বৃহস্পতিবার ৭ নভেম্বর, ২০২৪


বীরচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ।

বীরচন্দ্র মাণিক্য হলেন রাজমালা অনুসারে ত্রিপুরার ১৮১তম রাজা। ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যভার গ্ৰহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজ্যাধিকার নিয়ে মামলা মোকদ্দমা কম হয় নি!বীরচন্দ্রের বড় ভাই পূর্বতন রাজা ঈশানচন্দ্র গুরুতর পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ১ অগস্ট মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে। রাজার মৃত্যুর তিনদিন পর ত্রিপুরার সমস্ত অফিস আদালতে পৌঁছে যায় একটি ‘রোবকারী’ বা রাজকীয় আদেশনামা। তাতে লেখা ছিল—বাতব্যাধিতে পীড়িত শারীরিক ভাবে কাতর মহারাজা ঈশানচন্দ্র যে কোনও সময়ে প্রাণ বিয়োগের আশঙ্কায় এবং সুষ্ঠু ভাবে রাজত্ব ও শাসনকার্য পরিচালনার স্বার্থে যুবরাজ পদে ভাই বীরচন্দ্র, বড় ঠাকুর পদে প্রথম পুত্র ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ও কর্তা পদে দ্বিতীয় পুত্র নবদ্বীপচন্দ্রকে নিযুক্ত করেছেন। এই রোবকারীর নকল ঢাকা ও চট্টগ্রামের কমিশনারের কাছেও পৌঁছে দেয়া হল। রাজধানী আগরতলাতেও তা প্রচার করা হল।

রাজার পর যুবরাজ হলেন সিংহাসনের প্রথম দাবিদার। তাই ঈশানচন্দ্রের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যাধিকারী হলেন ‘যুবরাজ’ বীরচন্দ্র। কিন্তু পাকাপোক্ত ভাবে তাঁর রাজত্বলাভ মোটেই মসৃণ ছিল না। বীরচন্দ্রের দুই ভাই চক্রধ্বজ ও নীলকৃষ্ণ এই রোবকারী ‘জাল’ অভিযোগ করে ইংরেজ সরকারের কাছে ত্রিপুরা রাজ্যের উপযুক্ত দাবিদার হিসেবে তদবির শুরু করলেন। বাংলার তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর তখন চট্টগ্রাম কমিশনারের সুপারিশ মতো বীরচন্দ্রকে ‘ডিফেক্টো রাজা’ হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে সিংহাসনের অন্যান্য দাবিদারদের আদালতে যাবার পরামর্শ দেন। এরপর শুরু হল মামলা-মোকদ্দমা। সে এক দীর্ঘ অধ্যায়।তবে শেষপর্যন্ত জয়ী হলেন বীরচন্দ্র। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ তাঁর আনুষ্ঠানিক অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত হল।
মহারাজা বীরচন্দ্র ছিলেন কবি, শিল্পী ও সংগীতজ্ঞ। সামগ্রিক ভাবে তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনস্ক রাজা। সে যুগের একজন বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা ছয়টি কাব্যগ্ৰন্হের কথা জানা যায়। তাঁর রাজসভায় খ্যাতনামা শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীদের আগমন ঘটতে থাকে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ত্রিপুরায় যেন তখন এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভগ্ন হৃদয়’ কাব্যগ্ৰন্থের জন্য প্রথম অভিনন্দন পেয়েছিলেন বীরচন্দ্রের কাছ থেকে। প্রিয়তমা রানি ভানুমতীর অকাল মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান বীরচন্দ্র। শোকাকুল হৃদয়ে রাজা তখন বিরহের কবিতা লিখে লিখে শোকভার লাঘবে সচেষ্ট। এমন সময়েই রাজার হাতে আসে তরুণ কবির ‘ভগ্ন হৃদয়’। বীরচন্দ্রের বিরহী অন্তরে নাড়া দেয় এই কাব্যগ্ৰন্হ। কবিকে অভিনন্দন জানানোর জন্য তখন মহারাজা তাঁর ব্যক্তিগত সচিবকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতা। স্বাভাবিক ভাবেই রাজার অভিনন্দন পেয়ে আপ্লুত তরুণ কবি।

এ প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে ‘জীবনস্মৃতি’তে কবি লিখেছেন—“…মনে আছে এই লেখা বাহির হইবার কিছুকাল পরে কলিকাতায় ত্রিপুরার স্বর্গীয় মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের মন্ত্রী আমার সহিত দেখা করিতে আসেন। কাব্যটি মহারাজের ভালো লাগিয়াছে এবং কবির সাহিত্য সাধনার সফলতা সম্বন্ধে তিনি উচ্চ আশা পোষণ করেন,কেবল এই কথাটি জানাইবার জন্যই তিনি তাঁহার অমাত্যকে পাঠাইয়া দিয়েছিলেন।” এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে আগরতলাতেও এক সম্বর্ধনা সভায় বীরচন্দ্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—“জীবনে যে যশ আমি পাচ্ছি, পৃথিবীর মধ্যে তিনিই তার প্রথম সূচনা করে দিয়েছিলেন তাঁর অভিনন্দনের দ্বারা। তিনি আমার অপরিণত আরম্ভের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েই তখনি আমাকে কবি সম্বোধনে সম্মানিত করেছিলেন।…” এখানে কবি নিজেই বলেছেন ত্রিপুরার এই রাজাই প্রথম তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, সম্মান জানিয়েছিলেন। তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই যেন এক ভুবনজয়ী সম্ভাবনার বীজ লক্ষ্য করেছিলেন বীরচন্দ্র।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৩: চোর-ডাকাতও যদি দান-ধ্যান করে, তবে লোকে ‘তাকে’-ও ভগবানের মতোই শ্রদ্ধা করে

‘ভগ্ন হৃদয়’-এর মাধ্যমে কবির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সম্পর্কের সূচনা হলেও ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হয় ‘রাজর্ষি’র ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের তাগিদে প্রেরিত চিঠির মাধ্যমেই। ‘রাজর্ষি’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’তে লিখেছেন যে, এই ‘স্বপ্নলব্ধ’ গল্পটিকে তিনি ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদান মিশিয়ে পুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। ত্রিপুরার রাজার কাছে সেই উদ্দেশ্যে চিঠি দিয়েছিলেন। এমনও হতে পারে যে,’ভগ্ন হৃদয়’-এর অভিনন্দন পরবর্তী সময়ে কবিকে ত্রিপুরা সম্পর্কে উৎসাহিত করেছিল।

উল্লেখ্য, ‘ভগ্ন হৃদয়’ কাব্যটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দে ধারাবাহিক ভাবে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় এটি। কিন্তু ‘ভগ্ন হৃদয়’ পর্বের আগেও ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের যোগাযোগ গড়ে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘রাজর্ষি’র ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের জন্য ১২৯৩ বঙ্গাব্দে মহারাজ বীরচন্দ্রকে যে পত্র দেন তাতে তিনি এই যোগাযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখেছিলেন—“আপনাদের রাজপরিবারের সহিত আমাদের পরিবারের পূর্ব হইতেই পরিচয় আছে এই রূপ শুনিতে পাই-সেই জন্য সাহসী হইয়া মহারাজকে পত্র লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আমাদের পূর্বকার সম্বন্ধ মহারাজের স্মরণে আসে এই আমার অভিপ্রায়।…” মহারাজও এই চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন—“…লিখিয়াছেন,আমাদের পরিবারের সহিত আপনাদের পরিবারের যে সম্বন্ধ ছিল তাহা স্মরণ করিয়া দেওয়াই আপনার উদ্দেশ্য। সে সুখের সম্বন্ধ আমি ভুলি নাই,আপনি পুণরায় তাহার গৌরব করিতে অগ্রসর হইয়াছেন, তজ্জন্য বিশেষ আপ্যায়িত ও বাধিত হইলাম।…”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

কিন্তু কি ভাবে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর যোগাযোগ ঘটেছিল সেদিন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে। বীরচন্দ্রের পিতা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তখন ত্রিপুরার রাজা। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে ইংরেজ সরকার থেকে খেলাত প্রাপ্ত হয়ে সিংহাসনে বসেন তিনি। ততদিনে সারা দেশে কায়েম হয়ে গিয়েছে ইংরেজ অধিকার। ত্রিপুরার রাজার দ্বৈত মর্যাদা। রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চল স্বাধীন, কিন্তু সমতল অঞ্চল অর্থাৎ চাকলা রোশনাবাদ ইংরেজ নিয়ন্ত্রণে। পার্বত্য অঞ্চলের জন্য ত্রিপুরার রাজা স্বাধীন হলেও সমতলের জন্য তিনি ইংরেজ অধীনস্থ একজন জমিদার।

সমতল ত্রিপুরায় মোগল আধিপত্যের সময় থেকেই অবশ্য এই ধারা চলে আসছিল। ইংরেজ আমলে সমতলে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়েছে। আর পার্বত্য অঞ্চলের স্বাধীন রাজা হলেও তাঁকে সিংহাসনে বসার জন্য খেলাত, সনদ আনতে হতো ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। দিতে হতো নজরানা। আবার কোনও কারণে যদি ইংরেজ সরকার রাজার উপর রুষ্ট হয় তবে তো রাজত্বও যেতে পারে! সেদিন বীরচন্দ্রের পিতা কৃষ্ণকিশোর এরকমই এক সংকটে পড়েছিলেন। ত্রিপুরায় উৎপাদিত বনজ সম্পদের উপর শুল্ক আদায়কে কেন্দ্র করে স্হানীয় ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণকিশোরের বিরোধ বাধে। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের কমিশনার স্বাধীন পার্বত্য ত্রিপুরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে বসেন এবং তা খাস দখল করার জন্য ঊর্ধ্বতন ইংরেজ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রার্থনা করেন। মহারাজা ও তাঁর ইংরেজ এজেন্ট এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। সম্ভবত রাজত্ব নিয়ে এই ঝামেলার সময়ই কৃষ্ণকিশোর কলকাতায় প্রিন্স দ্বারকানাথের সাহায্য প্রত্যাশী হয়েছিলেন। সেই সময় ইংরেজ রাজপুরুষ ও কলকাতা সমাজে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রচণ্ড প্রভাব। রাজা তখন দ্বারকানাথের সহায়তায় রাজনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পান।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ডেপুটি গভর্নর অক্ল্যান্ড বাহাদুর চট্টগ্রামের কমিশনারের জানিয়ে দেন যে রাজা তাঁর এলাকায় শুল্ক আদায় করতেই পারেন। এ বিষয়ে তাঁর পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কমিশনারকে লেখা হয়-The Raja has an independent hill territory, that your propositions for its resumption are totally inadmissible.

এ ভাবেই স্বীকৃত হয় পার্বত্য ত্রিপুরার স্বাধীনতা।চট্টগ্রামের কমিশনারের ত্রিপুরা অধিকারের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়। সম্ভবত এই এই সংকট ত্রাণে প্রিন্স দ্বারকানাথের সাহায্যের সূত্রেই সেদিন জোড়াসাঁকোর সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। ‘রাজর্ষি’র জন্য ঐতিহাসিক উপাদান চেয়ে মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সে জন্যই ‘পূর্ব পরিচয়ে’র কথা উল্লেখ করেছেন। রাজাও প্রত্যুত্তরে লিখেছেন—“সে সুখের সম্বন্ধ আমি ভুলি নাই…”।

যাইহোক,’রাজর্ষি’র জন্য ত্রিপুরার ঐতিহাসিক উপাদান চেয়ে রাজার কাছে পত্র দেয়ার পর বীরচন্দ্রের দরবার থেকে বিভিন্ন তথ্যাদি পাঠানো হয় কবির কাছে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উৎসাহ বাড়ে। প্রথম ‘বালক’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ‘রাজর্ষি’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১২৯৩ বঙ্গাব্দে গ্রন্হ হিসেবে প্রকাশিত হয় তা।’রাজর্ষি’র প্রথম সংস্করণের পরিশিষ্টে মহারাজা বীরচন্দ্র প্রেরিত গোবিন্দ মাণিক্যের ঐতিহাসিক বিবরণ সন্নিবিষ্ট রয়েছে।১২৯৭ বঙ্গাব্দে ‘রাজর্ষি’র প্রথম অংশ নিয়ে কবি রচনা করেন ‘বিসর্জন’ নাটক। ইতিমধ্যেই বীরচন্দ্রের সঙ্গে কবির সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠতার রূপ পায়।রাজা কলকাতা গেলেই যুবক রবীন্দ্রনাথকে কাছে ডেকে নিতেন।

কবিতা, সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো দুজনের মধ্যে। ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা বীরচন্দ্র যখন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে কার্শিয়াং সফরে যান তখন রবীন্দ্রনাথকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীরেও রাজা তখন কবির সঙ্গে রাত পর্যন্ত বৈষ্ণব সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করতেন। আলোচনা হতো চিত্রকলা,ফটোগ্রাফি ইত্যাদি নিয়েও। রাজা সে সময় লক্ষ টাকা ব্যয়ে বৈষ্ণব সাহিত্যের এক সামগ্রিক সংকলন প্রকাশ করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। বীরচন্দ্রের সান্নিধ্য সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় কিশোর সাহিত্য সমাজের সম্বর্ধনা সভায় বলেছিলেন—“মহারাজ বীরচন্দ্র অসাধারণ সঙ্গীত বিশারদ ছিলেন। তাঁর কাছে আমার মতো অনভিজ্ঞের গান গাওয়া যে কতদূর সঙ্কোচের ছিল তা সহজেই অনুমেয়। কেবলমাত্র তাঁর স্নেহের প্রশ্রয় আমাকে সাহস দিয়েছিল। তিনি যে আমার কাছে আবৃত্তি ও সঙ্গীত আলাপ শুনেই আমাকে রেহাই দিতেন তা নয়, তিনি তাঁর বিষয় কর্ম্মেও আমার শক্তিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন।…”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৩: প্রফুল্লময়ী— একটি বইয়ের লেখক এবং একটি জীবন ভরা ডিপ্রেশন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৭: যুগধর্মের সমর্থনহীন ধর্মচিন্তার স্থান কোথায়?

রাজা ও কবির মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল অনেক। কিন্তু প্রৌঢ় রাজার সঙ্গে যুবক কবির সখ্যতা হতে যে বিলম্ব হয়নি তা স্পষ্ট বোঝা যায় উপরোক্ত এই সব বিবরণ থেকে। তৎকালীন ত্রিপুরার ইতিহাসে বীরচন্দ্রের অতুলনীয় সাহিত্য প্রীতির অনেক দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। শুধু লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে বৈষ্ণব সাহিত্য প্রকাশের আগ্রহই নয়,লক্ষ টাকা দিয়ে একটি আলাদা ছাপাখানা কিনে তাতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সমূহের অলঙ্কৃত সংস্করণ ছাপানোরও চিন্তা করেছিলেন বীরচন্দ্র। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে কার্শিয়াং-এ রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার মহারাজা বীরচন্দ্রের সফর সঙ্গী হয়েছিলেন। প্রৌঢ় বয়সে শান্তিনিকেতনে ত্রিপুরার রাজার দেয়া ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি গ্রহণের সময় বীরচন্দ্র সম্পর্কে কবি আরও বলেছিলেন—“তাঁর একটি প্রস্তাব ছিল,লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি একটি স্বতন্ত্র ছাপাখানা কিনবেন এবং সেই ছাপাখানায় আমার কবিতার অলংকৃত সংস্করণ ছাপানো হবে। তখন তিনি ছিলেন কার্শিয়াং পাহাড়ে, বায়ু পরিবর্তনের জন্য। কলকাতায় ফিরে এসে অল্পকালের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।”

বীরচন্দ্রের সঙ্গে কবির কার্শিয়াং ভ্রমণ সম্পর্কে ত্রিপুরার রাজপুরুষ কর্ণেল মহিম চন্দ্র দেববর্মণ তাঁর ‘ত্রিপুর দরবারে রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বলেছেন—“আমরা যখন কলিকাতা হইতে ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারকল্পে রুগ্ন মহারাজ বীরচন্দ্রকে লইয়া কার্শিয়াং-এ গমন করি,তখন মহারাজ কবি রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করিয়া লইলেন। তখনকার কথা আমার বেশ স্মরণ আছে। রাত্রি প্রায় দশটা বাজিয়া যাইত,অবিশ্রাম ভাবে মহারাজ রবীন্দ্রনাথকে লইয়া সঙ্গীত ও কাব্য আলোচনায় মগ্ন থাকিতেন, বৈষ্ণব মহাজন পদাবলি প্রকাশ করিবার সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করিবার উপায় উদ্ভাবন করিতেন। আলোচনান্তে প্রতি রাত্রে মহারাজ উঠিয়া রবিবাবুকে সিঁড়ি পর্যন্ত আসিয়া বিদায় সম্ভাষণ করিতেন। মহারাজ বীরচন্দ্র অসুস্থ, অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করিয়া হাস্য মুখেই তিনি আলোচনায় যোগ দিতেন, এ কথা রবিবাবু জানিতেন। তিনি একদিন, মহারাজ অনর্থক কেন কষ্ট করিয়া সিঁড়ি পর্যন্ত তাঁহাকে আগুয়াইয়া দেন এরূপ অনুযোগ করিলেন।তখন বীরচন্দ্র বলিয়াছিলেন—“রবিবাবু, পাছে অলসতা আসিয়া কর্তব্যে ত্রুটি ঘটায়,আমি সে ভয় করি,আপনি আমাকে বাধা দিবেন না।’ পিতৃতুল্য বীরচন্দ্রের এরূপ ব্যবহার দর্শন এবং উত্তর শ্রবণ করিয়া রবিবাবু বলিতেন-আমি অভিজাত বংশের মহিমার পরিচয় পাইয়া ধন্য হইলাম।”

মহারাজা বীরচন্দ্র যেমন এক বড়ো মাপের বৈষ্ণব কবি ছিলেন, তেমনই সাহিত্য সংস্কৃতিরও এক অনন্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের সুবিখ্যাত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্হের যাবতীয় মুদ্রণ ব্যয় ভার রাজা বহন করেছিলেন। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে (১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ) কলকাতায় মহারাজা বীরচন্দ্র পরলোক গমন করেন।—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content