দ্বারকানাথ ঠাকুর।
গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের পিতামহ গিরীন্দ্রনাথ। তিনি দ্বারকানাথ ও দিগম্বরীর চতুর্থ সন্তান। গুণেন্দ্রনাথের পিতৃদেব গিরীন্দ্রনাথ ছিলেন বৈষয়িক মানুষ। ‘কার-ঠাকুর কোম্পানি’র ব্যবসা পিতার মৃত্যুর পর তিনিই দেখতেন। পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ অনেক ঋণ রেখে মারা গিয়েছিলেন। গিরীন্দ্রনাথের পরিচালনায় ব্যবসা লাভের মুখ দেখে। পিতার করা ঋণও পরিশোধ হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অনুজ হয়েও তাঁর অনুসারী ছিলেন না। ধর্মাচরণ নিয়েও তাঁর ভাবনায় ভিন্নতা ছিল। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন গিরীন্দ্রনাথ। শুধু আবেগ দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে সবকিছুর বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। তাঁর পিতা দ্বারকানাথের মধ্যে যে বিজ্ঞানমনস্কতা ছিল, তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। দ্বারকানাথই ঠাকুরবাড়িতে বিজ্ঞানবোধ ও বিজ্ঞানচেতনার বীজ রোপন করেছিলেন। মেডিক্যাল কলেজের উন্নতিসাধন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে দ্বারকানাথ আলোকবর্তিকা জ্বেলেছিলেন। সেই আলো নেভেনি। দিনে দিনে গোটা ঠাকুর পরিবারকেই আলোকিত করেছে।
বিলাসী গিরীন্দ্রনাথেরও বিজ্ঞান নিয়ে ‘আন্তরিক অনুরাগের’ স্মৃতি ধরা আছে একাধিক স্মৃতিচর্চায়। তাঁর ‘উদ্ভাবিত’ বিজ্ঞানের নানা তথ্য ও তত্ত্ব বাড়ির ছোটোদের ওপর মজা করে প্রয়োগ করতেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মেজকাকা গিরীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানিয়েছেন, ‘তিনি অনেক সময় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আমোদ করতেন ও আমাদের ডেকে আমোদ দিতেন।’ একটি স্মৃতি সত্যেন্দ্রনাথের মনে পরিণত-বয়সেও জেগেছিল। তাঁর ‘আমার বাল্যকথা’ বইতে আছে গিরীন্দ্রনাথ এক ধরনের ব্যাটারির সাহায্যে কী কাণ্ডই না ঘটাতেন! সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তড়িৎপ্রবাহযোগে আমার যে সর্বাঙ্গ কম্পমান হত, সে সহজে ভোলবার নয়। যেসব বৈজ্ঞানিক ভেলকিবাজিতে আমাদের খুবই আমোদ হত।’
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০০: ঠাকুরবাড়ির রূপবান, ঠাকুরবাড়ির গুণবান
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ
হোক না শখের বিজ্ঞানচর্চা, আনন্দ-আমোদের বিজ্ঞানচর্চা, সেই চর্চার জন্য গিরীন্দ্রনাথের নিজস্ব একটি ‘পরীক্ষাগার’ও ছিল। ছিল বিবিধ যন্ত্রপাতি আর ব্যাটারি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা থেকেই জানা যায়, ‘তিনি অনেক বিষয়ের রাসায়নিক বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা’ করতেন। অবনীন্দ্রনাথের লেখাতেও আছে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কী মজাদার কাণ্ডই না ঘটাতেন গিরীন্দ্রনাথ! অবনীন্দ্রনাথের দেওয়া সরসতায় ভরপুর এক বর্ণনার অংশবিশেষ তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘দাদামশায়ের শখ বসে বসে ব্যাটারি চালানো। জলে টাকা ফেলে দিয়ে তুলতে বলতেন। একবার এক কাবুলিকে ঠকিয়েছিলেন এই করে। জলে টাকা ফেলে ব্যাটারি চার্জ করে দিলেন। কাবুলি টাকা তুলতে চায়, হাত ঘুরে এদিকে ওদিকে বেঁকে যায়, টাকা আর ধরতে পারে না কিছুতেই।’ অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন ‘কেমিস্ট্রির শখ’ও ছিল তাঁর।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গিরীন্দ্রনাথ ছিলেন খেয়ালি-মনের মানুষ। আনন্দে-আমোদে দিন কাটাতে ভালোবাসতেন। জীবনকে উপভোগ করতে জানতেন। চার পুত্র-কন্যা ও স্ত্রী যোগমায়াকে রেখে মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন তিনি। খোশমেজাজে থাকতেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় আছে, তিনি কতখানি ‘সুরসিক অমায়িক সৌখিন পুরুষ ছিলেন। যেন বিলাসিতা মূর্তিমান।’
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম
গিরীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন বাগান তৈরি করতে। তাঁর সাজানো বাগানে থাকত রকমারি গাছ। ফলের গাছ, ফুলের গাছ। ফলে ফুলে সুশোভিত। আঙুর, বাতাবি, লেবু — এমন অনেক ফলগাছের সঙ্গে সঙ্গে থাকত বহু ফুলের গাছ। চম্পা, চামেলি, মালতী, বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা, গোলাপ, বকুল — এইরকম কত রকমের ফুলের গাছ। নিজের হাতে এসব গাছের পরিচর্যা করতেন। যে কোনও ফুল নয়, সুগন্ধযুক্ত ফুলের প্রতিই তাঁর ছিল যত আগ্রহ। ওই ধরনের গাছই লাগাতেন তাঁর সাজানো বাগানে। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় আছে গিরীন্দ্রনাথের মেজাজমর্জির, খেয়ালিপনার খণ্ডচিত্র। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁকে মনে হত খুবই হিসেবি মানুষ। আবার কখনো-বা দিলখোলা খরুচে। পিতার করে যাওয়া ঋণ শোধ করার জন্য দৈনন্দিন খরচাও কাটছাঁট করেছিলেন। তিনি যে খুব হিসেবি ছিলেন, তা নয়। সেই সত্যটি তাঁর বিবিধ কর্মকাণ্ডে বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কেমন ছিল গিরীন্দ্রনাথের খামখেয়ালিপনা, অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়। বোটে করে চলেছেন। সঙ্গে রয়েছে ইয়ারদোস্ত-বন্ধুবান্ধব। তাস-খেলা জমে ওঠার পর গিরীন্দ্রনাথের মুখে হাসি খেলে যেত। হাসতে হাসতে খানকয়েক তাস হয়তো-বা ফেলে দিতেন গঙ্গার জলে। তবে কি এরপর তাস খেলা বন্ধ হয়ে যেত? না, তেমন অবশ্য কখনো ঘটেনি। অন্য কোনও ঘাটে নৌকো নোঙর করা হত। কেনা হত নতুন তাস। হিসেবি মানুষ হয়েও গিরীন্দ্রনাথ ভিতরে ভিতরে ছিলেন বেহিসেবি। অবস্থার বিপাকে ঋণ-পরিশোধ করতে গিয়ে গিরীন্দ্রনাথকে অনেক কিছুই বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। তবে দ্বারকানাথের স্মৃতি-বিজড়িত বেলগাছিয়া ভিলা ভুলেও তিনি বিক্রি করেননি। অন্তর উৎসারিত অনুরাগ ও আনুগত্য ছিল। মাঝেমধ্যেই সহধর্মিনী যোগমায়াকে নিয়ে গিরীন্দ্রনাথ সেখানে যেতেন। কখনো সঙ্গে নিয়ে যেতেন বন্ধুদেরও।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
কবিবন্ধু ঈশ্বর গুপ্ত সঙ্গে থাকলে এটা-সেটা নিয়ে কবিতা লেখারও ফরমাশ করতেন। গুপ্ত কবি তৎক্ষণাৎ লিখেও ফেলতেন। একবার বেজায় রকম গরম পড়েছিল। কবিবন্ধুকে নিয়ে গিরীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন বেলগাছিয়া ভিলায়। বাগানে বসে ফুরফুরে হাওয়ায়, গাছের ছায়ায় ভেবেছিলেন হয়তো গরম কম লাগবে। আদৌ তা লাগেনি। শেষে গরমের হাত থেকে বাঁচতে বরফ এসেছে, ডাবের জল এসেছে, শরবত এসেছে। অবশেষে প্রাণ যখন একটু জুড়িয়েছে কবিবন্ধুকে অনুরোধ করেছেন, জেরবার হওয়া এই প্রবল গরম নিয়ে কবিতা লিখে দিতে হবে। কবিতা লেখায় ক্লান্তিহীন ঈশ্বর গুপ্ত কালবিলম্ব না করে তখনই লিখে ফেলেছেন গ্রীষ্মের কবিতা।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের পিতৃদেব, অকালে প্রয়াত হওয়া গুণেন্দ্রনাথ ভালো ছবি আঁকতেন। ভুবনখ্যাত ওই দুই শিল্পীর পিতামহও যে ছবি আঁকতেন, সে খবর আমরা ক-জনই বা জানি! তাঁর ছবিতে অবশ্য মৌলিকতা ছিল না। যে কোনও ছবি দেখেই নিখুঁতভাবে এঁকে ফেলতেন তিনি। ছবি অনুকরণের রকমারি স্টাইল ছিল। এমনতরো স্টাইলের কথা বোধহয় ভাবা যায় না, আকাশ কালো করেছে, এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে, ঝড় উঠেছে দেখলে গিরীরেন্দ্রনাথ আর স্থির থাকতে পারতেন না। সঙ্গীদের হুকুম দিতেন নৌকো ছোটাতে। নৌকো কী করে ছুটবে? ছোটো নৌকোর পাল তুলে দেওয়া হত তাঁর নির্দেশ মতো। প্রবল বাতাসে সেই পাল-তোলা নৌকো হু-হু করে ছুটত। নৌকোর ভিতরে জানলার ধারে বসে গিরীন্দ্রনাথ ছবি আঁকতেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন
মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, বিলেতের শিল্পীদের আঁকা তৈলচিত্র নকল করার কাজে গিরীন্দ্রনাথের জুড়ি ছিল না। শুধু বিলেতি ছবি নয়, দেশি ছবিও নকল করতেন নিখুঁত-নির্ভুলভাবে। কত রকমের গুণ ছিল তাঁর। নাটক লিখতেন, কাব্যচর্চা করতেন। মগ্ন হয়ে গানও লিখতেন। ব্রহ্মসংগীত লিখেছেন, কিন্তু কখনোই প্রবলভাবে ব্রাহ্ম ছিলেন না। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর ঠাকুরবাড়িতে পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গিরীন্দ্রনাথ কখনোই চাননি জোড়াসাঁকোয় পুজো বন্ধ হয়ে যাক। ব্রাহ্ম হয়ে যাওয়ার পরপরই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পুজো বন্ধ করে দেননি। কিছুকাল পুজো হয়েছে। পুজোর সময় তিনি অবশ্য বাড়িতে থাকতেন না। পুজোর দায়িত্ব অনেকাংশে সামলাতেন গিরীন্দ্রনাথ। তাঁর আমলে দুর্গাপূজার সময় বাড়িতে যাত্রার আসর বসত। এমনকি বাইনাচও হত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে জানা যায়, এই বাইনাচের আসরে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না।
গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গিরীন্দ্রনাথ ভালো পড়ুয়া ছিলেন। প্রচুর বই পড়তেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, সিন্দুক বোঝাই বই ছিল তাঁর। বটতলা থেকে প্রকাশিত বইয়ের প্রতি বেশি আগ্রহ ছিল। যত পড়তেন, তত লিখতেন না। একটি কাব্যোপন্যাস লিখেছিলেন। একটি নাটকও লিখেছিলেন। ‘বাবুবিলাস’ নামের যাত্রাধর্মী সে নাটকটির অভিনয় হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। সেই অভিনয়ের সাক্ষী হওয়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর দর্শক-আসনে ঠাঁই পাননি। ‘উঁকিঝুঁকি’ মেরে খানিক দেখেছিলেন। না দেখতে পাওয়ার খেদ তাঁর মনে রয়ে গিয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথের ‘আমার বাল্যকথা’ বইতে আছে, ‘মেজকাকা বাবুবিলাস নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন, একবার তার অভিনয় হয়েছিল। তাঁর মোসাহেবদের মধ্যে দীননাথ ঘোষাল বলে একটি চালাকচতুর লোক ছিল। সেই ‘বাবু’ সেজেছিল। অভিনয় কি রকম ওতরাল বিশেষ কিছু বলতে পারি না। আমরা ত আর সে মজলিসে আসন পাইনি, উঁকিঝুঁকি দিয়ে যা কিছু দেখা।’
একেবারে অন্যরকম, অথচ বর্ণময়, এই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা আমরা ক-জনই বা সেভাবে জানি!
একেবারে অন্যরকম, অথচ বর্ণময়, এই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা আমরা ক-জনই বা সেভাবে জানি!
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।