রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) ফুল-সহ মান্দা শাখা। (মাঝখানে) বড় মান্দার শাখা। (ডান দিকে) বড় মান্দার পুষ্পমঞ্জরী। ছবি: সংগৃহীত।

 

মান্দা (Viscum orientale)

আগে একাধিক লেখায় বলেছি, আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে ছিল একটা খাল যা উভয় দিকে নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। সেই খালের দুই পাড়ে ছিল প্রচুর গেঁওয়া গাছ। ছোট থেকেই দেখতাম গেঁওয়া গাছের কোনও কোনও শাখা একটু অন্যরকম। সেই শাখাগুলোয় পাতার গঠন গেঁওয়া পাতার মতো নয়। সেই শাখা থেকে যে ফুল হতে দেখেছি তাও গেঁওয়া ফুলের মতো নয়। এমনকি গেঁওয়া পাতা গাছ থেকে ছিঁড়ে নিলে সাদা দুধের মতো আঠা বেরোয়। কিন্তু ওই শাখা থেকে উৎপন্ন পাতা ছিঁড়ে নিলে কোনও আঠা বের হয় না। এমন অদ্ভুত শাখা হয় কেন—এই প্রশ্ন মনের মধ্যে শৈশবে বারবার ঘুরপাক খেত। তবে উত্তর পেতে সময় লাগল বহু বছর। তখন ইন্টারনেট ছিল না।

সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার মতো মানুষ বা গ্রন্থাগার ছিল না। উত্তর পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে। ঘটনাচক্রে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়েই পড়লাম। ফলে জানতে পারলাম আংশিক পরজীবী উদ্ভিদ ভিসকাম-এর কথা। এই গাছকে বাংলায় কী বলে জানতাম না। সুন্দরবন অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ আদৌ কোনও স্থানীয় নামে এই গাছকে নির্দেশ করত কিনা আমার জানা ছিল না। কিন্তু আমার সন্দেহ ছিল আমার ছোটবেলা থেকে দেখা গেঁওয়া গাছের ওই শাখাগুলো কি তাহলে আসলে আংশিক পরজীবী ভিসকাম? প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ট্যাক্সোনমির অধ্যাপক প্রফেসর গৌরগোপাল মাইতি মহাশয়ের শরণাপন্ন হলাম। আর কেটে গেল সন্দেহ। হ্যাঁ, এই শাখা অর্থাৎ পরজীবী উদ্ভিদটি হল ভিসকাম যা বাংলায় মান্দা নামে পরিচিত। এরা প্রধানত গেঁওয়া গাছে জন্মায়। এরা নিজের সবুজ পাতার সাহায্যে খাদ্য তৈরি করতে পারে। কিন্তু সেই খাদ্যে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আর তাই গেঁওয়া গাছ থেকে কিছুটা খাদ্য কেড়ে নেয়।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি

মান্দা দারুণ রকম শাখা-প্রশাখা যুক্ত বর্ষজীবী উদ্ভিদ। আগেই বলেছি এ হল আংশিক পরজীবী। এর কান্ড সবুজ আর পাতা উপবৃত্তাকার, আগার দিকটা গোল। দেখলে মনে হবে অনেকটা চামচের মতো। পাতা বেশ পুরু ও মসৃণ। শাখার উপরে শিরার মতো ভাঁজ দেখা যায়। গেঁওয়া গাছের ওপরেই এরা বেশি জন্মায়। তবে করবী (Nerium indicum) ফুলের গাছের ওপরে মান্দাকে জন্মাতে দেখেছি। মান্দার পাতার কক্ষে হালকা সবুজ রঙের তিন থেকে পাঁচটি ফুল জন্মায়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। ডিম্বাকার ফলগুলোর রঙও হয় হালকা সবুজ।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

 

লৌকিক চিকিৎসা

স্নায়ুঘটিত তীব্র যন্ত্রণা হলে মান্দা গাছের পাতার মণ্ড যন্ত্রণার স্থানে লাগানোর প্রচলন সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায়। তাছাড়া চর্ম রোগের ক্ষেত্রে পুরো উদ্ভিদের ভস্ম ত্বকে লাগানোর প্রচলন রয়েছে। বাত ও ক্ষত নিরাময়ে পুরো গাছটির মন্ড প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ক্ষত নিরাময় হয়। আবার উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদের সাথে মান্দা ব্যবহার করা হয়। হোমিওপ্যাথিতে নাক্স ভমিকা যে কাজ করে মান্দা নাকি অনুরূপ কাজ করে বলে জানা গেছে। তবে বর্তমানে এই উদ্ভিদটিকে সুন্দরবনবাসী কতটুকু চেনে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

(বাঁদিকে) গেঁওয়া গাছ থেকে ঝুলছে মান্দার ঝোপ। ছবি: লেখক। (মাঝখানে) বড় মান্দার ফল। (ডান দিকে) গেঁওয়া গাছ জন্মেছে মান্দা। ছবি: লেখক।

 

বড় মান্দা (Dendropthoe falcata)

সুন্দরবন অঞ্চলে আরও একপ্রকার আংশিক পরজীবী উদ্ভিদ দেখা যায়। তবে এই পরজীবী উদ্ভিদটিকে আমি খুব বেশি দেখিনি। দু’ একবার দেখেছিলাম কেওড়া ও ধুধুল গাছে। সুন্দরী গাছেও জন্মায় বলে শুনেছি তবে দেখিনি। বেশ লম্বা শাখা-প্রশাখাযুক্ত পরজীবী উদ্ভিদ। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ বলা চলে। আশ্রয়দাতা উদ্ভিদের ওপরে রীতিমতো ঝোপ তৈরি করে ফেলে। সুন্দরবনবাসীর কাছে এই উদ্ভিদ বড় মান্দা নামে পরিচিত। তবে বাংলাদেশে এই উদ্ভিদকে ‘ফারোলা’ বলে।

আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৪: ঝোপে-ঝাড়ে হায়েনা

বড় মান্দার পাতাগুলি বেশ পুরু চামড়ার মতো হয়। পাতা বেশ চওড়া ও ডিম্বাকার। বড় মান্দার শাখার যে পর্ব থেকে পাতা উৎপন্ন হয় না সাধারণত সেই পর্ব থেকে একগুচ্ছ ফুল জন্মায়। এক এক গোছায় ১০ থেকে ২০টি ফুল ফোটে। ফুলগুলি লম্বা নলের মতো, যেন ধুতরা ফুলের মিনি সংস্করণ। সুন্দরবনে দুটি ভ্যারাইটির বড় মান্দা দেখা যায়। ফালকাটা ভ্যারাইটির (Dendropthoe falcata var. falcata) ফুলের রং ফ্যাকাসে সবুজ। তবে পাপড়ির আগার দিক হয় গাঢ় সবুজ। আর কক্সিনিয়া ভ্যারাইটির (Dendropthoe falcata var. coccinea) ফুলের রং কমলা, আর পাপড়ির আগার দিক লালচে হলুদ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

ভারতীয় অংশের সুন্দরবনে কক্সিনিয়া ভ্যারাইটি বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের সুন্দরবনে Dendropthoe pentendra নামে আরও এক প্রজাতির পরজীবী উদ্ভিদ মূলত সুন্দরী গাছে জন্মাতে দেখা যায়। এর পাতা বেশি ডিম্বাকার এবং চওড়া, আর ফুলের রং হলদেটে লাল। ফুলের দৈর্ঘ্যও কিছুটা কম। সমস্ত প্রজাতির ফুলের ভিতর থেকে হলুদ রঙের পরাগধানী এবং সবুজ রঙের গর্ভমুন্ড বাইরে বেরিয়ে থাকে। মার্চ থেকে আগস্ট মাসে গাছে ফুল আসে। ফলের আকার অনেকটা ক্যাপসুল বা মুকুটের মতো। ফলের মধ্যে উপবৃত্তাকার বীজ থাকে।
ফুলের মধু পানকারী বিভিন্ন পাখি এই উদ্ভিদের ফুলের পরাগ মিলন ঘটায়। আর বীজ ভক্ষণকারী পাখিরা বড় মান্দার ফল খেয়ে যখন অন্য কোনও গাছে বসে মলত্যাগ করে তখন মলের সাথে নির্গত বীজ অন্য গাছের শাখায় আটকে গেলে সেখানেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে নতুন বড় মান্দা উদ্ভিদের জন্ম দেয়। এভাবেই এরা ছড়িয়ে পড়ে।

(বাঁদিকে) বড় মান্দা ফুল (পেন্টান্ড্রা প্রজাতি)। (ডান দিকে) বড় মান্দা (ফালকাটা ভ্যারাইটি) ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবনবাসীর কাছে বড় মান্দা উদ্ভিদের লৌকিক চিকিৎসায় অসাধারণ ভূমিকায় রয়েছে প্রাচীনকাল থেকে। ক্ষতস্থানে পাতার রস বা পাতার মন্ড লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলে তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকিয়ে যায়। সুন্দরবনবাসীর কাছে এই চিকিৎসা পদ্ধতি আজও অনেক জায়গায় প্রচলিত রয়েছে। ত্বকের রোগ, হাঁপানি, রজঃকালীন সমস্যা, বৃক্কঘটিত রোগ, ডায়েরিয়া, মৃগী রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি নানা রোগের চিকিৎসায় বড়মান্দা পাতার রস বা মন্ড ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে। ফুসফুসে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় এই উদ্ভিদ কার্যকরী বলে জানা গেছে। এমনকি বিজ্ঞানীরা এই উদ্ভিদের নির্যাসে ক্যানসার বিরোধী উপাদানের সন্ধান পেয়েছেন। পরজীবী উদ্ভিদ হলেও তাই বড় মান্দার যে বড় গুণাবলী রয়েছে একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content