রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ফয়জুন্নেসা।

উনিশ শতকে প্রকাশিত হয় ‘রূপজালাল’ কাব্য। এই কাব্যের লেখক ছিলেন ফয়জুন্নেসা দেবী। এই কাব্যে রয়েছে রূপকথার মধ্য দিয়ে আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন ফয়জুন্নেসা। রোকেয়া সাখোয়াত হোসেনের মতো তাঁকেও সমাজ মনে রেখেছ। শুধু লেখা নয়, সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর। ফয়জুন্নেসাকেই মুসলিম মহিলা লেখকদের মধ্যে অন্যতম বলা যায়। তাঁর বাবা ছিলেন কুমিল্লা জেলার হোমনাবাদের জমিদার। মাত্র দশবছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে জীবনের কঠিন পথে মনে মনে একলাই চলতে হয়েছিল তাঁকে।
এমন সময় তিনি লিখছেন। যখন মুসলিম নারীদের জীবন অবরোধ প্রথার বাঁধনে আবদ্ধ। সেই সময় ফয়জুন্নেসা বহুভাষাবিদ। আরবি, ফারসি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় ছিল তাঁর গভীর ব্যুৎপত্তি। ১৮৬০ সালে তাঁর বিয়ে হয় এবং তাঁর স্বামী মোহম্মদ গাজি চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কচ্ছেদও হয়। সেই আমলে এও এক যুগান্তকারী ঘটনা। সেইসময় মুসলমান সমাজে নারীশিক্ষার কথা ফয়জুন্নেসার আগে কেউ ভেবেছিলেন বলে মনে পড়ে না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪০: বিশ্বকবির তিন মেয়ে— অকালে ঝরে যাওয়া প্রতিভা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

শুধু লেখক নয়, ফয়জুন্নেসা কলকাতার ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন। ফয়জুন্নেসা কাজ করেছিলেন অজ পাড়া গাঁয়ে বসে। সেখানকার মেয়েদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে আলোয় আনার কাজ করেছিলেন ফয়জুন্নেসা। শহরের শিক্ষিত মানুষদের সহায়তা ছাড়া এই কাজ তিনি একাই করে গিয়েছেন। কুমিল্লা এলাকায় তাও তাঁকে মনে রাখা হয়েছে। কিন্তু আপামর বাঙালি সমাজে ফয়জুন্নেসা খুব সমাদর পাননি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

ফয়জুন্নেসা দুটি পৃথক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। নানুয়া দিঘির তীরে আর কান্দি নদীর ধারে নারীশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ফয়জুন্নেসা। দুঃখের বিষয়, আজ আর সেই বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব নেই। এখন তার পরিবর্ধিত রূপ ‘শৈলরাণী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত। ঘটনাটি খুব দুঃখজনক। ফয়জুন্নেসার মতো এক সমাজসংস্কারকের নাম বদলে দেওয়া অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। নিজের জমি দান করেছিলেন ফয়জুন্নেসা। ছাত্রী নিবাস, মাসিক বৃত্তি — সব পাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। আরও দুঃসাহসিক ঘটনা যে ফয়জুন্নেসা মুসলিম মেয়েদের জন্য ইংরোজি শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। রোকেয়া যেমন কলকাতায় সাখোয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তেমনই কুমিল্লায় ফয়জুন্নেসা স্থাপন করেন ‘ফয়জুন্নেসা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়।’
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

এছাড়াও নিজের বাড়িতে মক্তব, দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ তৈরি করেছিলেন ফয়জুন্নেসা। ‘ফয়েজিয়া মাদ্রাসা’ স্থাপনও তাঁরই কীর্তি। পরে এইটিই একটি ডিগ্রি কলেজে পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে ফয়জুন্নেসা একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর লেখা ‘রূপজালাল বইতে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে মত রেখেছিলেন। হিন্দু মুসলিম দুই সংস্কৃতির কথাই এসেছে। রূপজালাল বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকদের প্রথম প্রকাশিত বই। ফয়জুন্নেসার ভাষা ছিল খাঁটি বাংলা। তিনি সঙ্গীতসার ও সঙ্গীত লহরী নামের দুটি বইও লিখেছিলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর সমসাময়িক লেখক। কিন্তু ফয়জুন্নেসার যশ তাঁর মতো ছিল না। মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি ‘ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আন্তরিক ভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে ফয়জুন্নেসা সেবামূলক কাজ করে গিয়েছেন। পত্রপত্রিকাও তাঁর দানে সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি রত্ন ছিলেন। সখি সমিতিতেও ফয়জুন্নেসা দুইশত টাকা দান করেছিলেন। তিনি তাঁর সম্পত্তির বৃহৎ অংশ দান করে গিয়েছিলেন উন্নয়নের কাজে। অন্য ধর্মের পৃষ্টপোষক ছিলেন তিনি। নারীশিক্ষা, নারীকল্যাণ ও সাহিত্য কর্ম ত্রিনয়নের মতো তাঁকে অসাধারণ করে তুলেছিল। বিস্মৃতির আড়াল থেকে সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হল মহীয়সী ফয়জুন্নেসার। তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধা।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content