বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

ধর্মাত্মা রাজা দশরথ, স্ত্রী কৌশল্যার কাছে, সত্য স্বীকারোক্তির মাধ্যমে, নিজের অজান্তে কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। একদা যৌবনে রাজা শব্দবেধী বাণের অপপ্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জলপানরত কোন হাতি। ঘট জলপূর্ণ করছিলেন এক ঋষিকুমার। তাঁর ঘট জলপূর্ণ করবার শব্দকে, জলপানরত হাতির শব্দভ্রমে, রাজা শর নিক্ষেপ করলেন। বাণবিদ্ধ ঋষিকুমার প্রাণ ত্যাগ করলেন। পিপাসার্ত পিতামাতার জন্যে তৃষ্ণার জল সংগ্রহ করতে এসেছিলেন ঋষিকুমার। রাজা দশরথ ধার্মিক,সংবেদনশীল। তাঁর মনে দ্বন্দ্ব ও বিষাদের সূত্রপাত তখন থেকেই। একাকী রাজা, নিজের কৃত পাপমুক্তির উপায় কী? চিন্তা করলেন। অজ্ঞাতে কৃত পাপ হতে কীভাবে সার্বিক সুকৃতিলাভ সম্ভব? চিন্তায় আকুল হলেন রাজা। তদজ্ঞানাৎ মহৎ পাপং কৃত্বা সঙ্কুলিতেন্দ্রিয়ঃ। একস্ত্ব্বচিন্তয়ং বুদ্ধ্যা কথং নু সুকৃতং ভবেৎ।।

রাজা দশরথ, মৃত কুমারের নির্দেশিত পথ ধরে উপস্থিত হলেন মুনির আশ্রমে। তিনি দেখলেন, ডানাভাঙ্গাপাখির তুল্য, জরাজীর্ণ শরীরে, শীর্ণকায় চলচ্ছক্তিহীন, ঋষি দম্পতিকে। সেখানে নেই কোন সেবক। তাঁরা পুত্রের অপেক্ষায় অতিকষ্টে সময় অতিবাহিত করছেন। দু’জনে তখন পুত্রের বিষয়ে আলাপচারিতায় রত। রাজার দুষ্কর্মের বিষয়ে তাঁদের সম্যক জ্ঞান নেই কোনও। শোকার্ত চিত্তে, ভীত সন্ত্রস্ত পদক্ষেপে, আশ্রমে প্রবেশ করে শোকাভিভূত হলেন রাজা। পায়ের শব্দ শুনে মুনি বলে উঠলেন, কিং চিরায়সি মে পুত্র পানীয়ং ক্ষিপ্রমানয়।। যন্নিমিত্তমিদং তাত সলিলে ক্রীড়িতং ত্বয়া। উৎকণ্ঠিতা তে মাতেয়ং প্রবিশ ক্ষিপ্রমাশ্রমম্।।

কেন দেরি করছ, পুত্র? শীঘ্র জল নিয়ে এস। তুমি বুঝি মায়ের জন্যে জল আনতে গিয়ে জলক্রীড়ায় ব্যস্ত ছিলে? তোমার সেই উৎকণ্ঠিতা মাকে, দেখ। তাড়াতাড়ি আশ্রমে প্রবেশ কর। বৃদ্ধ পিতা আক্ষেপ করে বললেন, যদি তাঁরা দু’জনে পুত্রের অপ্রিয় কাজও করে থাকেন, যশস্বী পুত্র যেন সে কথা মনে না রাখেন। বৃদ্ধ দম্পতি অন্ধ ও চলাফেরায় অশক্ত, অগতির গতি, পুত্রই চোখ, পুত্রই তাঁদের প্রাণ। কেন তাঁর কথার উত্তর দিচ্ছেন না তাঁর পুত্র? ত্বং গতিস্ত্বগতীনাঞ্চ চক্ষুস্ত্বং দীনচক্ষুষাম্। সমাসক্তাস্ত্বয়ি প্রাণাঃ কথং ত্বং নাভিভাষসে।। বাকরুদ্ধ, জড়সড়, ভীত রাজা অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে, অস্ফুটস্বরে, সংযত বাক্যবিন্যাসে মুনিপুত্রের নিধনবার্তা বর্ণনা করে বললেন, ক্ষত্রিয়োঽহং দশরথো নাহং পুত্রো মহাত্মনঃ। সজ্জনাবমতং দুঃখমিদং প্রাপ্তং স্বকর্মজম্।।
আমি ক্ষত্রিয় দশরথ, মহাশয়ের পুত্র আমি নই। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এই সজ্জনের নিন্দিত দুষ্কর্মটি করে ফেলেছি। রাজা তাঁর কৃত অপরাধের বোঝা লাঘব করলেন। তাঁর নিজের দ্বারা কৃত মুনিকুমারের বধবৃত্তান্তটি আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করলেন। জানালেন, তাপসের অন্তিম কাতরোক্তি। রাজা দশরথের সরল, সত্যনিষ্ঠ, অকপট স্বীকারোক্তি—অজ্ঞানাদ্ভবতঃ পুত্রঃ সহসাভিহতো ময়া। শেষমেবং গতে যৎ স্যাৎ তৎ প্রসীদতু মে মুনিঃ।। অজ্ঞানতাহেতু সহসা আপনার আত্মজকে আমি হত্যা করেছি।

শেষ অবধি যা কর্তব্য সেটাই করুন। আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হন।রাজা মহর্ষির সম্মুখে সেই নিষ্ঠুর অপরাধের কাহিনি বিবৃত করলেন। মুনি কিন্তু নির্মম বধবৃত্তান্ত শুনেও কঠোর অভিশাপদানে বিরত হলেন। শোকের তীব্রতায় তাঁর মুখমণ্ডল শোকবিহ্বল হল। অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে মুনি বার বার দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, করজোড়ে অপেক্ষারত রাজাকে বললেন, এই অশুভ সংবাদ যদি আপনি স্বয়ং না জানাতেন তাহলে এখনই আপনার মুণ্ডু শতসহস্র ভাগে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে ভেঙ্গে পড়ত।

ক্ষত্রধর্মানসারে, বানপ্রস্থ অবলম্বনকারীর জ্ঞানত হত্যাকারী, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র হলেও নিস্তার নেই তাঁর, তাঁকেও স্থানচ্যুত হতে হয়। তপস্যায় নিরত সেই কুমারের মতো ব্রহ্মবাদী মুনির প্রতি জ্ঞানত অস্ত্রাঘাতের ফলে আঘাতকারীর মাথাটি সপ্তধা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। রাজা জীবিত আছেন, কারণ তিনি অজ্ঞতাবশত কাজটি করেছেন। তা না হলে, সম্পূর্ণ রঘুবংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, আপনার কথা আর কি বলব। অজ্ঞানাদ্ধি কৃতং যস্মাদিদং তে তেন জীবসে।অপি হ্যদ্য কুলং ন স্যাদ্রাঘবাণাং কুতো ভবান্।।

এরপরে মুনির অভিলাষ ব্যক্ত করলেন, তিনি সেই স্থানটিতে যেতে ইচ্ছুক যেখানে শায়িত রয়েছেন রক্তাক্তশরীর, গলিত অজিন পরিধানে যাঁর, সংজ্ঞাহীন, যমরাজের অধীনস্থ মুনিপুত্র। রাজা, শোকার্ত মুনিদম্পতিকে সেই স্থানটিতে নিয়ে গেলেন। সস্ত্রীক মুনি, পুত্রের মৃতদেহ স্পর্শ করলেন। পুত্রকে আলিঙ্গনে বেঁধে শবদেহের ওপরে লুটিয়ে পড়লেন। মৃত পুত্রের উদ্দেশ্যে মর্মান্তিক স্বগতোক্তি করতে লাগলেন, তুমি তো আজ অভিবাদন করলে না? আমার সঙ্গে কোন কথাই বলছ না, মাটিতে পড়ে রয়েছ, বাছা, তুমি কী রাগ করেছ? নাভিবাদয়সে মাদ্য ন চ মামভিভাষসে। কিঞ্চ শেষে তু ভূমৌ ত্বং বৎস কিং কুপিতো হ্যসি।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৯: অধ্যবসায়, নিষ্ঠা ও একান্ত অভিনিবেশই সাফল্যের মন্ত্র

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন

মুনির বক্তব্য —বেশ,তিনি না হয় পুত্রের অপ্রিয় হয়েছেন কিন্তু ধর্মপরায়ণা জননীর পানে একবার দৃষ্টপাত করে, পুত্র যেন তাঁকে জড়িয়ে ধরে একটি বার মিষ্টি কথা বলেন। কে এখন রাত্রিশেষে মনোহরণ মধুর শাস্ত্রবাক্য পাঠ করে শোনাবেন? হাহাকার করে উঠলেন মুনি, স্নানান্তে সান্ধ্য উপাসনার পরে, আগুনে আহুতিসহ হোম সম্পন্ন করে, পুত্রশোকে কাতর পিতাকে কে প্রীত করবেন এখন?কন্দমূল আহরণ করে কে প্রিয় অতিথির মতো অসমর্থ দৃষ্টিহীন পিতাকে ভোজন করাবেন? দুঃখে, আর্তস্বরে, মৃতপুত্রের প্রতি মুনির জিজ্ঞাসা —অন্ধ, বৃদ্ধা, তাপসী, দুঃখিনী, স্নেহাতুরা মাকে কীভাবে মুনি প্রতিপালন করবেন? আকুলকণ্ঠে বলে উঠলেন শোকার্ত পিতা, তিষ্ঠ মা মা গমঃ পুত্র যমস্য সদনং প্রতি। শ্বো ময়া সহ গন্তাসি জনন্যা চ সমেধিতঃ।। পুত্র, তুমি যমালয়ে যেও না। আমার জন্যে কিছু কাল অপেক্ষা কর। আগামীকাল তুমি তোমার পিতা ও মাতার সঙ্গে বরং যেও।

বেদনাহত পিতা গভীর আর্তি প্রকাশ করলেন —পুত্রবিহনে অরণ্যবাসী পিতামাতা,উভয়ে শোকার্ত, অনাথ, দীন, অক্ষম। তাঁদের যমের ভবনে যেতে আর দেরী নেই। বিবস্বান সূর্যের পুত্র যমকে একটি কথাই বলার আছে। যম যেন তাঁদের অপরাধ ক্ষমা করেন। মাতা পিতার প্রতিপালক এই পুত্র। মুনি অনাথ, তাই মহাযশস্বী লোকপাল যমও তাঁকে অক্ষয় অভয় দক্ষিণা দান করবেন। নিষ্পাপ পুত্র পাপিষ্ঠের দ্বারা নিহত হয়েছেন, তাই তিনি শস্ত্রধারীদের বীরগতি লাভ করবেন। সংগ্রামে পিছিয়ে না এসে যে বীরেরা সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হন তাঁদের তুল্য মর্যাদাপূর্ণ শ্রেষ্ঠ লোক প্রাপ্ত হবেন মুনিপুত্র। সগর, শিবিপুত্র, দিলীপ, জনমেজয়, নহুষ, ধুন্ধুমার প্রভৃতি বীরের সদৃশ গতি হবে পুত্রের। পুত্র সেই লোকে যাত্রা করুন। মুনি, পুণ্যবানদের পরম গতি বর্ণনা করে, পুত্রের জন্যে সেই উত্তম লোকপ্রাপ্তির প্রার্থনা জানালেন।

মুনি পুত্রকে আশীর্বাদ করলেন, প্রাণীকুলে যাঁরা বেদাধ্যয়ন ও তপস্যার ফললাভের নিমিত্ত, ভূদানের কারণে পুণ্যবান এবং নিয়ত অগ্নিতে আহুতি দানকারী, পত্নীনিষ্ঠ, সহস্র গোদানের ফলে পুণ্যবান, গুরুর প্রতি সর্বদা সেবাপরায়ণ,স্বর্গলাভার্থে দেহ পরিত্যাগকারী, এমন ব্যক্তিদের তুল্য সদ্গতি লাভ করবেন তাঁর পুত্র। মুনিকুলে জাত কেউ কখনও অশুভগতি লাভ করেননি। পুত্রহন্তা সেই অশুভলোক প্রাপ্ত হন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৮: চরম শত্রুর সঙ্গেও মতের মিল হলে বন্ধুত্ব হয়, আবার মতের মিল না হলেই শত্রুতা

ক্রন্দনরত মুনি সস্ত্রীক পুত্রের উদ্দেশ্যে জলাঞ্জলি দানে সচেষ্ট হলেন। সঙ্গে সঙ্গে ধার্মিক,মুনিতনয় নিজের অর্জিত কর্মফল অনুসারে, দিব্যরূপ ধারণ করে, ইন্দ্রের সঙ্গে স্বর্গারোহণ করলেন।স্বর্গত পুত্র পিতামাতাকে আশ্বস্ত করে বললেন, স্থানমস্মি মহৎ প্রাপ্তো ভবতঃ পরিচরণাৎ। ভবন্তাবপি চ ক্ষিপ্রং মম মূলমুপেষ্যথঃ।। আমি আপনাদের পরিচর্যার কারণে মহৎ স্থান লাভ করেছি। আপনারাও অচিরেই আমার কাছে উপস্থিত হবেন। দিব্য রথে আরোহণ করে,মুনিকুমার স্বর্গারোহণ করলেন। রাজা সেখানে করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

পুত্রের শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করে, মুনি,অপেক্ষমান রাজাকে বললেন, আজ রাজা মুনির একমাত্র পুত্রকে হত্যা করেছেন। পুত্রকে শরবিদ্ধ করে,মুনিকে অপুত্রক করেছেন। পুত্রের মৃত্যুর কারণে মুনি ব্যথিত নন।মুনির অনুরোধ, হে রাজন,আজই বধ করুন আমায়। অদ্যৈব জহি মাং রাজন্ যদিও রাজা নিজের অজ্ঞানতাহেতু মুনিপুত্রকে বধ করেছেন, তবুও, মুনি, রাজাকে দুঃসহ, নিদারুণ অভিশাপ দেবেন। সম্প্রতি মুনির অনুভূত এই পুত্রবিচ্ছেদজনিত দুঃখের সমদুঃখ ভোগ করে, রাজা মৃত্যু বরণ করবেন। পুত্রব্যসনজং দুঃখং যদেতন্মম সাম্প্রতম্।এবং ত্বং পুত্রশোকেন রাজন্ কালং করিষ্যসি।।

ক্ষত্রিয় রাজা, না জেনে নরহত্যা করেছেন। তাই তিনি, ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপে লিপ্ত হবেন না। দাতার দক্ষিণাদানের ফল যেমন তাৎক্ষণিক তেমনই রাজা অচিরেই এই প্রাণান্তকর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন। অভিশাপান্তে, বৃদ্ধ মুনিদম্পতি, করুণকণ্ঠে, বিলাপ করতে করতে, চিতায় আরোহণ করলেন। তাঁদের স্বর্গপ্রাপ্তি হল।রাজা দশরথ রানি কৌশল্যার কাছে সবিস্তারে এই কাহিনি বর্ণনা করলেন। রাজার স্মরণে এল, শৈশবে, শব্দবেধের অনুকরণরত রাজার নিজের অনিচ্ছাকৃত সেই পাপবৃত্তান্ত। ভোজনযোগ্য নয় এমন অন্নগ্রহণের কারণে আক্রান্ত ব্যাধির মতো রাজা তাঁর কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন। তস্মান্মামাগতং ভদ্রে তস্যোদারস্য তদ্বচঃ।ইত্যুক্ত্বা স রুদংস্ত্রস্তো ভার্য্যামাহ তু ভূমিপঃ।।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

রাজার অনুমান—সেই উদারমনা ঋষির বচন সত্য হতে চলেছে। রানিকে প্রকৃত তথ্য জানিয়ে,ভয়ে তটস্থ রাজা,কেঁদে উঠলেন। রাজা আরও বললেন, পুত্রশোকে প্রাণ ত্যাগ করতে চলেছেন রাজা,তাঁর দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্তপ্রায়, দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।হে দেবি,তুমি আমায় স্পর্শ কর। কৌসল্যে ত্বং হি মাং স্পৃশ। মরণকালে মানুষ এমনভাবেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। রাজার মনে হল,যদি রাম,একটিবার আমায় স্পর্শ করেন, একবার ফিরে এসে ধন কিংবা যৌবরাজ্য গ্রহণ করেন, তাহলে আমি জীবন ফিরে পাব। আমি রামের প্রতি যে আচরণ করেছি,তাই এই আশা করা বাতুলতামাত্র। যদি মাং সংস্পৃশেদ্রামঃ সকৃদন্বারভেত বা।। ধনং বা যৌবরাজ্যং বা জীবেয়মিতি মে মতিঃ। ন তন্মে সদৃশং দেবি যন্ময়া রাঘবে কৃতম্।।

রাম কিন্তু পিতার প্রতি যথাযোগ্য ব্যবহার করেছেন। পৃথিবীতে এমন কে বিচক্ষণ ব্যক্তি আছেন যিনি দুরাচারী পুত্রকেও পরিত্যাগ করেন? এমন কোনও নির্বাসিত পুত্র আছেন যিনি পিতার দোষাবিষ্কার করেন না?রাজা পুত্রকে চোখে দেখছেন না,তাঁর স্মৃতিশক্তি লুপ্তপ্রায়। যমদূতরা তাড়া দিচ্ছে। এই জীবনহানির মতো দুঃখজনক আর কি আছে। সত্যনিষ্ঠ, ধর্মজ্ঞ রামের দর্শনলাভ হল না। যেমন সূর্যতাপ ক্রমে ক্রমে জল শোষণ করে তেমনই ব্যতিক্রমী রামের অদর্শনজনিত শোক যেন রাজার জীবনী শক্তি শুষে নিচ্ছে। বছর পনের পরে যাঁরা পদ্মলোচন, সুভ্রূ, সুন্দর দন্তপঙক্তিবিশিষ্ট, সুনাসিকাযুক্ত রামের চারু মুখখানি দেখবেন, তাঁরাই ধন্য। পলায়িত শুকপাখিটি ফিরে এলে পালকের যেমন অনুভূতি হয় তেমনই, বনবাসান্তে অযোধ্যায় প্রত্যাগত রামের, শরতের পূর্ণ চন্দ্র ও কুসুমিত পদ্মতুল্য, সতত সুগন্ধি বদন দর্শন করে দর্শকরা সুখী হবেন।

রাজা দশরথ মোহগ্রস্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছেন, তাঁর চিত্ত অবসাদগ্রস্ত। শব্দ, স্পর্শ ও রসাস্বাদনের অনুভূতি নেই আর। স্নেহপদার্থের অভাবে প্রদীপ যেমন নিষ্প্রভ হয় তেমনই চিত্ত অবসন্ন হওয়ায় রাজার ইন্দ্রিয়গুলিও নিষ্ক্রিয় হয়েছে। রাজার অনুভবে, তাঁর মানসিক হতচৈতন্য অবস্থা,নদীবেগে বিধ্বস্ত তীরভূমির মতো। অয়মাত্মভবো শোকো মামনাথচেতনম্। সংসাধয়তি বেগেন যথা কূলং নদীরয়ঃ।। মহাবাহু, ক্লেশনাশক, পিতৃপ্রিয়, রামের জন্যে হাহাকার করে উঠলেন অযোধ্যাপতি দশরথ। রাম প্রভু হয়েও আজ কোথায় তিনি? রাজার প্রাণশক্তি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত, অনুতপ্ত রাজার আক্ষেপ—হায় কৌশল্যা, হায় দুখিনী সুমিত্রা, তোমাদের আর দেখতে পাচ্ছিনা। হায় কুলকলঙ্কিনী নির্মম কৈকেয়ী যিনি শুধু শত্রুতা করে গেলেন। হা কৌসল্যে ন পশ্যামি হা সুমিত্রে তপস্বিনি। হা নৃশংসে মমামিত্রে কৈকেয়ি কুলপাংসনি।।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১০: মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে

এ ভাবে রামজননী কৌশল্যা ও লক্ষ্মণমাতা সুমিত্রার উপস্থিতিতে শোকগ্রস্ত রাজা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রিয় পুত্রের নির্বাসনের দুঃখে গভীরভাবে শোকাতুর, দুঃখভারে পীড়িত, অযোধ্যাধিপতি, উদারহৃদয়, দশরথ, বিলাপরত অবস্থায় প্রয়াত হলেন।

পুত্র রামের নির্বাসন, ধর্মসংপৃক্ত অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে তুলল অযোধ্যাধিপতি রাজা দশরথের মনে। কেন ধার্মিক রাজার এমন মনঃকষ্ট? এই শোকানুভব কী রাজার অতীতে কৃত কোনও পাপের ফল? আত্মবিশ্লেষণের ফলে রাজার স্মরণে এল একদা পরীক্ষামূলকভাবে শব্দবেধী বাণপ্রয়োগ করেছিলেন।হাতির জলপানের শব্দভ্রমে এক মুনিকুমারকে শরবিদ্ধ করলেন রাজা। রাজার আছে কুমারের হত্যার দায়,সেই সঙ্গে বিবেকের দংশন দুই মিলিয়ে এক মরাত্মক মানসিক অবক্ষয়ের সূচনা হল। তাতে নতুন মাত্রা যোগ করলেন মৃত কুমারের অন্ধ পিতা। মুনির অভিশাপ, যেন পুত্রবিচ্ছেদের কারণে, শোকাতুর রাজাকে শূলবিদ্ধ করল। সুযোগ্য পুত্র লাভ করে যে অনুশোচনার জ্বালা ভুলেছিলেন, আরও এক পিতার পুত্রশোকের তীব্র অভিঘাত, সেই পুত্রের বিচ্ছেদবেদনাবোধ ফিরিয়ে দিল। বেদনার্ত রাজা দশরথ সেই নির্মম কাজের ফলশ্রুতি অনুভব করলেন। একজন প্রশাসক বিশ্বচরাচরের রক্ষক। তিনি যে কোন প্রাণীর জীবন নিয়ে পরীক্ষামূলক কোনও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কী? মানুষ বা মনুষ্যেতর প্রাণরক্ষার দায়িত্ব রয়েছে শাসকের। শুধু বিনোদনের কারণেও হাতিকে লক্ষ্য করে শরসন্ধান নৈতিকতার নিরিখে বৈধ কিনা এ প্রশ্ন আধুনিক মননেও প্রশ্ন রেখে যায়।

ছবি: প্রতীকী।

রাজা, মৃত কুমারের পিতার কাছে অকপটে সত্য স্বীকারোক্তি করেছেন তিনি না জেনে হত্যা করেছেন মুনিপুত্রকে। এই true confession বা অপরাধের সত্যতাস্বীকারে আছে আত্মশুদ্ধির অবকাশ, বিবেকের পীড়ণ থেকে খানিক অব্যাহতিলাভ, ক্ষমাপ্রার্থনার সুযোগ। রাজা অবশ্য এর কোনটির থেকে মুক্ত হতে পারেননি। যে কোনও বিবেকবান ধার্মিক প্রশাসকের কাছে সাধারণ নাগরিকের প্রার্থিত লক্ষ্যমাত্রা হল—দোষস্বীকারের জন্যে একটি বলিষ্ঠ মেরুদণ্ড ও সত্যনিষ্ঠতার প্রতি আনুগত্য। রাজা দশরথ নরহত্যার দায়ে মনে মনে নিজেকে অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এ বার তাঁর দোষস্বীকার আত্মজনের কাছে। রানির কাছে মনের দ্বার খুলে দিয়েছেন রাজা। কিন্ত প্রাণঘাতী মর্মবেদনা হতে রেহাই পাননি। সংবেদনশীলতার পরিণাম, আজীবন অপরাধবোধের কাঁটায় বিদ্ধ হতে হতে মৃত্যুবরণ। এটি রামায়ণের উদাহরণ শুধু নয়, মনুষ্যত্বধর্মের এই সূক্ষ্ম বেদনাবোধ হতে বিবেকবানেরা কোনও কালেই রেহাই পাননি, আজও নয়।

মুনিকুমারের পিতামাতার প্রতি সেবাধর্মপালন ও কর্তব্যবোধ, আধুনিক যুগের প্রবীণদের প্রতি দায়বদ্ধতা পালনের অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত। অসহায়,তৃষ্ণার্ত, বৃদ্ধ পিতামাতারা পুত্রের প্রতীক্ষায় থাকেন,শেষে নৈরাশ্যের অন্ধকার গ্রাস করে তাঁদের জীবন। আধুনিক যাপনচিত্রে মুনিকুমারের মতো দায়িত্বশীল পুত্র বিরল দৃষ্টান্তমাত্র।

পুত্রহারা পিতা,রাজাকে ক্ষমা করতে পারেননি। নিজের অজান্তে কৃত নবীন প্রাণহরণজনিত অপরাধের দোষ রাজাকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু পুত্রহারা পিতার রোষের শিকার হয়েছেন তিনি।অন্যকে দুঃখ দিলে সেই দুঃখ বোধ হয় সেভাবেই ফিরে আসে, যেমন ফিরে এসেছিল রাজা দশরথের জীবনে। অভিশাপ উপলক্ষ্যমাত্র। মনের গভীরে সুপ্ত অপরাধবোধ, অপরাধীর দুর্বল কোনও অপরাধ মুহূর্তে নতুনভাবে ধরা দেয়। অবশ্যই ধর্মবোধে প্রাণিত মনেই এই মানসযাতনা মর্মভেদী হয়ে ওঠে, নির্মম পাথুরে মনের অপরাধীর ক্ষেত্রে নয়। অবিমৃষ্যকারী রাজা, শব্দবেধের প্রতিফল ভোগ করলেন। রাজা দশরথের জীবনে, মুনির অভিশাপ প্রাণঘাতী হয়ে উঠল। এমনভাবেই নিজের অজান্তে শব্দ লক্ষ্য করে, নিক্ষিপ্ত শাণিত শর, বিদ্ধ করে অনির্দিষ্ট কোন সুকুমার হৃদয়। শব্দভেদকারীর অনুশোচনার অন্ত থাকে না। একবার নিক্ষিপ্ত শর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না যে, তীক্ষ্ণ শরের মতোই শব্দের লক্ষ্য বিদ্ধ করে কোনও নরম কোমল মন,মুনির অভিশাপের মতো শব্দবাণের অভ্রান্ত লক্ষ্যে বিদ্ধ হয় দশরথদের জীবন।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content