বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


মৃণালিনী দেবী।

মৃণালিনী দেবীর জীবনের সময় তো খুব বেশিদিন ছিল না, পরিচিতি বলতে প্রতিভাবান কবির স্ত্রী। জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্বামী সন্তান আর ঘরের দেখভাল করতে থাকা মৃণালিনীর গল্প সকলের জানা। আমি বরং আজ মৃণালিনীর চিঠির দেরাজ খুলে বসি আর অক্ষরের উপর অক্ষর সাজিয়ে এক নতুন মৃণালিনীকে খুঁজতে থাকি। যদি বলি, যে কয়টি চিঠি পড়তে পেরেছি, আর তাঁর প্রত্যুত্তরগুলি থেকে যেটুকু আভাস পেয়েছি আমার মনে হয়েছে একটু সুযোগ আর সময় পেলে মৃণালিনী দিব্যি রম্যরচনা লিখতে পারতেন। চমৎকার রসবোধ আর পরিমিত ভাষাজ্ঞান তাঁর গদ্যরচনার প্রাণকেন্দ্র। পরিজনেরা রীতিমত অপেক্ষা করতেন তাঁর চিঠির জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও! পরিজনদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা তাঁর চিঠির ভাষাকে আরো সহজ আরো সাবলীল করে তুলত। চিঠি পড়ে কে বলবে এই সেই ফুলতলি গ্রামের লাজুক মেয়েটি! যদিও প্রথাগত লেখাপড়া বেশিদিন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি মৃণালিনী। তবু লরেটো স্কুল, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে শিক্ষার মুহূর্তগুলি শব্দের মাণিক হয়ে জ্বলে উঠত চিঠির পাতায় পাতায়। রবীন্দ্রনাথের ভাইপো ভাইঝিদেরও বড্ড প্রিয় ছিলেন মৃণালিনী।
অভিজ্ঞাদেবীর পত্র থেকে জানা যায়, রোজ একটি করে মৃণালিনীর চিঠির জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। স্ত্রীর চিঠি পেলে খুশির চোটে নাচ গান করতেন। সমবয়সী ভাসুরঝিদের পত্রালাপে বার বার সখিসমিতির কথা আসে। মৃণালিনীর সহজ ব্যক্তিত্ব মেয়েমহলে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেইসময়। মৃণালিনী সখিসমিতির কাণ্ডকারখানা জমিয়ে লিখতেন। অবশ্যই তা সুখপাঠ্য ছিল। কারণ পত্রপ্রাপকরা ব্যাকুল হয়ে থাকতেন মৃণালিনীর চিঠি পড়ার জন্য। মৃণালিনীর বেশিরভাগ চিঠিই পাওয়া যায় না। সেসব লেখার শব্দগুলিও হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। টুকরো টুকরো চিঠিগুলির শব্দগুলি অনুসরণ করলে বোঝা যাবে, প্রসঙ্গ অনুসারে বক্তব্যের ভঙ্গি বদলে দিতে পারতেন মৃণালিনী। এই কথনের তর তম পরিবর্তনের ক্ষমতা একজন কুশলী লেখকের থাকে। মৃণালিনীর মধ্যে ছিল। হয়তো উনিশ শতকের কত মেয়ের মধ্যেই ছিল। চিঠির পাতায় পাতায় সেসব মুনশিয়ানা বন্দি হয়ে আছে উনিশ শতকের পর্দানশীন মেয়েদের মতোই।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৬: ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী মেয়ে

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সুধীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালাকে লেখা মৃণালিনীর চিঠিটি বেশ উল্লেখ করার মতো। চিঠির শুরুতেই অনেকদিন পত্র না পাওয়ার অভিযোগটি মৃদু ও মধুর ভাষায় করেছিলেন মৃণালিনী—
“–তোমার সুন্দর মেয়ে হয়েছে বলে বুঝি আমাকে ভয়ে খবর দাও নি পাছে আমি হিংসে করি, তার মাথায় খুব চুল হয়েছে শুনে পর্য্যন্ত‘ কুন্তলীন’ মাখতে শুরু করেছি, তোমার মেয়ে মাথা ভরা চুল নিয়ে —আমার ন্যাড়া মাথা দেখে হাসবে সে আমার কিছুতেই সহ্য হবে না। সত্যিই বাপু আমার বড় অভিমান হয়েছে নাহয় আমাদের একটী সুন্দর নাতনী হয়েছে তাই বলে কি আর আমাদের একেবারে ভুলে যেতে হয়,—”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৪: পরবর্তী পদক্ষেপ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’

তারপর শব্দের পাল লাগিয়ে চিঠির তরণী ভেসে চলেছে তরতরিয়ে। জীবনের ছোট ছোট আবেগকে যেন কাগজের নকশিকাঁথায় শব্দের ফোঁড় দিয়ে বুনে রাখতেন মৃণালিনী। দিব্যি সব আবেগ ব্যবহার করতেন শব্দের মোড়কে, ভাষা ছিল আদুরে। লাল ঝাপলা, টুকটুকে,ডাকনাম, তোলা নাম ইত্যাদি কথ্য শব্দ মৃণালিনীর চিঠির গদ্যকে অনায়াসে আন্তরিক করে তুলেছে। নিজের বাবাকে পত্র লেখার সময় চিঠির পাতায় শব্দের আড়াল থেকে যেন উঁকি দেয় বাপসোহাগী কোনো মেয়ে—“এর মধ্যে যদি কোন লোক আসে তো তার সঙ্গে কচু ও কলম্বানেবু পাঠিয়ে দেবেন।”… “আষাঢ় মাসে এখানে আসবেন।—এ মাসটা এখানেই থাকবেন।” রবীন্দ্রনাথের ভাগনে সত্যপ্রসাদ ঠাকুরবাড়ির হিসেবপত্তরের খেয়াল রাখতেন। তাঁকে চিঠি লেখার সময় মৃণালিনী বিচক্ষণ এক সংসারী মানুষ—
“সত্য, আগেকার যে পঞ্চাশটাকা আমার নামে সরকারী হাওলাত আছে আর সেদিন যে চল্লিশ টাকা নিয়েছি এই নব্বুই টাকা এ মাসে কেটে নিও না। …এ মাসে কেটে নিলে আমার খরচ চলা অসম্ভব।”
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

সন্তানদের পত্র লিখেছেন যে মৃণালিনী সেইসব চিঠির উচ্চারণে কত নির্ভরতা। কত স্নেহ! বেলাকে চিঠি লিখছেন বেশ বুঝে শুনে। সদ্য বিবাহিতা মেয়ের মা যেমন সেই যুগে আকুলতার প্রকাশ ঘটাতেন পরিমিত ভঙ্গিতে। আবার শব্দগুলিতে ভরাট হয়ে আছে রসবোধ।

“সুরেন বাড়ি ফিরে গেছে, তার কী এখন বেশীদিন থাকবার যো আছে। তার শাশুড়ি বলে দিয়েছেন রোজ তাঁদের বাড়ি যেতে।”

মা আর মেয়ের অন্তরঙ্গ এইসব কথা কত সহজে শব্দে বুনে চিঠির পাতায় নকশা করে দিতেন মৃণালিনী। পত্রপ্রাপক তাঁকে অনুভব করতেন শব্দের শরীরে।

রবীন্দ্রনাথকে লেখা মৃণালিনীর চিঠি খুব একটা পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র প্রথম খণ্ডে রয়েছে মৃণালিনীকে লেখা রবি ঠাকুরের চিঠি। রবীন্দ্রনাথের মৃণালিনীর চিঠি পাওয়ার আকুলতা আর ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ থেকে অনুমান করা যায় মৃণালিনীর চিঠি কতটা আকর্ষক ছিল। অভিমানী মেয়ের রাগ ভাঙানোর ভঙ্গিতে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি পড়ে ইচ্ছে করে মৃণালিনীর সব পত্রগুলিকে সাজিয়ে নিয়ে পড়ি। অথচ উপায় নেই। মৃণালিনীর মূল্যবান শব্দে ঠাসা পত্রগুলির বেশিরভাগেরই হদিশ মেলে না। দেশবন্ধু চিত্তররঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ ছিলেন মৃণালিনীর প্রাণের সই। মৃণালিনীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা দেবীকে তিনি লিখেছিলেন অনেক কথা। লিখেছিলেন,

“রবিকাকার কথা ভাবতেই পারি না। কি সুখের সংসার ভেঙ্গেছে। …তিনি যে কী ছিলেন খুব ঘনিষ্ঠভাবে না মিশলে কারু জানবার সম্ভাবনা ছিল না। রবিকাকা যে কিরকম স্ত্রী পেয়েছিলেন, এতদিন তো অনেক বুঝেছেন এখন আরো পদে পদে বুঝবেন।”
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর

সংসার জীবনে অগোছালো এক কবি রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনী তাঁকে আগলে রাখতেন। কেজো অকেজো সব পত্র যেত নিজের নিয়মে। প্রবাসে থাকার সময় চিঠি পাওয়ার জন্য যত ব্যাকুল থাকতেন রবীন্দ্রনাথ ততটা উদগ্রীব ছিলেন না সেসব চিঠির সংরক্ষণে। আসলে ভাবেনইনি মৃণালিনী চলে যাবেন কখনও। আরো একটা কথা ভাবেননি, এমন তরতরিয়ে সহজভাষায় লেখার ভঙ্গি সাহিত্যিকের লক্ষণ। মৃণালিনীর ভাষার দখল ও ভাব প্রকাশের ভঙ্গি অভিনব ছিল। সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরাজি —তিনভাষার সাহিত্যই দিব্যি পড়তেন তিনি।

মার্ক টোয়েনের উপন্যাস হাতে তাঁর মগ্ন ছবি সন্তানদের মনে গাঁথা হয়ে ছিল। খুব ভালো গল্প কথক ছিলেন মৃণালিনী। অবন ঠাকুর ‘ক্ষীরের পুতুল’ গল্প প্রথম শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন মৃণালিনীর থেকেই। মহাভারতের শান্তিপর্বের সহজ অনুবাদও করছিলেন। কিন্তু তারও হদিশ পাওয়া যায় না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষের স্ত্রী মৃণালিনীর রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী ছাড়াও সাবলীল গদ্যকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সময়ের গর্ভে সে সম্ভাবনা হারিয়ে গিয়েছে সেই জীবনে। জন্মান্তর আবার সেই সম্ভাবনাকে যেন ফিরিয়ে দেয়। উনিশ শতকের এমন সব মেয়েদের প্রকাশ ক্ষমতা চিঠির পাতার থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন সময়ে স্বাধীন হোক।

ঋণ স্বীকার
● রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র, প্রথম খণ্ড
● রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content