শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

সেবার বোধিসত্ত্ব রাজার ঘরে জন্মেছেন। ক্রমে ক্রমে তিনি কালের নিয়মেই সিংহাসনে আসীন হলেন। রাজ্যাধিকার পেয়ে ধর্মমতে প্রজাপালন করতে লাগলেন। এক ব্রাহ্মণ রাজার রাজপুরোহিত ছিলেন, তাঁর নাম রুহক। এই কাহিনি এই রুহকের। জাতকমালার অন্তর্গত রুহক জাতক।
একদিন রাজা পুরোহিতকে এক সুসজ্জিত অশ্ব উপহার দিলেন। সেই সুসজ্জা একেবারেই সর্ববিধ সজ্জাসম্ভার, সেই সর্বাঙ্গসজ্জিত ঘোড়ায় চেপে ব্রাহ্মণ রাজসন্দর্শনে এলেন। লোকে বাহবা দিল, মুগ্ধ, বিস্মিত হল। ঘোড়া দেখে, ঘোড়ার সাজ দেখে জনগণের বিস্ময়ের অন্ত রইল না, তাদের অকুণ্ঠ প্রশংসায় ব্রাহ্মণ বড় তৃপ্ত হলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৮: বাথটাব/১০

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি

এই ব্রাহ্মণের এক ব্রাহ্মণী ছিল। এই গল্পটা তাঁরও। সেই মহিলা ছিলেন অতি চতুর, ধূর্ত, কাহিনীকার জানিয়েছেন যে, তিনি নির্লজ্জ-ও ছিলেন বটে। সে যাই হোক, ব্রাহ্মণ যখন পথের দুধারে ভিড় করা জনগণের উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা সাগ্রহে স্ত্রীকে বললেন, তিনি কী এক কুটিল মনোভাবের বশে স্বামীকে বোঝালেন যে, লোকের এতো প্রশংসার কারণ ঘোড়ার ঐ সর্বাঙ্গমণ্ডিত আভূষণ। হবে নাই বা কেন, সকলে তো আর শকুন্তলা নয় যে বল্কলেও মনোরম হবে। ঐ দামী সাজপোষাকে সেজে ব্রাহ্মণ নিজেও যদি ঘোড়ার মত পাদবিক্ষেপে টগবগিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করতে যান, তাহলেও লোকে চেয়ে চেয়ে দেখবে বৈকী! ব্রাহ্মণ-ও অনুরূপ শোভাসম্পন্ন হবেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৭: রাতচরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা

ব্রাহ্মণের মাথা গেল ঘুরে। বলা ভালো, তাঁর মতিচ্ছন্ন হল। তিনি পথে বেরোলেন ঘোড়ার সাজে। তাঁর তখন মনে হয়েছিল যা শুনছেন তা বুঝি বেদমন্ত্র। অভ্রান্ত। তিনি স্ত্রীর এই অদ্ভুত পরামর্শের কিছুই না বুঝে ঘোড়ার সাজে পথে বেরোলেন। লোকে দেখে চমকে গেল। কেউ ব্যঙ্গ করে বলল, আচার্যের শোভা যে ধরে না দেখি, অনুপম, মনোরম। কেউ বলল, শরীর খারাপ স্যর? কেউ বলল পেট গরম হয়েছে, পিত্ত কুপিত। কেউ বলল, লোকটা নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে বুঝি।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

ব্রাহ্মণ বুঝলেন, মস্ত ভুল হয়েছে বটে। এই অযোগ্য কাজে রাজা ও সেনার সামনে তাঁর যে অমর্যাদা হল, যে বিপুল লজ্জার ভার তাঁকে চেপে ধরল তার নেপথ্যে কে? তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি এলেন। ব্রাহ্মণী ততক্ষণে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাজভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। রাজার কাছে ডাক পড়ল। রাজা বোঝালেন, ক্ষমা করে দিতে বললেন। ব্রাহ্মণ কিন্তু আর ব্রাহ্মণীকে গ্রহণ করলেন না।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

গল্পটা এই পর্যন্তই। যদি মনে করা যায় কাহিনীতে লিঙ্গসাম্য রক্ষা পায়নি, দোষী কেন ব্রাহ্মণীই হল, ব্রাহ্মণ কেন ঘোড়া সাজতেই বা গেল তবে তার উত্তর কালের গর্ভে, সমাজদর্শনে। মানুষের নীচতা ও বিশ্বাসের এই মুখোমুখি সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত কে জিতল তা পাঠক ঠিক করুন। তবে ময়ূরের পেখম মেলে কাকের ঔদ্ধত্য দৃষ্টিকটু হয়, বিশ্বাসে বস্তু মেলে, আবার বিশ্বাসে ভর করে সাপের গর্তে হাত দিলে ছোবল-ও খেতে হয়। তাহলে শেষ পর্যন্ত হাতে কি থাকল? পেনসিল? নাকি ঐ সুসজ্জিত ঘোড়াটাই ইন্দ্রিয়ের আকণ্ঠ আসক্তি নিয়ে আত্মজাগরণ, অন্তর্লোকের দ্বিধাহীন উদ্বোধনের বার্তায় এই চিত্ররূপ হয়ে চেতনার দ্বারে আঘাত করে?
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content