বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিক থেকে) প্রজনন ঋতুতে কুরচি বক। খাবারের খোঁজে কুরচি বক। উড়ন্ত কুরচি বক। (ডান দিকে) ছবি: সংগৃহীত।

আমার স্কুলে যাওয়ার পথে বাস রাস্তার দু’পাশে বেশ কিছু ডোবা আর জলা জায়গা রয়েছে। টোটোতে চেপে আসা-যাওয়া করার সময় অভ্যাসবশতঃ রাস্তার দু’পাশে সেইসব ডোবা ও জলা জায়গার দিকে বারবার চোখ যায়। আবার বাড়ি থেকে বাস রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় কিছুটা পথ অতীতের কালনাগিনী নদী ও বর্তমানে কালনাগিনী খালের পাড় ধরে আসি। গতকাল যখন আসছিলাম তখন পুরো ভাঁটা চলছে। খালের তলদেশে ঝিরঝিরে জল। আর সেখানেই দেখি এক দঙ্গল সাদা বক। কেউ ধীর পদক্ষেপে জল কাদার উপর হেঁটে চলেছে। কেউ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে জলের দিকে।

আবার কেউ সামান্য উড়ে গিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসছে। আবার আজ হঠাৎ নজরে পড়ল বাস রাস্তার পাশে একটা অগভীর ডোবায় পাঁচটা বক খাবারের খোঁজে অপেক্ষমান। বকগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল মাথায় রয়েছে দুটো টিকি, ঠিক যেমন বৈষ্ণবদের মাথার পেছনদিকে একটা টিকি থাকে। এমন টিকিওয়ালা বক সুন্দরবন অঞ্চলে খুব পরিচিত পাখি। এই জাতির বকগুলো তাই শৈশব থেকেই আমার খুব চেনা। শুধু আমার নয়, হয়তো সুন্দরবন এলাকার অধিকাংশ মানুষেরই চেনা। আমরা ঠাকুমা বা বাবা-মায়ের কাছে এই বকগুলোকে ‘বোষ্টম বক’ বলে ডাকতে শুনেছি। বলাবাহুল্য টিকির জন্যই এদের এমন নামে ডাকা হয়। তবে এ নাম হল স্থানীয় নাম। বাংলায় এই বক কুরচি বক নামে পরিচিত।
এক নজরে দেখলে কুরচি বক আর গোবক গুলিয়ে যেতে পারে। দুটোরই আকার প্রায় এক। দুই প্রকার বকই ধবধবে সাদা আর রোগাটে গড়ন। পার্থক্য অনেক থাকলেও এই আপাত সাদৃশ্যের জন্য বর্তমান প্রজন্মের সুন্দরবনবাসীদের অনেকেই গুলিয়ে ফেলে। প্রধান পার্থক্য হল, অ-প্রজনন ঋতুতে গোবকের চঞ্চু হলুদ কিন্তু কুরচি বকের চঞ্চু কালো, আর গোবকের পায়ের রঙ হয় হলদেটে ধূসর কিন্তু কুরচি বকের পায়ের রঙ হয় কালো। তাছাড়া প্রজনন ঋতুতে কুরচি বকের মাথায় দুটো টিকি হয় যা গোবকের ক্ষেত্রে হয় না। এছাড়া প্রজনন ঋতুতে কুরচি বকের পিঠে ও বুকে অপূর্ব সুন্দর দেখতে ধবধবে সাদা প্রজনন-পালক তৈরি হয় যা গোবকের ক্ষেত্রে তৈরি হয় না। আর সর্বোপরি গোবক মূলতঃ স্থলচর পাখি, কিন্তু কুরচি বক সম্পূর্ণতই জলচর।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯০: দুই ভবানী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ

কুরচি বককে ইংরেজিতে বলে ‘Little egret’, বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Egretta grazetta’। ভারতসহ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ এবং আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে কুরচি বক দেখা যায়। কুরচি বক আকারে বেশ ছোট্টখাট্টো পাখি। এদের উচ্চতা হয় ৫৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার, ডানা প্রসারিত করলে ৮৫ থেকে ১০৫ সেন্টিমিটার বিস্তার হয়। আর ওজন হয় ৩০০ থেকে ৭০০ গ্রাম। আগেই বলেছি, প্রজনন ঋতুতে এদের দুটো টিকি আর পিঠ ও বুকে অদ্ভুত সুন্দর প্রজনন-পালক তৈরি হয়। তাছাড়া প্রজনন ঋতুতে এদের চঞ্চু ও চোখের মাঝে যে পালকহীন অংশ রয়েছে তা নীল বা লালচে বর্ণ ধারণ করে। স্থির অবস্থা থেকে ভয় পেয়ে ওড়ার সময় কিংবা সন্ধ্যেবেলায় যে গাছে দল বেঁধে এরা থাকে সেখানে এদের “ক্রাক ক্রাক” বা “ক্রে ক্রে” ডাক শুনতে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

এমনিতে কুরচি বকরা মিষ্টি বা নোনা জলের পুকুর, খাল, নদী, হ্রদ, জলাভূমি ইত্যাদির তীরের দিকে অগভীর বা কাদা অংশে ঘোরাঘুরি করে। তবে সম্ভবতঃ প্রাকৃতিক জলাভূমির বিনাশ এদেরকে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অভিযোজিত করেছে। তাই এখন এদের ধান জমি ও মাছ চাষের পুকুরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। এরা রাতে কোনও বড় জলাশয়ের তীরে কিংবা গ্রাম বা শহরের মধ্যে কোনও বড় গাছের উপরে আরও অন্যান্য বক ও জলচর পাখিদের সাথে একসাথে বসবাস করে। কুরচি বকের প্রধান খাদ্য হল ছোট ছোট মাছ। তাছাড়া এরা শামুক, ঝিনুক, চিংড়ি, কাঁকড়া, ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় এমনকি ছোটখাটো সরীসৃপ প্রাণী ধরেও খায়।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

সুন্দরবন অঞ্চলে কুরচি বকদের প্রজনন ঋতু সাধারণতঃ নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে। এই সময় পুরুষ ও স্ত্রী কুরচি বক জোড় বাঁধে। অবশ্য বাইরে থেকে স্ত্রী ও পুরুষ কুরচি বককে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এরা বড় গাছের উপরে চ্যাটালো ধরনের বাসা বানায়। বাসা বানাতে এরা শুকনো পাতা, খড়কুটো বা গাছের শুকনো সরু শাখা ব্যবহার করে। সাধারণতঃ একই জায়গায় এরা প্রতি বছর বাসা বানায়, এমনকি দেখা গেছে পুরনো বাসা সারিয়ে নিয়ে সেখানেই ডিম ফোটায়। স্ত্রী কুরচি বক সাধারণত তিন-চারটি হালকা নীলচে-সবুজ রঙের ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ কুরচি বক পালা করে ডিমে তা দেয়। ২১ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। মা ও বাবা কুরচি বক উভয়ই বাচ্চাদের পরিচর্যার দায়িত্ব নেয়। ৪০ থেকে ৪৫ দিন বয়স হলে বাচ্চারা ভালোভাবে উড়তে শিখে যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

বর্তমানে কুরচি বকরা বিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত না হলেও সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দীতে এদের সংখ্যা প্রধানতঃ ইউরোপে ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। বিপুল পরিমাণে কুরচি বক হত্যা করা হয়েছে কেবলমাত্র এদের প্রজনন পালকের লোভে। এই প্রজনন-পালক দিয়ে শৌখিন টুপি তৈরি করা হত। শোনা যায় সমপরিমাণ সোনার চেয়ে এই বকের পালকের দাম ছিল বেশি। ইউরোপে এই বকের পালকের চাহিদা পৌঁছে যায় এশিয়াতেও। ফলে ওই সময় সুন্দরবনসহ ভারতের নানা জায়গায় বিপুল পরিমাণ কুরচি বক শিকার করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বকের পালকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় এবং বকের পালকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় কুরচি বকের সংখ্যা পৃথিবীজুড়েই উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য আনন্দ হলেও আমাদের উচ্ছ্বাসের কিছু নেই।

(বাঁদিক থেকে) কুরচি বকের জুটি। কুরচি বক। (ডান দিকে) ছবি: সংগৃহীত।

আমি নিজে শৈশবে দেখেছি আমাদের গ্রামের পুকুরে সারা বছর প্রচুর পরিমাণে কুরচি বকের আনাগোনা থাকত। জলাভূমি, খাল, বিল, নদী ইত্যাদিতে প্রচুর কুরচি বক দেখা যেত। এখন কিন্তু আগের মতো আর দেখা যায় না। জলাভূমির হ্রাস নিশ্চিতভাবেই অন্যতম কারণ। তাছাড়া কৃষিকাজে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যাভাব এবং বিষক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে আক্রান্ত হওয়াও এদের সংখ্যা হ্রাসের গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে আমার মনে হয়। তাই আগামী দিনে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে প্রকৃতির এই সুন্দর প্রাণীটি সুন্দরবনের বুক থেকে হারিয়ে না যায়। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content