শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তথা ডিজি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম আমলের পরিচালক। পরবর্তীকালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে এবং পদ্মভূষণ পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রেমিকা দেবী ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ির কানাইলাল ঠাকুরের দৌহিত্রের দৌহিত্রী। ধীরেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জামাই নগেন্দ্রনাথের ছোট ভাই। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র তখন পৃথিবীর নতুন এক শিল্পমাধ্যম। চলচ্চিত্র মাধ্যম নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন, তখন বাংলা চলচ্চিত্র জগতে একটি অসম্পূর্ণতা তাঁর চোখে পড়ল। দেখলেন, ভদ্র, অভিজাত পরিবারের মেয়েরা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে সাহস পায় না।
ধীরেন্দ্রনাথ অনুভব করলেন, অভিজাত পরিবারের মেয়েরা চলচ্চিত্রে এলে আরও উন্নতি হবে এই শিল্পের। তাঁর এই কথা শুনে সকলে তাজ্জব হয়েছিলেন। কারণ এ এক অসম্ভব প্রস্তাব ছিল। ধীরেন্দ্রনাথকে তামাশা করে এক বন্ধু বলেছিলেন, ধীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রেমিকাদেবীই তো যোগ্য অভিনেত্রী। ধীরেন্দ্রনাথ এই কথাটার উপর গুরুত্ব দিলেন। প্রেমিকা দেবী প্রথমে ঘরে বাইরে প্রবল বিতর্কের মধ্যে পড়েন। ভয় পান। কিন্তু তাঁর স্বামীর উৎসাহ আর জেদ তাঁকে সাহস জোগায়। তখন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ। প্রেমিকা দেবী এক সত্যিকারের আধুনিক পদক্ষেপ নিলেন। সমসমায়িক চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকাগুলি তাঁকে ‘দুঃসাহসিকা’ বলে বিশেষিত করল। তাঁর অভিনীত ছবিগুলি ছিল—ফ্লেমস অফ ফ্লেশ, পঞ্চশর, হিডন ট্রেজার। তিনি সত্যিই সম্ভাবনাময় অভিনেত্রী ছিলেন। কিন্তু মাত্র বাইশ বছর আয়ু ছিল তাঁর। আসল নাম ছিল প্রেমিকাময়ী।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৮: পুত্র বীরেন্দ্রর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান মহারাজ রাধাকিশোর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০১: খামখেয়ালির গিরীন্দ্রনাথ

অভিনেত্রী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন রমলাদেবী নামে। তাঁর দুই মেয়ে —পারুল ও মণিকা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ধীরেন্দ্রনাথ দুই মেয়েকেও শিশু শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন। পারুল দুটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। আরব্য উপন্যাসের গল্প অবলম্বনে তৈরি ছবি ‘মরণের পরে’, ‘টাকায় কি না হয়’, ‘পঞ্চশর’ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন পারুল। সেই সময় এই মা ও মেয়েদের পর পর অভিনয় করা মস্ত খবর ছিল। সেই উনিশ শতকে মেয়েদের এ বি শিখে বিবি হওয়ার মতো। রবীন্দ্রনাথের মেয়ে মীরাদেবীর উদ্যোগে পারুলের বিয়ে হল ঠাকুরবাড়িতে। তারপর আর অভিনয় করেননি পারুল। তবে তাঁরও আগ্রহ ছিল না তেমন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৫: বহু আলাস্কাবাসীর ব্যক্তিগত বিমান বা হেলিকপ্টার রয়েছে!

কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট মেয়ে মণিকা অভিনয় করেছিলেন। তাঁকে বলা হত বাংলা ছবির শার্লি টেম্পল। বাবার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে , বাবার উৎসাহে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অভিনয় করার। বাবার পরিচালনায় ‘পথ ভুলে’ তাঁর প্রথম অভিনীত ছবি। এরপর ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘এপার ওপার‘, ‘নারী’, ‘দাবী’, ‘পাষাণদেবতা’, ‘বন্দিতা’, ‘দাসীপুত্র’ প্রভৃতি ছবিতে তাঁর নজরকাড়া অভিনয় ছিল। প্রেমিকাময়ীর ছোট বোন মমতাময়ীর বিয়ে হয়েছিল হেমচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে। তাঁদের সন্তান বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক দীনেন গুপ্ত।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

পারুলের বিয়ের পর তাঁকে দেখে রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি। পারুলের সুন্দর চোখ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন তাঁর ছবি আঁকবেন। মীরা দেবীর আপত্তিতে আর ছবি আঁকা হয়নি। পারুলের ইচ্ছা ছিল চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। তিনি শান্তিনিকেতনে পাঠভবনের ছাত্রাবাসের দায়িত্ব নিলেন। মীরাদেবীর সঙ্গে মালঞ্চে থাকতেন। তাঁর দুই মেয়ে প্রকৃতি ও সুকৃতি খুব ভালো গান গাইতেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

পারুল কিন্তু লেখাপড়াকেই গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি। শোনা যায়, সত্যজিৎ রায় যখন ‘সমাপ্তি’ ছবির জন্য অভিনেত্রী খুঁজছিলেন তখন সুকৃতিকে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারুল রাজি হন নি। আশ্চর্য লাগে, মনে পারুলের বাবা, মা, বোন সকলে চলচ্চিত্র জগতের মানুষ হলেও পারুল কেন নিজেকে এইভাবে সরিয়ে রাখলেন? পারুল ছিলেন সিদ্ধীন্দ্রনাথের স্ত্রী। তাঁদের যৌথ সিদ্ধান্ত ছিল চলচ্চিত্র জগৎ থেকে দূরে থাকার।

ঠাকুরবাড়ির কন্যা এবং বধূরা ছিলেন সরস্বতীর বরপুত্রী। সেই আমলে শিল্পের প্রতিটি মাধ্যমই ধন্য হয়েছে তাঁদের সুচারু স্পর্শে। চলচ্চিত্রে তথাকথিত সাধারণ, ভদ্র পরিবারের মেয়েদের অবাধ যাতায়াতের অন্তরালে প্রেমিকাময়ী, মমতাময়ী, পারুল, মণিকাদের অবদান অস্বীকার করা যায় না।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content