ছবি : প্রতীকী।
রাধাকিশোরের পর সিংহাসনে বসেন পুত্র বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য। তিনিও রাজকার্যে বাংলার ব্যবহার অব্যাহত রাখেন। রাজকার্যে ইংরেজির প্রবাহ ঠেকাতে বীরেন্দ্র কিশোরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে এ ব্যাপারে আদেশনামা জারি হয়েছিল।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রী বাহাদুর মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্র কিশোর অফিস আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার সম্পর্কে এক সার্কুলারে জানান—
“এ রাজ্যের অফিস ও আদালত সমূহের প্রচলিত ভাষা বাঙ্গালা এবং সর্ব্ববিধ রাজকার্য্যে আবহমানকাল হইতে বাঙ্গালা ভাষা ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে।এই নিয়ম অক্ষুন্ন রাখা স্বর্গীয় মহারাজ বাহাদুরগণের অভিপ্রেত ছিল। এই অভিপ্রায় সংসাধনোদ্দেশ্যে প্রাতঃস্মরণীয় স্বর্গীয় মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য ১২৮৪ ত্রিপুরাব্দে ‘নিষ্পত্তি পত্রাদি লিখিবার আইন’ শীর্ষক এক বিধি প্রচার করিয়াছিলেন, বর্ত্তমান সময়েও তাহা প্রচলিত ও প্রবল আছে।পরমপূজ্য স্বর্গীয় মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যবাহাদুর লিখিত এবং বাচনিক রূপে এ বিষয়ে স্বীয় অভিমত বারম্বার কর্ম্মচারীদিগকে জানাইয়াছেন। তাঁহাদের এই কল্যাণকর মহাদিভিপ্রায় সসম্মানে প্রতিপালন করা রাজকর্ম্মচারী মাত্রেরই কর্ত্তব্য। কিন্তু অধুনা কোন কোন স্হলে তাহার বৈলক্ষণ্য ঘটিতে দেখা যাইতেছে। সর্ব্ববিধ রাজকার্য্যে বাঙ্গালা ভাষার প্রয়োগ এবং তদুপলক্ষে ভাষার উৎকর্ষ বিধান করা শ্রী শ্রী যুত মহারাজ মাণিক্য বাহাদুরের একান্ত অভিপ্রেত।অতএব পলিটিক্যাল বিভাগ সংসৃষ্ট বিষয় বা বিশেষ প্রয়োজনীয় স্হল ভিন্ন,আদালত ও অফিস সমূহের কাগজপত্রে বাঙ্গালা ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষা ব্যবহার করা সঙ্গত হইবে না।”
“এ রাজ্যের অফিস ও আদালত সমূহের প্রচলিত ভাষা বাঙ্গালা এবং সর্ব্ববিধ রাজকার্য্যে আবহমানকাল হইতে বাঙ্গালা ভাষা ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে।এই নিয়ম অক্ষুন্ন রাখা স্বর্গীয় মহারাজ বাহাদুরগণের অভিপ্রেত ছিল। এই অভিপ্রায় সংসাধনোদ্দেশ্যে প্রাতঃস্মরণীয় স্বর্গীয় মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য ১২৮৪ ত্রিপুরাব্দে ‘নিষ্পত্তি পত্রাদি লিখিবার আইন’ শীর্ষক এক বিধি প্রচার করিয়াছিলেন, বর্ত্তমান সময়েও তাহা প্রচলিত ও প্রবল আছে।পরমপূজ্য স্বর্গীয় মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যবাহাদুর লিখিত এবং বাচনিক রূপে এ বিষয়ে স্বীয় অভিমত বারম্বার কর্ম্মচারীদিগকে জানাইয়াছেন। তাঁহাদের এই কল্যাণকর মহাদিভিপ্রায় সসম্মানে প্রতিপালন করা রাজকর্ম্মচারী মাত্রেরই কর্ত্তব্য। কিন্তু অধুনা কোন কোন স্হলে তাহার বৈলক্ষণ্য ঘটিতে দেখা যাইতেছে। সর্ব্ববিধ রাজকার্য্যে বাঙ্গালা ভাষার প্রয়োগ এবং তদুপলক্ষে ভাষার উৎকর্ষ বিধান করা শ্রী শ্রী যুত মহারাজ মাণিক্য বাহাদুরের একান্ত অভিপ্রেত।অতএব পলিটিক্যাল বিভাগ সংসৃষ্ট বিষয় বা বিশেষ প্রয়োজনীয় স্হল ভিন্ন,আদালত ও অফিস সমূহের কাগজপত্রে বাঙ্গালা ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষা ব্যবহার করা সঙ্গত হইবে না।”
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৩: বীরচন্দ্রের রাজকার্যে বাংলা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
উল্লিখিত আদেশপত্রাদি থেকে এটা বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয় না যে, ত্রিপুরার রাজকার্যে বাংলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং ইংরেজির বেগবান প্রবাহ ঠেকাতে রাজাগণ কতটা উদ্যোগী ছিলেন। সেই সুদূর অতীত থেকেই ত্রিপুরায় রাজকার্যের মাধ্যম বাংলা। পরবর্তী সময়েও এই ধারা অব্যাহত ছিল।অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে রাজকার্যে বাংলা ব্যবহার প্রসঙ্গে আইন হয়েছে।মহারাজ রাধাকিশোরের রাজত্বকালে প্রশাসনে অহেতুক ইংরেজি ব্যবহারের বিরুদ্ধে রাজকর্মচারীরা সতর্কিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৫: সাফল্য কি বংশগত উত্তরাধিকার? না কি ব্যক্তিগত কৃতিত্বের প্রমাণ?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৮: লক্ষ্মীস্বরূপিনী মা সারদা
বীরেন্দ্র কিশোরের পর ১৯২৩ সালে রাজা হলেন পুত্র বীরবিক্রম।পূর্ব পুরুষদের মতো তিনিও বাংলার পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। তাঁর রাজত্বকালে রাজকার্যে ব্যবহৃত বাংলা আরও উন্নত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। বীরবিক্রমের রাজ্যভার অধিগ্রহণ সংক্রান্ত দলিলের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে—”যেহেতু গত ২৮শে শ্রাবণ অপরাহ্ন ১ ঘটিকার সময় পিতৃদেব মহারাজ বীঁরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য বাহাদুর পরলোক গমন করিয়াছেন;আমি খান্দানের রীতি এবং এই রাজবংশের চিরপ্রসিদ্ধ কুলাচার মতে পিতৃদেবের মৃত্যুর পর হইতে তৎত্যজ্য রাজগী ত্রিপুরা এবং জমিদারী চাকলে রোশনাবাদ ও অন্যান্য সমস্ত সম্পত্তির মালিক দখলদার হইয়াছি। এই ক্ষণ হইতে রাজগী ও জমিদারী সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য্য সম্পূর্ণরূপে আমার পক্ষে পরিচালিত হইবে।…”
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক
১৯৪৭ সালের ১৭ মে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে বীরবিক্রমের মৃত্যু ঘটে।মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে তিনি ত্রিপুরার ভারতভুক্তির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরার ভারতভুক্তি ঘটে। এ উপলক্ষে এদিন ত্রিপুরার প্রজাবৃন্দের উদ্দেশ্যে রিজেন্ট মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবীর এক বাণী প্রচারিত হয়েছিল। এই বাণীই ত্রিপুরার রাজ আমলে সরকারি কাজে ব্যবহৃত বাংলার সর্বশেষ নিদর্শন। এখানে তার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করা হচ্ছে—”…ত্রিপুরার ইতিহাস অতীত গৌরবে সমুজ্জ্বল।আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা ত্রিপুরার সেই গৌরব ভবিষ্যতেও অম্লান রাখিতে পারিবেন। ত্রিপুরা আজ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হইল। এখন হইতে স্বাধীন ভারতের নাগরিক রূপে ত্রিপুরার তথা ভারতের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন আপনাদের লক্ষ্য হইবে।ভবিষ্যতে ভারতের সংগঠনে আপনাদের অবদান নগণ্য হইবে না এবং স্বীয় কর্ত্তব্য সুষ্ঠুরূপে পালন করিয়া অদূর ভবিষ্যতে আপনারাও বৃহত্তর সমৃদ্ধির উত্তরাধিকারী হইবেন,ইহাই আমার একান্ত বিশ্বাস।…”
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৩: বীরচন্দ্রের রাজকার্যে বাংলা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
ত্রিপুরার ভারতভুক্তির মাধ্যমে অবসান ঘটে সুদীর্ঘকাল ব্যাপী মাণিক্য রাজবংশের শাসনের। তারপর থেকে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। কিন্তু পিছনে পড়ে থাকা দীর্ঘ ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকে মাণিক্য রাজবংশের বাংলার পৃষ্ঠপোষকতা সহ রাজকার্যে নিরবচ্ছিন্ন বাংলা ব্যবহারের কথা। ঐতিহাসিক যুগের সূচনালগ্ন থেকেই ত্রিপুরার রাজকার্যে, যেমন সনদ, শিলালিপি, তাম্রলিপিতে বাংলা লিপির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী সময়ের দলিল দস্তাবেজ ও পত্রাদিতেও বাংলা ভাষা।সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমে ক্রমে এই ভাষা উন্নত রূপ নিয়েছে। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে যখন চারদিকে ইংরেজির বেগবান প্রবাহ, ত্রিপুরাতেও রাজকর্মচারীদের মধ্যে ইংরেজি মুখী প্রবণতা, ত্রিপুরার রাজাগণ তখনও দেশী ভাষা হিসেবে পরম মমতায় বাংলাকেই তুলে ধরেছেন। রাজকার্যে বাংলা ব্যবহারের জন্য বারংবার রাজাদেশ প্রচার করেছেন।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।