শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


স্যর উইলিয়াম জোন্স।

His beauties and merits are tarnished by any translation, but few who can read him in the original would doubt that both as poet and as dramatist, he was one of the great men of the world. —A. L. Basham, ‘The Wonder that was India’.

কালিদাস সেই কবি, যিনি প্রমাণ করেছেন হাজার বিধিবিধান মেনে নিয়েও প্রতিভা তার সত্য স্বর শোনাতে পারে। – বুদ্ধদেব বসু।

Tenderness in expression of feelings, and richness of creative fancy have assigned to him his lofty place among the poets of all nations. — Alexander Von Humboldt.
 

কোথা তব রাজসভা, কোথা তব গেহ

তামিল সঙ্গম সাহিত্যের বর্ষাকালীন প্রিয়াবিরহকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনা উত্তর ভারতে প্রথম সাতবাহন রাজা হালের ‘সত্ত-সই’তে প্রকট হয়। তেমনই প্রকট কালিদাসের মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের ব্যবহারে। ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলে’র শুরুর দিকে গ্রীষ্মের বর্ণনায় নটী মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে গেয়ে ওঠেন, “ঈসীসিচুম্বিআইং ভমরেহিং…”। নন্দনতত্ত্বের বিশিষ্ট অধ্যাপক কে কৃষ্ণমূর্তির মতে, মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভ যেহেতু তামিলনাড়ুর সীমান্তবর্তী তাই প্রাচীন তামিল কাব্যের রচনারীতি প্রথমত মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতকে পরে ধ্রুপদী সংস্কৃতকে প্রভাবিত করেছিল। পৃষ্ঠপোষক রাজার দূত হয়ে মহাকবির কুন্তল দেশ যাত্রা সর্বজনবিদিত। এই কুন্তল রাজ কদম্ব রাজবংশের, রাষ্ট্রকূটের নাকি বিদর্ভের এই নিয়ে পণ্ডিতেরা বার বার উত্তপ্ত আলোচনায় মেতেছেন। তাছাড়া বৈদর্ভীরীতিসন্দর্ভে কালিদাসের বিশেষ পক্ষপাত, বিদর্ভ দেশের বেশভূষার প্রতি বিশেষ টান বিচার করে তিনি যে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথম ভাগ বিদর্ভে কাটিয়েছিলেন এই মতো জোরালো হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় উজ্জয়িনীকে কালিদাস কখনও ‘রাজধানী’ বলেননি বরং বিদিশার ক্ষেত্রে সেই সম্বোধন করেছেন।

মেঘদূতে উজ্জয়িনীর প্রতি তাঁর ভালবাসা, সন্নিহিত অঞ্চলের পাহাড়, নদী, গাছ, লতা , ফুল, স্থাপত্যের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাকবি হিসেবে তাঁর যে নাম-যশ সবই তাঁকে ওই অঞ্চলের কিংবা তিনি দীর্ঘদিন সেখানে কাটিয়েছিলেন বলে ধারণা করিয়েছে। কাশ্মীরের প্রখ্যাত পণ্ডিত লক্ষ্মীধর কল্ল (১৮৯১-১৯৫৩ খ্রি.) তাঁর ‘The Birth Place of Kalidasa’ তে কবিকে নিশ্চিতভাবে কাশ্মীরের অধিবাসী বলে উল্লেখ করেছেন কারণ তাঁর মতে, কাশ্মীরে না থেকে কারও পক্ষে সেখানকার প্রাণিকুল, উদ্ভিদকুল অথবা অখ্যাত জায়গার এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।

 

একমেব হয়েও একা নন

ব্র্যান্ড নেম বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন সেটাই। জনমানসে তাঁর কীর্তিকাহিনির প্রচার-প্রসার তখন এতটাই বেশি যে নামহীন ভাল লেখা হলেই পণ্ডিতেরা, টীকাকারেরা কালিদাসের লেখা বলে চালিয়ে দিতেন। প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ সিগফ্রেড লিয়েনহার্ড দেখিয়েছেন, এই প্রয়াসে ঘটকর্পর, মঙ্গলাষ্টক, নলোদয়, পুষ্পবাণবিলাস, রাক্ষসকাব্য, সরস্বতীস্তোত্র, শৃঙ্গারাষ্টক, শৃঙ্গারতিলক, শ্যামলদণ্ডক, শ্রুতবোধ হয়ে গেল তাঁর রচনা! সাল ১৯৪১, জনৈক রাজবৈদ্য জিবরাম গুজরাটের গোণ্ডাল থেকে বিক্রমাঙ্ক শ্রীসমুদ্রগুপ্তের রচনারূপে অভিহিত ‘কৃষ্ণচরিত’ নামক পুঁথির খণ্ডিত অংশ প্রকাশ করেন, প্রকাশের পর মহাকবি কালিদাস সম্পর্কে নতুন করে বিতর্ক শুরু হল। বলা হল, নাট্যকার কালিদাস(শূদ্রকের সভাকবি নাট্যকার) ও মহাকাব্যকার কালিদাস (হরিষেণ- যিনি রঘুকার) এক ব্যক্তি নন।

আরও পড়ুন:

অভিজ্ঞান-শকুন্তলের নাট্যকার কালিদাস/১

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ

বহু বিদগ্ধ কালিদাস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এম শ্রীনিবাসাচার্য এবং টি.এস.নারায়ণ শাস্ত্রী নিশ্চিতভাবে জানিয়েছেন যে কালিদাসের নামে প্রচলিত সমস্ত কাজ তাঁর একার নয়। আধুনিক শ্রীনিবাসাচার্যের মতো প্রাচীন আলঙ্কারিক রাজশেখরও তিনজন কালিদাসের কথা বলেছেন—”…. কালিদাসত্রয়ী কিমু।” তেমনই এ যুগের টিএস নারায়ণ শাস্ত্রী থেকে শুরু করে ‘রাজতরঙ্গিণী’র লেখক কহ্লণ মাতৃগুপ্ত নামে জনৈক কবিকে কালিদাস বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। এই মাতৃগুপ্ত ‘সেতুবন্ধ’, ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ এবং ‘বিক্রমোর্বশীয়ে’র রচয়িতা। নারায়ণ শাস্ত্রী আরও জানিয়েছেন, কালিদাস ওরফে মেধারুদ্র ‘কুমারসম্ভব’, ‘মেঘদূত’ এবং ‘রঘুবংশে’র কবি, আর কালিদাস ওরফে কোটিজিৎ ‘ঋতুসংহার’, ‘শ্যামলদণ্ডক’ এবং ‘শৃঙ্গারতিলকে’র রচয়িতা। জার্মান ভারততত্ত্ববিদ ও সংস্কৃতজ্ঞ থিওডর অফ্রেচট (Theodore Aufrecht) বিভিন্ন যুগের চার, পাঁচজন কালিদাসের উল্লেখ করে ‘নব কালিদাস’, ‘আকবরীয় কালিদাস’, ‘অভিনব কালিদাস’ প্রভৃতি কথ্য, প্রচলিত শব্দগুলোকে সমর্থন করেছিলেন। অধ্যাপক কে কৃষ্ণমূর্তি তাঁর দীর্ঘ ভারতীয় কাব্য, নাট্য, শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জীবনে মন্তব্য করেছিলেন যে, ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের যুগে কোনও উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক রাজা ও তাঁর সভাকবি মাত্রেই ‘বিক্রমাদিত্য ও কালিদাস’ এই যুগলবন্দীতে উচ্চারিত হতেন।
 

পাঠে-অনুবাদে পেলাম অমূল্য রতন

সেই অমানুষী প্রতিভার অধিকারী কবি ‘নাট্যশাস্ত্রে’র (ভরতমুনি প্রণীত) নির্দেশ মেনে আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক অভিনয় থেকে গানের ব্যবহার ও বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের ব্যঞ্জনা তাঁর নাট্যসাহিত্যে এমন ভাবে দিয়েছিলেন যে ভ্রাম্যমাণ নাটকমণ্ডলী, পারম্পরিক কথকতা থেকে প্রাচীন ঐতিহ্যের যক্ষগান, দেশীয় নাট্যপ্রয়োগ কৌশল, এবং বিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত স্কুল, কলেজের অভিনয়ে ও আজও পর্যন্ত বছরের এই বিশেষ সময়ে বিভিন্ন কালিদাসমহোৎসবে, সমারোহে অভিজ্ঞান-শকুন্তলকে আপন করে নেওয়া ভারতবাসীর সংখ্যা কিছু কম নয়। জন্মের পর থেকেই মায়ের শিক্ষা না পেয়ে, পালক পিতা কণ্বের আদেশ, উপদেশে, প্রিয় সখীদের সাহচর্যে বড় হয়ে, প্রিন্স চার্মিংকে পেয়ে ও হারিয়ে, অভিশাপ ও দুর্ভোগের শেষে ধৈর্য-স্থৈর্যের প্রতীকে মাতৃমূর্তিতে শকুন্তলার অবিচল অবস্থান মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাপনে স্বাধীনতা-পূর্ব ও উত্তর কালে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল। ততটা সহায়ক হয়নি আর এক ইন্দো-ইউরোপীয় চরিত্র দ্রৌপদীর জটিল যাপন দর্শাতে, তাঁর ক্ষেত্রে ‘সুগৃহিণী’, ‘রন্ধনপটিয়সী’ এইসব বিশেষণ মৈথিলী শরণ গুপ্ত থেকে মহাশ্বেতা দেবীর উপাদান সংগ্রহে উপযোগী হয়নি।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষায় অনূদিত এক ধ্রুপদী সাহিত্যের রস আহরণ, অভিনয়ের মাধ্যমে মহাকবি কালিদাসের প্রতি শ্রদ্ধা, স্মরণ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যাপক থেকে সাধারণ দর্শকদের উজ্জীবিত করেছিল। স্যর মনিয়র উইলিয়ামস্ এর বিশিষ্ট মত ছিল, ” Indeed, no composition of Kalidasa displays more the richness and fertility of his poetical genius, exuberance of his imagination, the warmth and play of his fancy, his profound knowledge of the human heart, his delicate appreciation of its most refined and tender emotions…(1876), আর “কাব্যেষু নাটকং রম্যম্ / তত্র রম্যা শকুন্তলা” জেনে বুঝে বিশ্বকবি বলেছিলেন, “… দুঃখের ভিতর দিয়ে মর্ত্য শেষকালে স্বর্গের প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে”।

এই মহাভারত প্রসিদ্ধ আখ্যানের অভিনয় সুপ্রাচীন কাল থেকে শুধুমাত্র মৌখিক বা পরম্পরা ক্রমে হতো এমন ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। দেশজুড়ে এর পাঠবৈচিত্র্যকে ভিত্তি করে বঙ্গীয়, দেবনাগরী, মিশ্র দেবনাগরী, মৈথিল, কাশ্মীরীয় এবং দক্ষিণ-ভারতীয় বহু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও অনুলিপি প্রচলিত ছিল। স্বয়ং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৭১ সালে যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষার্থীদের জন্য রাঘবভট্টের টীকা সহ ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তল’ সম্পাদনা করলেন তখন বঙ্গীয় পাঠ, সংস্করণ ছেড়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় (দেবনাগরী) পাঠ গ্রহণ করেন কারণ বঙ্গীয় পাঠের তৃতীয় অঙ্কে শকুন্তলা খানিক প্রগলভা এবং অতিরিক্ত অংশ যুক্ত হওয়ায় দীর্ঘ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বহুভাষাবিদ, পণ্ডিত এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় এলেন, দেখলেন, জয় করলেন এর মতো করে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক, ল্যাটিন ইত্যাদি ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের অত্যাশ্চর্য মিল ঘোষণা করলেন। এরই মধ্যে পণ্ডিত রাধাকান্ত দেবের কাছ থেকে নাটক কী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কোনটি জেনে নিয়ে নদিয়ার এক পণ্ডিতের সহায়তায় বঙ্গীয় পাঠ অনুসরণে প্রথমে অভিজ্ঞান-শকুন্তলমের ল্যাটিন অনুবাদ এবং পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নাম দিলেন ‘সকোন্তলা-দ্য ফ্যাটাল রিং’(১৭৮৯)। অনুবাদের দশ বছরের মধ্যেই এই কাজের জন্য উইলিয়াম জোন্স আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর এই কাজের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, রাশিয়ান, হাঙ্গেরীয়, সুইডিস, পোলিশ, ড্যানিস ভাষায় এমনকি আইসল্যান্ডিকেও ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’-এর অনুবাদ করেন। সেইসময় গোটা ইউরোপ ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠে। জোন্স কালিদাসকে ‘ভারতের শেক্সপিয়র’ (the Indian Shakespeare) আখ্যা দেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

অভিজ্ঞান-শকুন্তলের মতো ভারতীয় সাহিত্যিক ঐতিহ্যে চলে আসা আখ্যান, প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় ভেসে যাওয়া এক সদ্য যুবতীর শরীরের শৈল্পিক প্রকাশ, অঙ্গ-সঞ্চালন, লীলাচঞ্চল পূর্বরাগ, গান্ধর্ব বিবাহ, অভিশাপ বৃত্তান্ত এবং মাতৃত্ব সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় পাঠকের কাছে অস্বস্তির কারণ হবে কিনা, সেই নিয়ে জোন্স সাহেব চিন্তিত ছিলেন ঠিকই কিন্তু ভারতীয় ভাবনার নিজস্ব প্রকাশে কখনও সাহিত্যিক প্রেম ভাবনাকে অন্তরায় হতে দেননি, ঘটিয়েছিলেন নিজস্ব প্রকাশ। এইসময় ‘শকুন্তলাঝড়’ থেকে জার্মান পণ্ডিত, অনুবাদকরা নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারেননি।

বিশ্বসাহিত্যের ভ্রমণকাহিনির অন্যতম স্রষ্টা সুপণ্ডিত জর্জ ফর্স্টার উইলিয়াম জোন্সের ল্যাটিন অনুবাদের অনুসরণে ১৭৯১ সালে প্রথম ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলে’র জার্মান অনুবাদ করলেন। জার্মান পণ্ডিতদের অনুবাদে তিনি হয়ে উঠলেন ‘চাইল্ড অব নেচার’ —প্রকৃতির কন্যা। ফর্স্টার এই বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ছিলেন, কারণ মনুষ্য হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগ, অনুভূতি যে গাঙ্গেয় উপত্যকার কালো চামড়ার মানুষেরা এইভাবে ভাষায় প্রকাশে সক্ষম, তাও আবার তাঁদের কলম ধরার প্রায় হাজার, দেড় হাজার বছর আগে সেটা তাঁদের ধারণারও অতীত ছিল। জর্জ ফর্স্টার কৃত অনুবাদ যেমন মূল সাহিত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছিল তেমন নিশ্চয় এমন নাট্যাদর্শ সৃষ্টি করেছিল যা দেখে বিখ্যাত জার্মান মনীষী জন হার্ডার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, শকুন্তলার মতো সৃষ্টি পৃথিবীতে দু’হাজার বছরে একবার হয়। নিজের করা অনুবাদ ফর্স্টার পাঠিয়েছিলেন মহাকবি গ্যেয়টের কাছে। তিনি সেই নাটকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, “Wouldst thou the young year’s blossoms and the fruits of its decline,.. I name thee, O Sakoontala! and all at once is said.”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

ইউরোপের কবিকুলগুরু গ্যেয়টের কৃত শকুন্তলা-সমালোচনাকে বিশ্বকবি বলেছিলেন—
“(সমালোচকের) আনন্দের অত্যুক্তি নহে, ইহা রসজ্ঞের বিচার”। এরই মধ্যে স্যর মনিয়র উইলিয়ামস্ ১৮৫৫ সালে দক্ষতার সঙ্গে নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করে নাম দিলেন, ‘শকুন্তলা অর দ্য লস্ট রিং’। অনুসরণ করলেন দেবনাগরী পাঠ ও পাণ্ডুলিপি। অত্যন্ত জনপ্রিয় সেই অনুবাদের মধ্যে দিয়ে তিনি দুটি কাজ করেছিলেন, প্রথমত ইউরোপের সঙ্গে প্রাচ্যের বিদ্যা, বুদ্ধির পরিচয় ঘটিয়েছিলেন, দ্বিতীয়ত উপমহাদেশের লোকজনের হৃত আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আত্মপ্রশংসায় বলেছিলেন, “…youthful English-speaking Indians—cultured young men educated at the Universities of Calcutta, Madras and Bombay – have acted the Sakoontala in the very words of my translations…”
দেশীয় প্রাচীন সাহিত্যগুলির বিবিধ ইউরোপীয় ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ ঐতিহ্যবাহী শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি জমি জরীপে সাহায্য করেছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে নেটিভ জনমানসের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল, ‘Holy land’ এর ‘Holy text ‘ তাদের আপন হয়েছিল। আর সেই স্রষ্টা, মহাকবি তিনি তাঁর এই অনন্য সৃষ্টির ভরতবাক্যে (শেষ শ্লোকে) বলেছিলেন, “পুনর্ভবং পরিগতশক্তিরাত্মভূঃ” —আর যেন না ফিরি এই ধরাধামে। জীবনমুখী দর্শনে বিশ্বাসী কালিদাসের কাছে শুদ্ধ, পবিত্র, আবহমান ভালবাসাই ছিল জীবনের অন্যতম আস্বাদ্য। ভালবাসাহীন জীবন মৃত্যুর সমান, এতে প্রকৃতি তার সজীবতা হারায়, বৃক্ষরাজি হারায় সরসতা, নদীগুলো হয় শুষ্ক। পৃথিবী বর্জ্যভূমিতে পরিণত হয় এবং জীবন হয়ে ওঠে ভারপ্রদ। মনুষ্য সমাজ তাঁর কাছে ছিল পরমপিতার প্রতিরূপ। তাই ঈশ্বরজ্ঞান ও আত্মজ্ঞান যে সদৃশ সেটা বোঝাতে তিনি সদা সতর্ক ছিলেন, ‘আত্মৈব হি হ’। এই জ্ঞান মানুষকে জন্ম, মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্ত করে মোক্ষ লাভ করায়। কাব্য, নাট্য পাঠ, দর্শনের রসাস্বাদ সে তো ব্রহ্মাস্বাদসহোদর , নাটকের প্রায়োগিক দিক তাই আজও নাট্যকার এবং দর্শককে একাসনে বসায়, তাদের মুক্তির স্বাদ এনে দেয়।—শেষ
ঋণস্বীকার:
কালিদাস : কে. কৃষ্ণমূর্তি
কালিদাস : প্রভাকর নারায়ণ কওথেকর
কালিদাস : আর. ডি. কারমারকার
দি অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্ : এম. আর.কালে
অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্ : সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী
মেঘদূত ও সৌদামিনী: সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী
সংস্কৃতানুশীলনে রবীন্দ্রনাথ : সুখময় ভট্টাচার্য
এ হিস্ট্রি অফ ক্লাসিক্যাল স্যান্সক্রিট লিটারেচার: এস.এন.দাশগুপ্ত এবং এস.কে.দে
শকুন্তলা- টেক্সটস, রিডিংস, হিস্টোরিস : রোমিলা থাপার
সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস: ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
কালিদাস প্রতিভা: শ্রী রঘুনাথ মল্লিক
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত পনেরো বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ ‘কাব্যবিলাস’। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণার কাজ শেষ করেছেন। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content