শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: সংগৃহীত।

অসমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখতে হলে যেতে হবে কাজিরাঙা। অসমের জলবায়ু, প্রকৃতি, ভৌগোলিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি—সব কিছু মিলে মিশে অসমকে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য দান করেছে। কাজিরাঙা বহু দিন ধরে পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। অনেক সরকারি ও সরকারি হোটেল রয়েছে এখানে। হাতির পিঠে চেপে এই রাষ্ট্রীয় উদ্যানের বুকে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। জিপে করে ঘোরারও ব্যবস্থা রয়েছে।
কাজিরাঙার উত্তর দিকে রয়েছে অসমের সর্ব বৃহৎ নদ ব্রহ্মপুত্র। দক্ষিণে রয়েছে কার্বি পাহাড়ের অংশ বিশেষ। কাজিরাঙায় প্রতিবছরই পরিযায়ী পাখিরা আসে। পাখিদের অন্যতম জায়গা হয়ে উঠে উদ্যানের ভিতরে থাকা ছোট ছোট জলাশয়। সেখানে তারা মাছ খায়। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত পরিযায়ী পাখিরা এখানে আতিথেয়তা গ্রহণ করে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৫৮: বাথটাব/১০

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি

কাজিরাঙাতে এক দিকে যেমন রয়েছে সবুজের মেলা, তেমনি রয়েছে অনেক মূল্যবান গাছগাছালি। রয়েছে অনেক পশু-পাখি। অসমের বনজ সম্পদের মধ্যে আছে অনেক রকমের ঔষধি, বিভিন্ন রকমের অর্কিট এবং গাছগাছালি প্রভৃতি। কাজিরাঙা আবার অসমের তিনটি জেলার সংযোগ স্থলও বটে। গোলাঘাট, নগাঁও এবং কার্বি আংলং জেলার সীমানা স্পর্শ করে রয়েছে এই উদ্যান।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৭: রাতচরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা

কাজিরাঙার ঘন জঙ্গল, বিভিন্ন রকমের জীব-জন্তুকে সংরক্ষণের জন্য ১৯০৮ সালে একে সংরক্ষিত উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৭ সালে কাজিরাঙাকে সর্বপ্রথম পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৫০ সালে একে অভয়ারণ্য বলে ঘোষিত করা হয়। ১৯৭৪ সালে কাজিরাঙা রাষ্ট্রীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়। একশৃঙ্গের গণ্ডার এই অভয়ারণ্যের বিশেষ আকর্ষণ। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসেন এই পৃথিবী বিখ্যাত এই একশৃঙ্গের গণ্ডার দেখতে। ৪৩০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত কাজিরাঙা। এখানে প্রায় ৩১ রকম প্রজাতির স্তন্যপায়ি প্রাণী রয়েছে। বিভিন্ন রকমের সরীসৃপও এই ঘন জঙ্গলে দেখা যায়। হাতি, ভল্লুক, বাঁদর, হনুমান, নেউল, বুনো শুয়োর, হরিণ-সহ অনেক জন্তু রয়েছে। বক, ধনেশ, ঈগল এমন কী পেলিকান পাখিও দেখা যায়। গুই, অজগরের মতো সাপও রয়েছে এখানে।

ছবি: সংগৃহীত।

কাজিরাঙার ভিতরে রয়েছে ছোট বড় অনেক জলাশয়, আর সেই সব জলাশয়ে রয়েছে অনেক রকমের মাছ। এ যেন এক অন্য জগৎ, কৃত্রিমতা থেকে অনেক ধুরে আধুনিক ব্যস্ত জীবনের ছায়া শূন্য। নিখুঁত প্রকৃতির সাম্রাজ্য রয়েছে এখানে। সরকার এই বনাঞ্চলের জীব-জন্তুদের সংস্করণ করার জন্য বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। ১৯৭৯ সালে প্রথমবার ট্রাংকুলাইজারের সহায়তায় গণ্ডার ধরা হয় এবং উত্তরপ্রদেশের দুধোয়া রাষ্ট্রীয় উদ্যানে প্রেরণ করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

কাজিরাঙার বিস্তৃত জঙ্গলকে কুকচক্রীদের দুষ্কর্ম থেকে রক্ষা করতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ পাহারা দেওয়ার জন্য ওয়ারলেস সংযোগ ব্যবস্থা করে দেয়। আসলে কিছু লোকের বিশ্বাস গণ্ডারের খড়্গ দিয়ে অনেক রকম ওষুধ তৈরি করা যায়। বিশেষ করে কিছু কিছু বিদেশে খড়্গ দিয়ে তৈরি গয়না করা এবং এর থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়। বিদেশে এই গণ্ডারের খড়্গের দাম প্রচুর। চোরা শিকারিরা গণ্ডার শিকার করে। এই কুচক্রীদের শাস্তির কড়া বন্দোবস্ত থাকলেও চোরা কারবার বন্ধ হয়ে যায়নি। ফলে গণ্ডারের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। কাজিরাঙা এই একশৃঙ্গের গণ্ডারদের বাড়ি অথচ তারা তাদের বাড়িতেই সুরক্ষিত নয়। গণ্ডারদের সুরক্ষার জন্য প্রসাসনকে আরও কঠিন বন্দোবস্ত নিতে হবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

প্রত্যেক বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ভিতরে অতিরিক্ত জঙ্গল জ্বালিয়ে দেওয়া হয় যাতে বর্ষা এলে তৃণভোজী প্রাণীরা নতুন ঘাস পায়। কাজিরাঙার ভিতরেও বয়ে গিয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট নদী। বর্ষার সময় এই সব নদীও জলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। বর্ষায় উত্তাল ব্রহ্মপুত্রের জলরাশি কাজিরাঙায় প্রবেশ করে বন্যার রূপ ধারণ করে। বন্যার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে কৃত্রিম টিলা তৈরি করা হয়েছে বন্য প্রাণীদের সুরক্ষার জন্য। কিন্তু তথাপি বন্যা প্রতি বছর এই কাজিরাঙার পশুদের অনেক ক্ষতি করে।

ছবি: সংগৃহীত।

অসমের এই ঘন বনানী এবং পশু-পাখিরা সাম্রাজ্য একদিকে যেমন হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে আসে তেমনি প্রকৃতির নিখুদ নির্ভেজাল চেহারা নিত্যদিনের দূষণে ভরা ব্যস্ত জীবনকে যেন ফুসফুসে অক্সিজেন প্রদান করে। জলাশয়, মাটি সব কিছুকে নিয়েই তো প্রকৃতির পূর্ণতা আর জীব-জন্তু, গাছপালা ছাড়া সেই পূর্ণতার কথা ভাবাই যায় না। সেই পূর্ণতারই আরেক নাম যেন অসমের কাজিরাঙা।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content