স্যর উইলিয়াম জোন্স।
কালিদাস সেই কবি, যিনি প্রমাণ করেছেন হাজার বিধিবিধান মেনে নিয়েও প্রতিভা তার সত্য স্বর শোনাতে পারে। – বুদ্ধদেব বসু।
Tenderness in expression of feelings, and richness of creative fancy have assigned to him his lofty place among the poets of all nations. — Alexander Von Humboldt.
কোথা তব রাজসভা, কোথা তব গেহ
তামিল সঙ্গম সাহিত্যের বর্ষাকালীন প্রিয়াবিরহকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনা উত্তর ভারতে প্রথম সাতবাহন রাজা হালের ‘সত্ত-সই’তে প্রকট হয়। তেমনই প্রকট কালিদাসের মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের ব্যবহারে। ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলে’র শুরুর দিকে গ্রীষ্মের বর্ণনায় নটী মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে গেয়ে ওঠেন, “ঈসীসিচুম্বিআইং ভমরেহিং…”। নন্দনতত্ত্বের বিশিষ্ট অধ্যাপক কে কৃষ্ণমূর্তির মতে, মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভ যেহেতু তামিলনাড়ুর সীমান্তবর্তী তাই প্রাচীন তামিল কাব্যের রচনারীতি প্রথমত মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতকে পরে ধ্রুপদী সংস্কৃতকে প্রভাবিত করেছিল। পৃষ্ঠপোষক রাজার দূত হয়ে মহাকবির কুন্তল দেশ যাত্রা সর্বজনবিদিত। এই কুন্তল রাজ কদম্ব রাজবংশের, রাষ্ট্রকূটের নাকি বিদর্ভের এই নিয়ে পণ্ডিতেরা বার বার উত্তপ্ত আলোচনায় মেতেছেন। তাছাড়া বৈদর্ভীরীতিসন্দর্ভে কালিদাসের বিশেষ পক্ষপাত, বিদর্ভ দেশের বেশভূষার প্রতি বিশেষ টান বিচার করে তিনি যে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথম ভাগ বিদর্ভে কাটিয়েছিলেন এই মতো জোরালো হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় উজ্জয়িনীকে কালিদাস কখনও ‘রাজধানী’ বলেননি বরং বিদিশার ক্ষেত্রে সেই সম্বোধন করেছেন।
একমেব হয়েও একা নন
ব্র্যান্ড নেম বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন সেটাই। জনমানসে তাঁর কীর্তিকাহিনির প্রচার-প্রসার তখন এতটাই বেশি যে নামহীন ভাল লেখা হলেই পণ্ডিতেরা, টীকাকারেরা কালিদাসের লেখা বলে চালিয়ে দিতেন। প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ সিগফ্রেড লিয়েনহার্ড দেখিয়েছেন, এই প্রয়াসে ঘটকর্পর, মঙ্গলাষ্টক, নলোদয়, পুষ্পবাণবিলাস, রাক্ষসকাব্য, সরস্বতীস্তোত্র, শৃঙ্গারাষ্টক, শৃঙ্গারতিলক, শ্যামলদণ্ডক, শ্রুতবোধ হয়ে গেল তাঁর রচনা! সাল ১৯৪১, জনৈক রাজবৈদ্য জিবরাম গুজরাটের গোণ্ডাল থেকে বিক্রমাঙ্ক শ্রীসমুদ্রগুপ্তের রচনারূপে অভিহিত ‘কৃষ্ণচরিত’ নামক পুঁথির খণ্ডিত অংশ প্রকাশ করেন, প্রকাশের পর মহাকবি কালিদাস সম্পর্কে নতুন করে বিতর্ক শুরু হল। বলা হল, নাট্যকার কালিদাস(শূদ্রকের সভাকবি নাট্যকার) ও মহাকাব্যকার কালিদাস (হরিষেণ- যিনি রঘুকার) এক ব্যক্তি নন।
অভিজ্ঞান-শকুন্তলের নাট্যকার কালিদাস/১
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ
পাঠে-অনুবাদে পেলাম অমূল্য রতন
সেই অমানুষী প্রতিভার অধিকারী কবি ‘নাট্যশাস্ত্রে’র (ভরতমুনি প্রণীত) নির্দেশ মেনে আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক অভিনয় থেকে গানের ব্যবহার ও বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের ব্যঞ্জনা তাঁর নাট্যসাহিত্যে এমন ভাবে দিয়েছিলেন যে ভ্রাম্যমাণ নাটকমণ্ডলী, পারম্পরিক কথকতা থেকে প্রাচীন ঐতিহ্যের যক্ষগান, দেশীয় নাট্যপ্রয়োগ কৌশল, এবং বিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত স্কুল, কলেজের অভিনয়ে ও আজও পর্যন্ত বছরের এই বিশেষ সময়ে বিভিন্ন কালিদাসমহোৎসবে, সমারোহে অভিজ্ঞান-শকুন্তলকে আপন করে নেওয়া ভারতবাসীর সংখ্যা কিছু কম নয়। জন্মের পর থেকেই মায়ের শিক্ষা না পেয়ে, পালক পিতা কণ্বের আদেশ, উপদেশে, প্রিয় সখীদের সাহচর্যে বড় হয়ে, প্রিন্স চার্মিংকে পেয়ে ও হারিয়ে, অভিশাপ ও দুর্ভোগের শেষে ধৈর্য-স্থৈর্যের প্রতীকে মাতৃমূর্তিতে শকুন্তলার অবিচল অবস্থান মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাপনে স্বাধীনতা-পূর্ব ও উত্তর কালে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল। ততটা সহায়ক হয়নি আর এক ইন্দো-ইউরোপীয় চরিত্র দ্রৌপদীর জটিল যাপন দর্শাতে, তাঁর ক্ষেত্রে ‘সুগৃহিণী’, ‘রন্ধনপটিয়সী’ এইসব বিশেষণ মৈথিলী শরণ গুপ্ত থেকে মহাশ্বেতা দেবীর উপাদান সংগ্রহে উপযোগী হয়নি।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম
এই মহাভারত প্রসিদ্ধ আখ্যানের অভিনয় সুপ্রাচীন কাল থেকে শুধুমাত্র মৌখিক বা পরম্পরা ক্রমে হতো এমন ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। দেশজুড়ে এর পাঠবৈচিত্র্যকে ভিত্তি করে বঙ্গীয়, দেবনাগরী, মিশ্র দেবনাগরী, মৈথিল, কাশ্মীরীয় এবং দক্ষিণ-ভারতীয় বহু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও অনুলিপি প্রচলিত ছিল। স্বয়ং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৭১ সালে যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষার্থীদের জন্য রাঘবভট্টের টীকা সহ ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তল’ সম্পাদনা করলেন তখন বঙ্গীয় পাঠ, সংস্করণ ছেড়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় (দেবনাগরী) পাঠ গ্রহণ করেন কারণ বঙ্গীয় পাঠের তৃতীয় অঙ্কে শকুন্তলা খানিক প্রগলভা এবং অতিরিক্ত অংশ যুক্ত হওয়ায় দীর্ঘ।
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
বিশ্বসাহিত্যের ভ্রমণকাহিনির অন্যতম স্রষ্টা সুপণ্ডিত জর্জ ফর্স্টার উইলিয়াম জোন্সের ল্যাটিন অনুবাদের অনুসরণে ১৭৯১ সালে প্রথম ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলে’র জার্মান অনুবাদ করলেন। জার্মান পণ্ডিতদের অনুবাদে তিনি হয়ে উঠলেন ‘চাইল্ড অব নেচার’ —প্রকৃতির কন্যা। ফর্স্টার এই বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ছিলেন, কারণ মনুষ্য হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগ, অনুভূতি যে গাঙ্গেয় উপত্যকার কালো চামড়ার মানুষেরা এইভাবে ভাষায় প্রকাশে সক্ষম, তাও আবার তাঁদের কলম ধরার প্রায় হাজার, দেড় হাজার বছর আগে সেটা তাঁদের ধারণারও অতীত ছিল। জর্জ ফর্স্টার কৃত অনুবাদ যেমন মূল সাহিত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছিল তেমন নিশ্চয় এমন নাট্যাদর্শ সৃষ্টি করেছিল যা দেখে বিখ্যাত জার্মান মনীষী জন হার্ডার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, শকুন্তলার মতো সৃষ্টি পৃথিবীতে দু’হাজার বছরে একবার হয়। নিজের করা অনুবাদ ফর্স্টার পাঠিয়েছিলেন মহাকবি গ্যেয়টের কাছে। তিনি সেই নাটকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, “Wouldst thou the young year’s blossoms and the fruits of its decline,.. I name thee, O Sakoontala! and all at once is said.”
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন
“(সমালোচকের) আনন্দের অত্যুক্তি নহে, ইহা রসজ্ঞের বিচার”। এরই মধ্যে স্যর মনিয়র উইলিয়ামস্ ১৮৫৫ সালে দক্ষতার সঙ্গে নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করে নাম দিলেন, ‘শকুন্তলা অর দ্য লস্ট রিং’। অনুসরণ করলেন দেবনাগরী পাঠ ও পাণ্ডুলিপি। অত্যন্ত জনপ্রিয় সেই অনুবাদের মধ্যে দিয়ে তিনি দুটি কাজ করেছিলেন, প্রথমত ইউরোপের সঙ্গে প্রাচ্যের বিদ্যা, বুদ্ধির পরিচয় ঘটিয়েছিলেন, দ্বিতীয়ত উপমহাদেশের লোকজনের হৃত আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আত্মপ্রশংসায় বলেছিলেন, “…youthful English-speaking Indians—cultured young men educated at the Universities of Calcutta, Madras and Bombay – have acted the Sakoontala in the very words of my translations…”