(বাঁদিকে) গোলিয়াথ বকের পদচারণা। (মাঝখানে) হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে গোলিয়াথ বক। (ডান দিকে) বাসা বানানোর উপকরণ নিয়ে উড়ন্ত গোলিয়াথ বক। ছবি: সংগৃহীত।
এই লেখার শুরুতে হিব্রু বাইবেল-এর একটি খন্ড ‘বুক অফ স্যামুয়েল’ এর একটি কাহিনি উদ্ধৃত করি। এলা উপত্যকায় প্রাচীন ইসরাইলের সম্রাট সাউল এবং ফিলিস্তিনিরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ। ৪০ দিন ধরে যুদ্ধ চলছে সকাল এবং সন্ধ্যায়। ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার একজন দৈত্যাকার যোদ্ধা তাদের সীমানার কাছে এগিয়ে এসে তার সাথে একক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ইসরাইলিদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। তাতেই দুই শাসকের মধ্যে জয় ও পরাজয় নির্ধারিত হবে বলে সেই যোদ্ধা ঘোষণা করছে। ওই যোদ্ধার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছেন সম্রাট সাউল।
এই সময় ইসরাইলিদের মধ্যে থেকে এক যুবক সাহস করে এগিয়ে এসে সম্রাট সাউলের কাছে একক যুদ্ধে তাকে অবতীর্ণ হতে দেওয়ার অনুমতি চাইল। অনেক আবেদনের পর সম্রাট সাউল নিমরাজি হলেন। তখন যুবকটি একটা লাঠি, একটা গুলতি আর পাঁচটা পাথরের টুকরো নিয়ে প্রতিপক্ষ যোদ্ধার দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিপক্ষের দৈত্যাকার যোদ্ধাও এগিয়ে এল বর্ম পরে ও হাতে বর্শা নিয়ে। সম্রাট সাউল যুবকটিকে তার নিজের বর্ম ও শিরস্ত্রাণ দিতে চাইলেন কিন্তু যুবকটি কিছুতেই তা নেবে না। যুদ্ধে যুবকটি তার গুলতিতে একটি পাথর নিয়ে দৈত্যাকার ফিলিস্তিনি যোদ্ধার কপালের মাঝখানে আঘাত করল। যোদ্ধাটি মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। আর তখন ইসরাইলি যুবকটি সেই দৈত্যাকার যোদ্ধার মুন্ডু কেটে নিল এবং কাটা মুণ্ডু নিয়ে জেরুজালেম ফিরে গেল। ইজরায়েলি যুবকটির নাম হল ডেভিড এবং ফিলিস্তিনি দৈত্যাকার যোদ্ধার নাম হল গোলিয়াথ।
এই সময় ইসরাইলিদের মধ্যে থেকে এক যুবক সাহস করে এগিয়ে এসে সম্রাট সাউলের কাছে একক যুদ্ধে তাকে অবতীর্ণ হতে দেওয়ার অনুমতি চাইল। অনেক আবেদনের পর সম্রাট সাউল নিমরাজি হলেন। তখন যুবকটি একটা লাঠি, একটা গুলতি আর পাঁচটা পাথরের টুকরো নিয়ে প্রতিপক্ষ যোদ্ধার দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিপক্ষের দৈত্যাকার যোদ্ধাও এগিয়ে এল বর্ম পরে ও হাতে বর্শা নিয়ে। সম্রাট সাউল যুবকটিকে তার নিজের বর্ম ও শিরস্ত্রাণ দিতে চাইলেন কিন্তু যুবকটি কিছুতেই তা নেবে না। যুদ্ধে যুবকটি তার গুলতিতে একটি পাথর নিয়ে দৈত্যাকার ফিলিস্তিনি যোদ্ধার কপালের মাঝখানে আঘাত করল। যোদ্ধাটি মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। আর তখন ইসরাইলি যুবকটি সেই দৈত্যাকার যোদ্ধার মুন্ডু কেটে নিল এবং কাটা মুণ্ডু নিয়ে জেরুজালেম ফিরে গেল। ইজরায়েলি যুবকটির নাম হল ডেভিড এবং ফিলিস্তিনি দৈত্যাকার যোদ্ধার নাম হল গোলিয়াথ।
গল্পটি বলার কারণ এ বার বলি। সুন্দরবন অঞ্চলে এক বিরল প্রজাতির বকের উপস্থিতি মাঝে মাঝেই পক্ষীপ্রেমীদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে যে নেই তা নিশ্চিত, কিন্তু কিছুদিন আগেও পক্ষী গবেষকদের ক্যামেরায় ওই বক সুন্দরবনের খাঁড়ির কাছে ধরা পড়েছে। বকদের পরিবারে এই বকটি হল দৈত্যাকার প্রজাতির বক। হিব্রু বাইবেলের কাহিনিতে বর্ণিত দৈত্যাকার যোদ্ধা গোলিয়াথের মতো এই বকও বক-পরিবারে সবচেয়ে বড় আকারের সদস্য। তাই এই বকের নাম হল গোলিয়াথ বক (Goliath heron), আর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল ‘Ardea goliath’। এদের উচ্চতা হয় ৩ ফুট ১১ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত, আর ডানা মেললে তার বিস্তার হয় ৬ ফুট ১ ইঞ্চি থেকে ৭ ফুট ৭ ইঞ্চি। এদের ওজন হয় ৪ থেকে ৫ কেজি। এখন কেন এর নাম গোলিয়াথ রাখা হয়েছে তা নিশ্চয়ই সহজে অনুমেয়। বাংলাতে এই বককে অনেকেই দৈত্য বক বা মহাকায় বক বলে। তবে যেহেতু বকটি সুন্দরবনের জনবসতি এলাকায় দেখা যায় না এবং জঙ্গল এলাকাতেও কদাচিৎ দেখা যায় তাই প্রচলিত কোনও বাংলা নাম এর নেই।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ
মহাকায় বকের রং ধূসর বাদামি, তবে লম্বা গলার নিচের দিকে সাদা ও কালো পালকের সারিবদ্ধ বিন্যাস দেখা যায়। মাথার চাঁদির ওপরে গাঢ় বাদামি রঙের লম্বাটে পালক ঝুঁটি তৈরি করেছে, যদিও ঝুঁটি খাড়া হয়ে থাকে না। কালো সূচালো চঞ্চুর ও চোখের নিচে অংশ সাদা। মাথা থেকে পুরো ঘাড়ের পিছন দিক লালচে বাদামি। পিঠের পালকের রং ধূসর তবে পায়ের পালক লালচে বাদামি। ডানা তুললে দেখা যায় দেহের দু’পাশের পালকও লালচে বাদামি। ডানার ওপর ও নিচের রঙ ধূসর। লেজের পালকও ধূসর। সব মিলিয়ে মহাকায় বকের বর্ণবিন্যাস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দুটো ধূসর রঙের পা হয় অনেকটা লম্বা। এর ফলে অনেকটা গভীর জলেও এরা স্বচ্ছন্দে দাঁড়াতে পারে। স্ত্রী মহাকায় বক পুরুষ বকের থেকে আকারে সামান্য ছোট হয়। বাচ্চাদের রঙও হয় লালচে বাদামি। তবে ডোরা দাগের সংখ্যা থাকে কম।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ
যেহেতু সুন্দরবন অঞ্চলে মহাকায় বক দেখা যায় খুব কম পরিমাণে তাই এদের প্রজনন ও স্বভাব সম্বন্ধে পর্যবেক্ষিত তথ্যের পরিমাণও যথেষ্ট কম। পৃথিবীর অন্যান্য অংশে প্রাপ্ত মহাকায় বকদের স্বভাব পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে প্রজনন ঋতুতে এদের পালক অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল বর্ণের হয়। এই সময় স্ত্রী ও পুরুষ বিভিন্ন ধরনের শব্দ করে পরস্পরকে জানান দেয়। তবে একটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ মহাকায় বক বছরের পর বছর ধরে জুটি বেঁধে প্রজনন করে, অর্থাৎ যৌনসঙ্গী পরিবর্তন করে না। সাধারণত বর্ষাকালে প্রজনন হয়। স্ত্রী ও পুরুষ মিলে শুকনো কাঠ কুটো দিয়ে বাসা বানায়। বাসার ব্যাস প্রায় এক মিটার। ঘন ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে ৩ মিটার উচ্চতার মধ্যে এরা বাসা তৈরি করে। এরা সাধারণত একই জায়গায় প্রতি বছর বাসা বানায়। তবে দ্বীপভূমি যখন মানুষের দখলে চলে আসে কিংবা মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে যায় তখন এরা সেই প্রজননস্থল ছেড়ে চলে যায়। এই স্বভাবের কারণেই মনে হয় সুন্দরবনের বেশিরভাগ অংশ থেকে মহাকায় বকেরা চলে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৭: নকল বুধন মাহাতো
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
স্ত্রী মহাকায় বক একসাথে ২ থেকে ৫টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে মিলে ডিমে তা দেয়। ২৪ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। তবে দেখা গেছে একটি বা দুটি বাচ্চা শেষ পর্যন্ত বাঁচে। আসলে জন্মের পর বাসার বাচ্চাদের মধ্যে লড়াই হয়। আর এই লড়াইতে সবগুলো বাচ্চার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। বাসায় বাচ্চাদের মধ্যে এই লড়াই অবশ্য আরও বহু পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়। জন্মের সময় বাচ্চাদের চোখ ফোটে না। ফলে মা ও বাবা মহাকায় বককে বাচ্চাদের অতিরিক্ত যত্ন নিতে হয়। মা ও বাবা মহাকায় বক প্রায় পাঁচ সপ্তাহ ধরে বাচ্চাদের দিনে দুবার উগরে দেওয়া খাবার খাওয়ায়। তারপর বাচ্চারা বাসা ছেড়ে মা-বাবার সাথে ঘোরে ও খাবার সংগ্রহ করতে শেখে। ৪০ থেকে ৮০ দিন এরা বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকে। মহাকায় বকেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে সর্বাধিক ১৫ বছর বাঁচে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
মহাকায় বকেরা পরিযায়ী পাখি নয়, তবে খাদ্যাভাব দেখা দিলে অন্যত্র যেতে পারে। যখন প্রজনন ঋতু নয় তখন এরা একা একাই ঘোরাফেরা করে। পক্ষীবিজ্ঞানীদের মতে, মহাকায় বকদের মধ্যে অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম বেশি হওয়ার দরুন এদের সংখ্যা বেশি হয় না। এরা নিশাচর বক। রাতেই এরা খাদ্য সংগ্রহ করতে পছন্দ করে। খাদ্য সংগ্রহের বেশিরভাগ সময়টাই এরা জলে দাঁড়িয়ে থেকে শিকার কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করে। যখন এরা উড়ে যায় তখন খুব ধীরে ডানায় ঝাপট দেয় যাতে মহাকায় বকের শত্রু বা শিকারী প্রাণী না টের পায়।
(বাঁদিকে) গোলিয়াথ বক। (মাঝখানে) সুন্দরবনের জঙ্গলে পলায়নরত গোলিয়াথ বক। (ডান দিকে) শিকার মুখে গোলিয়াথ বক। ছবি: সংগৃহীত।
মহাকায় বক সাধারণত বড় আকারের মাছ খায়। এ জন্য তারা একরকম চালাকি করে। যখন ছোটখাটো মাছেরা কাছাকাছি আসে এরা তাদের ধরার চেষ্টা করে না, ফলে ছোটখাটো মাছেরা নিশ্চিন্তে মহাকায় বকের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। তারপর যখন কোনও বড় মাছ ছোট মাছদের পিছু পিছু চলে আসে তখন তাকে শিকার করে। তাছাড়া এরা যখন উড়ে এসে জলে নামে তখন সরাসরি জলের ওপর না নেমে কাছাকাছি জলজ ঘাসের জঙ্গলের ওপর নামে যাতে জলে কোনও শব্দ বা ঢেউ তৈরি না হয়। তাছাড়া জলাভূমিতে ঘাসের মধ্যে খাদ্যের লোভে অনেক মাছের আনাগোনা থাকে। ফলে মহাকায় বকের মাছ শিকার করতে সুবিধাও হয়।
মহাকায় বক নদী, হ্রদ, খাঁড়ি ও মোহনা সংলগ্ন অঞ্চলে যেখানে অগভীর মিষ্টি জলের বা নোনা জলের জলাভূমি রয়েছে সেখানে দেখা যায়। আর অবশ্যই সেই সব জলাভূমিতে বড় আকারের মাছ থাকা দরকার। সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ মিশর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে মহাকায় বক দেখা যায়।
বক পরিবারের এই বৃহত্তম সদস্যটি IUCN তালিকায় least concern হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় এদের সংখ্যা খুবই কমে গিয়েছে এবং বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কোনও জায়গায় এখন দেখা যায়। কোনও দেশে এই প্রজাতিটিকে সংরক্ষণ করার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দিন দিন এদের সংখ্যা কমছে এবং একটি বসতি থেকে আরেকটি বসতির মধ্যে দূরত্ব দিনে দিনে বাড়ছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে মহাকায় বক অবলুপ্ত হয়ে গেলে আশ্চর্য হবো না।—চলবে।
মহাকায় বক নদী, হ্রদ, খাঁড়ি ও মোহনা সংলগ্ন অঞ্চলে যেখানে অগভীর মিষ্টি জলের বা নোনা জলের জলাভূমি রয়েছে সেখানে দেখা যায়। আর অবশ্যই সেই সব জলাভূমিতে বড় আকারের মাছ থাকা দরকার। সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ মিশর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে মহাকায় বক দেখা যায়।
বক পরিবারের এই বৃহত্তম সদস্যটি IUCN তালিকায় least concern হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় এদের সংখ্যা খুবই কমে গিয়েছে এবং বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কোনও জায়গায় এখন দেখা যায়। কোনও দেশে এই প্রজাতিটিকে সংরক্ষণ করার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দিন দিন এদের সংখ্যা কমছে এবং একটি বসতি থেকে আরেকটি বসতির মধ্যে দূরত্ব দিনে দিনে বাড়ছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে মহাকায় বক অবলুপ্ত হয়ে গেলে আশ্চর্য হবো না।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।