শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

কাক-লঘুপতনক আড়াল থেকে সবটাই দেখলো। কপোতরাজ-চিত্রগ্রীব আর মুষিক-হিরণ্যকের মধ্যে সব কথোপকথনই শুনলো সে খুব মন দিয়ে। হিরণ্যককে দেখে খুব ভালো লাগলো তার। সে ক্ষুদ্র হলেও তার তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে শিকারীর জাল কেটে ফেলার ক্ষমতা খুব বিস্মিত করলো তাকে। হিরণ্যকের সহস্রমুখবিশিষ্ট বিল-দুর্গের বিচিত্র সুরক্ষা ব্যবস্থা দেখেও খুবই অদ্ভুত লাগলো লঘুপতনকের। সে ভালোই বুঝলো যে পাখীরা জালে আটকে পড়লে এই হিরণ্যকের সাহায্য ছাড়া বাঁচবার উপায় নেই। তাই এই হিরণ্যকের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখাটা প্রয়োজন। কার বিপদ কোথা থেকে আসে সে তো আর কেউ বলতে পারে না!

কোনও দিন হয়তো আমারই তাকে দরকার হবে। কিন্তু এখানে একটা অসুবিধাও আছে। আসলে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে গেলে যে দুটো গুণ একজনের মধ্যে থাকা উচিত সে দুটি হল—বিশ্বাস আর ধৈর্য। এর কোনওটাই নেই কাকের আমার মধ্যে। আমি যেমন কাউকে বিশ্বাসও করতে পারি না আবার স্বভাবেও আমি খুবই চঞ্চল। অথচ বন্ধুত্বের পরীক্ষাই হয় সময়ে এবং বিশ্বাসে। তাও এই হিরণ্যকের সঙ্গে আমাকে বন্ধুত্ব করতেই হবে।

লোকে বলে, ধনসম্পদ বা লোকলস্কর— এই সব কিছু থাকলেও বুদ্ধিমান মানুষের উচিত সব সময় বন্ধু তৈরি করা। কারণ মিত্রসম্পদের মতো বড় সম্পদ এই দুনিয়ায় নেই। সমুদ্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যেতে পারে যে সে সর্ব সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও, আকাশে যখন তার মিত্র চন্দ্রের উদয় হয় তখনই সে বিপুল জলরাশিতে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মিত্রের সহায়তায় মানুষ শক্তিশালী হয়।

এই সব চিন্তা করে সে লঘুপতনক নিঃশব্দে সেই গাছ থেকে নেমে হিরণ্যকের সহস্রবিলদ্বার যুক্ত দুর্গের সামনে এসে জোড়ে জোড়ে হিরণ্যককে ডাকতে শুরু করল—“এহ্যেহি ভোঃ হিরণ্যক! এহি” —ওহে হিরণ্যক! একটি বার দেখা দিন। একটু বেরিয়ে আসুন ভাই। লঘুপতনকের ডান শুনে হিরণ্যক ভাবলো, মনে হয় কোনও এক পায়রার বাঁধন ভুলে কাটা হয়নি এখনও তাই সে আমাকে এ ভাবে ডাকছে।

তাই দুর্গের ভিতর থেকেই গলা উচিয়ে সে জিজ্ঞেস করল—“ভোঃ কো ভবান্‌?”। আপনি কে?
লঘুপতনক বললে, ওহে আমি একটি কাক। আমার নাম লঘুপতনক। কাকের নাম শুনেই আরও নিজেকে গর্তের গভীরে লুকিয়ে সেখান থেকেই হিরণ্যক বলল, ওহে আপনি এখনই এখান থেকে চলে যান। এক মুহূর্তের জন্যেও আপনাকে এখানে দেখতে চাই না আমি।

কাকটি তখন বলল, আপনার কাছে একটা খুব দরকারি কাজে এসেছি ভাই। দয়া করে একবার গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখা দিন। হিরণ্যক বলল—“ন মেঽস্তি ত্বযা সহ সংগমনেন প্রয়োজনম্‌”। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করবার এতোটুকুও ইচ্ছে নেই আমার। লঘুপতনক তাই শুনে বলল, ভাই! আমি স্বচক্ষে আপনাকে কপোতরাজ চিত্রগ্রীবদের সকলকে বন্ধনপাশ থেকে মুক্ত করতে দেখেছি। তাই দেখে আপনার প্রতি আমার গভীর একটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্মেছে। আমার তো এটা ভেবেই নিশ্চিন্ত লাগছে যে যদি কোনও দিন আমি এ ভাবে জালে আটকা পড়ি তাহলে আপনার কাছে এসে অন্ততঃ আমার পাশমুক্তি মিলবে। সেই জন্যেই আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী—“তৎ ক্রিযতাং মযা সহ মৈত্রী”।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৭: রাজনৈতিক লাভের আশায় রাজাকে ক্ষেত্র বিশেষে গণিকার মতো অভিনয়ে নিপুণ হতে হয়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন

হিরণ্যক তখন বলল—“অহো ত্বং ভোক্তা, অহং তে ভোজ্যভূতঃ। তৎ কা ত্বযা সহ মম মৈত্রী?”। আপনি খাদক আর আমি আপনার খাদ্য। দূর আকাশ থেকে আমাদের মতন ছোট ছোট প্রাণীদের দেখলেই আপনারা উড়ে এসে আমাদেরকে খেয়ে নেন। আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হওয়া কি করে সম্ভব? আপনি চলে যান। শাস্ত্রে বলে—
যযোরেব সমং বিত্তং যযোরেব সমং কুলম্‌।
তযোর্মৈত্রী বিবাহশ্চ ন তু পুষ্টবিপুষ্টযোঃ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি ২৯)


যে দু’জনের ধনসম্পত্তি বা কুলমর্যাদা সমান হয় মিত্রতা বা বৈবাহিক সম্পর্ক কেবল তাদের মধ্যেই হতে পারে; ধনসম্পতি বা কুলমর্যাদায় একে অপরের থেকে অধিক বা কম হলে তাদের মধ্যে মিত্রতা হয় না। শুধু কি তাই? যে নির্বোধ লোক নিজের মন্দবুদ্ধির কারণের নিজের থেকে অধিক গুণবান কিংবা নিম্ন মানসিকতার লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সে লোক বাস্তবে অন্যের হাসিরই পাত্র হয়। কারণ বন্ধুত্ব জিনিষটা এমনই যেটা সমানে সমানেই হয়। অসমানের সঙ্গে সমানের বন্ধুত্বটা বাস্তবে প্রয়োজন কিংবা কৃপাজন্য। মনের অন্তরঙ্গতা তাতে কমই থাকে। তাই আপনি চলেই যান। আপনার সঙ্গে মিত্রতা করার কোনও আগ্রহ নেই আমার।

হিরণ্যকের কথা শুনে কাক বলল, ওহে হিরণ্যক! এই আমি তোমার দুর্গদ্বারে বসলাম। যদি তুমি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব না করো তাহলে তোমার সামনেই আমি প্রাণত্যাগ করবো। সুতরাং এখন থেকে আমি প্রয়োপবেশনে বসলাম—তোমার দেখা না পাওয়া পর্যন্ত অন্নজল গ্রহণ করবো না; আর সে জন্য যদি আমায় প্রাণত্যাগও করতে হয় তো করবো।
আরও পড়ুন:

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

হিরণ্যক দেখলো এ তো মহাবিপদ। কাক তো একেবারে নাছোড়বান্দা। সে বলল, ওহে তুমি তো আমাদের শত্রু। তোমার। সঙ্গে কীভাবে মিত্রতা সম্ভব? পণ্ডিতেরা বলেন, শত্রুর সঙ্গে ভালো মনে সন্ধি করলেও বাস্তবে কিন্তু তাদের সঙ্গে মিল হয় না। যেমন আগুণ আর জল। আগুন উষ্ণ আর জল হলো শীতল। কিন্তু আগুনের সঙ্গে সন্ধি করে জল শীতলত্ব ধর্ম ছেড়ে উষ্ণ হলেও সে জল কিন্তু অনায়াসে আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারে। তাই শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা হতে পারে না। লঘুপতনক বলল, ওহে! তোমার সঙ্গে এখনও আমার দেখাটা পর্যন্ত হয়নি, সেক্ষেত্রে এখনই শত্রুতার প্রশ্ন উঠছে কেন? তুমি কিন্তু ভাই এবার অনুচিত কথাবার্তা বলছো।

পাঠককে খেয়াল করতে বলবো যে দু’জনের মধ্যে শুরুতে ‘আপনি-আপনি’ করে কথা শুরু হলেও ক্রমশ কিন্তু দু’জনে ‘তুমি-তুমি’ করতে বলতে শুরু করেছে। এটাই হল সংযোগ বা কথা আদান-প্রদানের একটি ইতিবাচক ফল। যেকোনও মানুষের মধ্যে কথাবার্তা যদি চলতে থাকে তাহলে কিন্তু অনেক বিপরীত পরিস্থিতিতে সুফল আসতে পারে, কিন্তু যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে সেটা সম্ভব নয় একেবারেই।

লঘুপতনক আর হিরণ্যকের মধ্যে কথা যতোই এগোতে থাকেই ততোই তারা ‘আপনি’ থেকে পরস্পরকে ‘তুমি’তে সম্বোধন করতে থাকে। কাকের কথা শুনে হিরণ্যক বলল, পণ্ডিতেরা দু’রকম শত্রুর কথা বলেছেন—সহজ এবং কৃত্রিম। তুমি আমাদের সহজ শত্রু। শাস্ত্রে বলে, কৃত্রিম শত্রুতা কৃত্রিম গুণে বিনষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু সহজ শত্রুতা একমাত্র মরলে তবেই শেষ হয়।
কাক বলল, ওহে! দু’রকম শত্রুতার লক্ষণটা তো আগে বলো?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১০: মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে

হিরণ্যক বলল, যে শত্রুতা কোনও সাংসারিক চাওয়া বা না-পাওয়া থেকে তৈরি হয় সেটা হল কৃত্রিম শত্রুতা। সেই না-পাওয়া জিনিষটা পেয়ে গেলেই সে শত্রুতাও চলে যায়। কিন্তু সহজ শত্রুতা হল, স্বাভাবিক শত্রুতা। সেটা সবকিছু চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধে। এ শত্রুতার শেষ হয় না। যেমন সাপ আর বেজীর মধ্যে শত্রুতা বা তৃণভোজী আর মাংসাশী প্রাণীর মধ্যে যে শত্রুতা, কিংবা জল আর অগ্নি, দেব-দানব, কুকুর-বেড়াল, ধনী-নির্ধন—এদের মধ্যে যে শত্রুতা সেটা হল সহজ, স্বাভাবিক, চিরন্তন।

আমৃত্যু এই শত্রুতা চলতে থাকে। তেমনই একই পতির যদি একাধিক স্ত্রী থাকে সেইরকম সপত্নীদের মধ্যেও এই শত্রুতা আমৃত্যু। সেইরকম সিংহ আর হাতী, পশু ও তার শিকারী, বেদজ্ঞানী শ্রোত্রিয় এবং ভ্রষ্টব্রত দুর্জন, মুর্খ এবং পণ্ডিত বা পতিব্রতা স্ত্রী আর ব্যভিচারিণী—এদের মধ্যে কোনও মিল হয় না। এরা স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের শত্রু। এদের মধ্যে কেউ কাউকে বাস্তবে আঘাত না দিলেও পরস্পর এরা সহ-জ, অর্থাৎ জন্মশত্রু।
লঘুপতনক কাকটি তখন বলল, “ভোঃ অকারণমেতৎ।”— ওহে তুমি যেটা বলছো সেটা একেবারেই অযৌক্তিক কথাবার্তা। এবার আসল কথাটা শোনো—
কারণাৎ মিত্রতাং যাতি কারণাদেতি শত্রুতাম্‌।
তস্মান্মিত্রত্বমেবাত্র যোজ্যং বৈরং ন ধীমতা।। (ঐ, ৩৩)
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী

এ জগতে একজন লোক অপরজনের শত্রু হয় কোনও না কোনও বিশেষ কারণেই আবার কারণ বিশেষেই বন্ধুও হয়। বন্ধুত্ব বলো বা শত্রুতা কোনওটাই অকারণে হয় না। জগতে সবকিছু কাজের পিছনেই কারণ থাকে। কারো সঙ্গ ভালো লাগলে কিংবা মতের মিল হলে বন্ধুত্ব হয় আবার মতের মিল না হলেই শত্রুতা। চরম শত্রুর সঙ্গের মতের মিল হলে মিত্রতা হয়, জগতের এইটাই নিয়ম। তাই শত্রুতা বলো বা মিত্রতা সব কিছুর পিছনেই কোনও না কোনো কারণ অবশ্যই থাকে। কিন্তু মিত্রশক্তি হল সবচেয়ে বড় শক্তি। অসহায় মানুষ একা। একা মানুষ কিছুই করতে পারে না। তাই এই সংসারে বুদ্ধিমান লোকেদের উচিত সব সময় বন্ধুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করা। যার মিত্রসংখ্যা যতো বেশি, সে ততোই ধনী। তাই ওহে হিরণ্যক! আমার সঙ্গে মিত্রতা করতে অনুরোধ করি। আপনি এবার দয়া করে দেখা দিন। বিলদুর্গ থেকে বেরিয়ে আসুন।

হিরণ্যক যদিও ভরসা পেলো না। আড়াল থেকেই বলল, আপনার যুক্তি শুনলাম। কিন্তু নীতিশাস্ত্র তো অন্য কথা বলে। নীতিশাস্ত্র বলে যে একবার অন্যায় কাজকর্ম করেছে তার সঙ্গে মিত্রতা করা মানে নিজের মৃত্যু যেচে আহ্বান করা।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content