ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
গল্প শোনার আগ্রহ মানুষের চিরকালীন প্রবণতা। কেন ভালো লাগে? অবসরের বিনোদন হল গল্প, অনেককিছু জানা যায় বৈকী! কোথায় গল্প হচ্ছে না? রাস্তায়, বাড়িতে, বাসে, ট্রেনে, বাজারে, চায়ের আড্ডায় কিংবা কেজি থেকে পিজির ক্লাসে, হোটেল থেকে হোস্টেলে, বোর্ড মিটিং থেকে রাজনীতির ময়দানে কল্পনা জল্পনা মিশিয়ে যে সংলাপধর্মী বার্তালাপ চলে, তাকে ভালো কথায় আড্ডা, আলাপচারিতা বলা যায়।
তবে আড্ডার যেমন ভালো-মন্দ আছে, তেমনই গল্পের-ও। নিচু শ্রেণীর পপুলার জল্পনামূলক লঘুরসের গল্প হল গসিপ, পিএনপিসি। খুব উঁচুদরের হলে তাতে আদেশ-উপদেশ মেশে, রসগাম্ভীর্য আসে। সকলেই গল্প খোঁজে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট এখন স্টোরি। সিনেমার স্টোরিলাইন জনমোহিনী না হলে হল ভরে না। আর দৈনিক মেগাসোপের গল্পের ফেনায় ফেনিল জনগণের যুগ যুগ ধরে “একটা গল্প বলো না” দিয়েই নিদ্রার আয়োজন। যুগের তালে তালে গল্পের মাধ্যম বদলে গেছে, চরিত্রের আচার, আচরণ, যুক্তিবোধে বদল এসেছে। তবে তিল থেকে তালে না উঠলে, প্রতি বাঁকে বাঁকে হাড় হিম করা সাসপেন্স না হলে গল্পগুলো বুঝি বাস্তব হয়ে যায়। যতোই সমাজদর্পণ হোক না কেন, বাস্তবের ডালভাত পান্তাভাতের গল্প দেখাশোনার দর্শক-শ্রোতা কম।
আরও পড়ুন:
বাংলা বুকের ভিতরে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি
এছাড়াও মূলের অবলম্বন, সত্য কাহিনী কিংবা ফ্যান ফিকশন আছে। সব মিলিয়ে গল্পের জগতের কল্পবৃক্ষে গরুর বৃক্ষারূঢ় হওয়ার ব্যবস্থা পাকা থাকেই। তবে তা যুক্তির পথে হলে রিয়ালিস্টিক, বিপরীত হলে রূপকথার মতো। দর্শক, শ্রোতা দুটোই চায়। চায় আনন্দ, যাকে বিনোদন বলে।
গল্প থেকে শিক্ষা নিতে চায় কেউ? কথামালা-নীতিমালা-কথামৃত আছে তো। কথাসরিত্সাগর, পঞ্চতন্ত্র, বেতালের গল্প কিংবা জাতকমালা, ঈশপের গল্পে তো সেটাই উদ্দেশ্য। লোকশিক্ষা। অথচ, “জ্ঞান দেবেন না তো” বলা হয়ে ওঠে না, কেন? কারণ শুক্তানিতে ঝাল কিংবা অম্বলেতে ঘি না দিয়ে মনোরম, অনায়াসপাচ্য, স্বাস্থ্যকর খাদ্যে পুষ্টি আটকাবে কে? তাই তো যুগ যুগের পরেও ঠাকুরদা ঠাকুরমার ঝুলি উপচে পড়ে, বেতাল এখনও রাজার পিঠে চড়ে গল্প শোনায়, জঙ্গলে সিংহরাজা, মন্ত্রী বাঘ কিংবা চতুর শেয়ালের কাজ কমে না, রাজপুত্তুর এখনও টগবগিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে আসে যায়।
গল্প থেকে শিক্ষা নিতে চায় কেউ? কথামালা-নীতিমালা-কথামৃত আছে তো। কথাসরিত্সাগর, পঞ্চতন্ত্র, বেতালের গল্প কিংবা জাতকমালা, ঈশপের গল্পে তো সেটাই উদ্দেশ্য। লোকশিক্ষা। অথচ, “জ্ঞান দেবেন না তো” বলা হয়ে ওঠে না, কেন? কারণ শুক্তানিতে ঝাল কিংবা অম্বলেতে ঘি না দিয়ে মনোরম, অনায়াসপাচ্য, স্বাস্থ্যকর খাদ্যে পুষ্টি আটকাবে কে? তাই তো যুগ যুগের পরেও ঠাকুরদা ঠাকুরমার ঝুলি উপচে পড়ে, বেতাল এখনও রাজার পিঠে চড়ে গল্প শোনায়, জঙ্গলে সিংহরাজা, মন্ত্রী বাঘ কিংবা চতুর শেয়ালের কাজ কমে না, রাজপুত্তুর এখনও টগবগিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে আসে যায়।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
আজ তেমনই একটা গল্প জাতকমালা থেকে। রাজার হাতিশালায় এক সুশীল মঙ্গলহস্তী ছিল। রাজার হাতি বলে কথা! আদব কায়দা-জানা, ভদ্র, নম্র তো হতেই হয়। বোধিসত্ত্ব সেই জন্মে রাজার জনৈক বিচক্ষণ অমাত্য ছিলেন। তো, সেই হাতিশালায় রাতে চোরের দল আসে আর কীভাবে চুরি করবে তাই নিয়ে শলাপরামর্শ করে। চুরিটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কীনা জানা নেই, তাছাড়া হাতিশালায় চোরেরা কি হাতি চুরি করতো? কে জানে! শোনা যায়, মরা হাতি লাখ টাকা, কিন্তু এ যে জ্যান্ত হাতি, তাছাড়া সুকুমারের ষষ্ঠীচরণ-ই যা হাতি নিয়ে লোফালুফি করতো, হাতির সঙ্গে হাতাহাতি কে-ই বা চায়!
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
মুভি রিভিউ: স্ত্রী-২ ছবিতে স্কন্দকাটা দৈত্য আক্রমণ করছে আধুনিক নারীদের
এও শোনা যায়, হাতি অতি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান প্রাণী। কিন্তু সেবার হল কী, চোরেদের ওই সব কথায় হাতির মাথা ঘুরে গেল। চোরেরা আসে, পরপর কয়েকদিন তারা হাতিশালার বাইরে বসে সিঁদের প্রকৃতি, চুরির পরের কর্তব্য নিয়ে কথা বলে। তাছাড়া সামনে মানুষ চলে এসে হত্যায় যেন হাত না কাঁপে, চোরের ভদ্রতা থাকতে নেই, হতে হবে নিষ্ঠুর, নির্দয় হয়ে আঘাত হানতে হবে এইসব। হাতি শোনে আর ভাবে। শেষে তার মনে হল এসব কথা তাকেই বলছে এরা। অতয়েব, যেমন ভাবা তেমন কাজ। মাহুতকে হাতের কাছে পেয়ে আছড়ে মেরেই ফেলল। তাকে নিষ্ঠুর, নির্দয়, সংহারক হতে হবে যে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৩: আধুনিকতার নিরিখে দ্রৌপদী ও অর্জুন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
ক্রমে ক্রমে উন্মত্ত হয়ে সে যাকে পায় তাকেই মারে। রাজা একথা শুনে তাঁর সেই অমাত্যকে তদন্তে পাঠালেন। তিনি দেখলেন হাতি ভালোই সুস্থ। ক্রমে জানলেন, বুঝলেন রাতের ঘটনাক্রম। তখন শীলবান, সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণ-শ্রমণদের হাতিশালায় বসিয়ে শীলব্রতের মাহাত্ম্য শোনানো হতে লাগল হাতিকে, দিনরাত। শান্তি, ক্ষান্তি, মৈত্রীর গুণাবলী শুনে শুনে হাতি আবার ভদ্র সংযত হয়ে গেল। গল্পটা এখানেই শেষ করা যায়। সত্সঙ্গে স্বর্গবাস আর অসত্সঙ্গে সর্বনাশের কথা কে না জানে। বুদ্ধিমান মানুষের মতিভ্রম হয় বৈকী! কাকে কান নিয়ে গেছে শুনে তাকে ধাওয়া করে কান ফেরত নেওয়ার আগে যথাস্থানে হাতটা রাখার কথা মনেই আসে না। প্রতিবেশ বিপথগামী করতে পারে, পরিস্থিতির প্রতিকূল প্রভাব জীবনকে করতে পারে দুর্বহ। গল্পের হাতিটা নিজেকে হারিয়ে ফেলেও ফিরে পেয়েছে আবার। চেতনার জয় এখানেই।—চলবে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।