মা সারদা।
উদ্বোধন শ্রীমার বাটি নামেও পরিচিত তা সকলেরই জানা আছে। এখানে যে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারি ভক্তেরা আছেন, তাঁরা সকলেই শ্রীমার কাছে সমান স্নেহের অধিকারী। তাঁদের সকলের খাওয়া পরার সুবিধা নিয়ে তিনি সর্বদা চিন্তায় থাকেন। উদ্বোধনের ডাক্তার মহারাজ পূর্ণানন্দজী কোন কোন দিন রাতে খাবার পঙক্তিতে সময় মতো আসতে না পারার জন্য কথা শোনেন।
একদিন তাঁর আসতে খুব বেশি দেরি হওয়ায় তাঁকে এর জন্য বেশি কথাও শুনতে হল। শ্রীমা তখন স্নেহের সঙ্গে তাঁকে আড়ালে ডেকে এর কারণ জানতে চান। তিনি শ্রীমার স্নেহ পেয়ে কেঁদে ফেলেন আর বলেন, ‘রাজা মহারাজ স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর আদেশ আছে যে রোজ জপের সংখ্যা ঠিক রেখে দশহাজার জপ করতে হবে। জপের সংখ্যা যদি ভুল হয় তবে প্রথম থেকে আবার জপ করতে হবে। নাহলে জপের ফল রাক্ষসে খেয়ে ফেলে’। শ্রীমা রাক্ষসে খেয়ে ফেলার কথা শুনে হেসে ওঠেন। তারপর বললেন, ‘বাবা, তোমরা ছেলেমানুষ, মন তোমাদের চঞ্চল, একাগ্রচিত্ত হয়ে জপ করার জন্যই রাখাল এমন কথা বলেছে। তা বাবা, আমি বলছি, খাবার ঘণ্টা বাজলেই তুমি ঠিক সময়ে এসে খাবে, জপের সংখ্যা পুরো না হলেও এতে দোষ হবে না’।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ
উদ্বোধনের মহিলা, পুরুষ কাজের লোক থেকে শুরু করে বামুনঠাকুর সকলেই শ্রীমার আপন সন্তান। সকলেই তাঁর স্নেহের সমান অধিকারী, সকলের জন্যই তাঁর একই রকম ভাবনা। চন্দ্রমোহন দত্ত অসহায় হয়ে কলকাতায় এসে অর্ধাহারে, অনাহারে কাজের সন্ধানে ঘুরছিলেন। তখন তিনি উদ্বোধনে ভাগ্যের জোরে কাজ পান। পূর্ববঙ্গের বাড়িতে তাঁর সংসার, আত্মীয়স্বজন আছে। সামান্য পারিশ্রমিকে তাদের ভরণপোষণ করতে হ্য়, কষ্টে দিন যায়। এখানে ক্রমশ তিনি শ্রীমার কৃপার অধিকারী হলেন। মা সারদার প্রয়োজন মতো কাজ করে দেন আর শ্রীমাও তাঁকে আদর করে পেটভরে ভাল ভাল প্রসাদ খাওয়ান। এইভাবে মা সারদার কৃপায় ক্রমে তাঁর সুদিন দেখা দিল। এখন উদ্বোধনে বই বিক্রি করে তাঁর অতিরিক্ত বেশ উপার্জন হয়। এমন সময় খবর আসে যে পদ্মার গ্রাসে তাঁর বাড়িঘর সব চলে গিয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাই না পেয়ে আত্মীয়রা সব পথে বসেছে।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৮: খলনায়িকার ধার্মিক পুত্র?
এই খবর পেয়ে চন্দ্রবাবুর মাথা ঘুরে গেল, কি করবেন ভেবে কোন কিনারা পেলেন না। আহার, নিদ্রা সব গেল। তাঁর তখন পাগল হবার জোগাড়। শ্রীমা তাঁর প্রিয় সন্তানের এই ভীষণ বিপর্যয়ের কথা জেনে খুব ব্যথা পেলেন। তিনি তিনশ টাকা জোগাড় করে গোপনে চন্দ্রবাবুকে দিয়ে স্নেহের সঙ্গে বললেন, ‘দেশে গিয়ে ওদের একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে এসো’। শ্রীমার আশীর্বাদে চন্দ্রমোহন যেন অকূলে দিশা পেলেন। তিনি দেশে গিয়ে নতুন জমি কিনে আত্মীয়দের আবার ঘরের ব্যবস্থা করলেন। স্বামী সারদেশানন্দ তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন যে শ্রীমার এইরকম অহৈতুকী কৃপার কথা পরে ভক্তিপূর্ণচিত্তে বাষ্পবিগলিত কণ্ঠে চন্দ্রমোহন বহুবার তাঁদের শুনিয়েছেন। যখন শ্রীমা উদ্বোধনে থাকতেন তখন তাঁর শারীরিক পরিশ্রমের অনেক লাঘব হত। এইখানে সংসারের দায়িত্বের ভার কম থাকায় তাঁর মন হালকা হত। এছাড়াও প্রিয় সন্তানদের খাওয়াদাওয়ার ভাল ব্যবস্থার জন্য তাদের সেবাযত্নের অভাব হত না।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
এখানকার স্বাস্থ্যকর জায়গা ও জলবায়ুর জন্য শ্রীমার শরীর বেশ ভালই থাকে। তবে জয়রামবাটিতে সব সুবিধা না থাকার জন্য সেখানে থাকার কষ্ট আছে। আবার সেখানে ম্যালেরিয়ায় ভুগে মা সারদার স্বাস্থ্যই ভাল থাকে না। তাই অল্পদিনেই শরীর কাহিল হয়ে পড়ে। সকল দেহধারী জীবের মতন শ্রীমার মন কিন্তু নিজের দেহের স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সর্বদা উদাসীন, লালায়িত নয়। কেবল সন্তানদের সুখসুবিধাই তাঁর কাছে একান্ত কাম্য। এইজন্য শ্রীমা দেশেই থাকতে চান। সেখানে থাকলে একদিকে যেমন বিদেশ থেকে আসা ছেলেদের দর্শনের সুবিধে হবে, অন্যদিকে শ্রীমাও তাঁর সন্তানদের মনের সুখে আদরযত্ন করার সুবিধা পাবেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম
স্বামী সারদেশানন্দ বলেছেন যে, আরও কয়েকটি কারণের জন্য শ্রীমা দেশের মাটিতে থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে বড় হয়েছেন। তাই শহরের বদ্ধ পরিবেশ তাঁর বেশিদিন ভাল লাগত না। উদ্বোধনে তাঁর ভক্তদের মনে তাঁর সেবা করার জন্য অধিক আগ্রহ থাকলেও তিনি সহজে কারো ওপর নিজের সম্পূর্ণ ভার চাপাতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি জানতেন যে তাঁর সঙ্গে থাকা ভাইজি আর ভাইয়ের বউদের ভার কারোর পক্ষে সবসময় সামলানো সহজ নয়। তার চেয়েও যেটা বড় ব্যাপার, তা হল শ্রীমার আদরের ভাইজি রাধু দেশেই থাকতে চাইত। আর মা সারদাও তাকে ছেড়ে থাকতে পারতেন না। রাধুকে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে উদ্বোধনে রাখার জন্য মহারাজও অনেক চেষ্টা করেছেন। সে যাতে তার স্বামীকে নিয়ে থাকতে পারে, তার জন্য একটা ঘরও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে রাধু থাকতে চাইত না। আর শ্রীমারও বেশিদিন থাকা হত না।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।