। নাগকন্যাদের নিয়মিত অপমান, প্রহার, দুর্বাক্যবর্ষণ আর স্বেচ্ছাচার করে করে অতি দুর্ধর্ষ ও ভয়ংকর হয়ে উঠল।
সেবার হিমালয়ের কাছে নাগরাজ্যের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র হয়ে জন্মেছেন তিনি। তিনি মহাদর্দর, তাঁর ভাই খুল্লদর্দর। ভাইটি ছিল দুরাচারী। নাগকন্যাদের নিয়মিত অপমান, প্রহার, দুর্বাক্যবর্ষণ আর স্বেচ্ছাচার করে করে অতি দুর্ধর্ষ ও ভয়ংকর হয়ে উঠল।
রাজা যথাসময়ে সংবাদ পেলেন। রুষ্ট হয়ে তিনি কনিষ্ঠটিকে রাজ্য থেকে দূর করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু মহাদর্দর ভাইয়ের হয়ে তদ্বির করল। পিতাকে অনুরোধ করলেন, তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার আবেদন জানালেন, প্রতিরুদ্ধ করলেন নির্বাসন। কিন্তু খুল্লদর্দর যথাপূর্ব অপ্রতিরোধ্য, অপরিবর্তিত। রাজা আবারও ক্রুদ্ধ হলেন, আবারও জ্যেষ্ঠপুত্র তাঁকে নিবৃত্ত করলেন, এবং আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। তখন আবারও জ্যেষ্ঠপুত্র মহাদর্দর ভাইয়ের হয়ে আবেদন জানালে পিতৃসত্তা নিমেষে রাজা হয়ে রাজধর্ম পালন করল। দুজনকেই রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে বারাণসীর কোনও এক মলপূর্ণ ক্লেদাক্ত জলভূমিতে নির্বাসিত করলেন।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে
বড় ভাইটির স্বভাব দেখে তাকে সুকুমার রায়ের গঙ্গারামকে মনে পড়তে পারে, এমনকী স্বয়ং রামচন্দ্রকেও স্মরণ করাতে পারে এর কাহিনী, যে অক্লেশে নির্বাসনে চলে যেতে পারে নিতান্তই অকারণে। অথবা কারণ তো একটা ছিলোই, ন্যায়ধর্মের প্রশ্নে অন্ধ পক্ষপাত তার উদারচিত্ত অমলিন দার্ঢ্যে কি কলঙ্করেখার ছায়াপাত ঘটায়নি। তাই নির্বাসন তারও উত্তরণের পথ।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ
তারা সেই জলভূমিতে গ্রামবালকদের ঢিলের খোঁচা খেয়ে কোনওমতে টিকে রইল। জলের ধারে আহার্য খুঁজতে গেলে গ্রামের ছেলেরা তাদের ঢোঁড়া, পাঁকখেকো, ব্যাঙখেকো বলে গালি দেয়, টিটকিরি দেয়। খুল্লদর্দর আর মুখবুজে এসব সইতে পারে না। তার উদ্ধত ভীষণ চরিত্র তাকে মনে করায় যে সে নির্বিষ নয়। তার ইচ্ছা হয় অজ্ঞ গ্রামবালকদের বিষাক্ত ছোবলে, নিশ্বাসের বিষবাষ্পে বিপন্ন করার। দাদাকে সে মনের অভিপ্রায় জানায়।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়
মহাদর্দর উপদেশ দেয়, পরভূমে যারা পরবাসী, নিজভূমিতে যাদের আশ্রয় নেই, তাদের অশেষ দুর্বাক্য ও অপমান সহ্য করে বাঁচতে হয়। এটাই সত্য। যারা বুদ্ধিমান পণ্ডিত, জ্ঞানালোকে আলোকিত, তারা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকেন। অন্তরে বিপুল অপমানকে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হওয়ার জন্য এই বিস্তৃত ভাণ্ডার তাঁরা বহন করেন। যেখানে তুমি অজ্ঞাতকুলশীল, যেখানে তোমার জাতি, গোত্র, চরিত্রবল, বংশকৌলিন্য কিংবা ক্ষমতার কোনও ভূমিকা নেই, মূল্য নেই সেই প্রবাসে পণ্ডিত ধীমান ব্যক্তি নিজের অন্তরে সদাপ্রজ্বলিত অগ্নিসম বীর্যকে অতিযত্নে সাবধানে রক্ষা করবেন, এটিই প্রকৃত কর্তব্য। তর্জন সহ্য করে প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে এই কালক্ষেপ হীনবলের লক্ষণ নয়, দৃঢ়বলের পরিচয়-ই বহন করে।
আরও পড়ুন:
শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট
এইভাবে হতদর্প হয়ে তিনবছর অতিবাহিত করে পিতার আহ্বানে তারা আবার নাগরাজ্যে ফিরে গেল।
এই কাহিনীতে ধর্মের অপ্রতিহত ভূমিকাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধর্মের প্রয়োজনেই পিতৃসত্তা ত্যাগ করে রাজধর্মের পরিপালন করেন রাজা। অগ্রজের ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে কখনও ন্যায়রক্ষা হয় না। আবার প্রবাসজীবনে যথাকর্তব্যের নির্ধারণে কোনও স্খলন ঘটে না। রক্ষা পায় জীবন ও সম্মান।
জীবনে বহুকৌণিক ও আপাতবিরুদ্ধ বিবিধ ধর্মের নির্ণয় ও পালনেই আসে সার্থকতা। মহাদর্দর সেই কর্তব্যের পালনে চ্যুত হননি বলেই তাঁর সেই ক্ষুদ্র তুচ্ছ জীবন একদা মিশবে মহাসাগরে, মহাজীবনের ছন্দোময় মন্দমধুর মহাধ্বনির অমলিন ঝঙ্কারে সার্থক হবে একদিন।
এই কাহিনীতে ধর্মের অপ্রতিহত ভূমিকাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধর্মের প্রয়োজনেই পিতৃসত্তা ত্যাগ করে রাজধর্মের পরিপালন করেন রাজা। অগ্রজের ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে কখনও ন্যায়রক্ষা হয় না। আবার প্রবাসজীবনে যথাকর্তব্যের নির্ধারণে কোনও স্খলন ঘটে না। রক্ষা পায় জীবন ও সম্মান।
জীবনে বহুকৌণিক ও আপাতবিরুদ্ধ বিবিধ ধর্মের নির্ণয় ও পালনেই আসে সার্থকতা। মহাদর্দর সেই কর্তব্যের পালনে চ্যুত হননি বলেই তাঁর সেই ক্ষুদ্র তুচ্ছ জীবন একদা মিশবে মহাসাগরে, মহাজীবনের ছন্দোময় মন্দমধুর মহাধ্বনির অমলিন ঝঙ্কারে সার্থক হবে একদিন।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।