রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


নন্দিতা কৃপালনি।

নন্দিতা কৃপালনির গল্প বলি! সেই আমলে অনেকরকম কাজ করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের নাতনি বলে নয়, সেই আমলের এক আধুনিক মনের মেয়ে ছিলেন তিনি।

ভারতের স্বাধীনতার অল্প কিছু বছর আগের কথা। অগস্ট বিপ্লবের জন্য ভরাট হয়ে আছে রাজশাহী জেলের জেনানা ফটক। গোপন সভা বসেছে সেখানে। বন্দিনী মেয়েরা ঠিক করেছেন, ২৬ জানুয়ারি জেলের মধ্যেই ভারতের পতাকা উত্তোলন করবেন। অতি কষ্টে পতাকা বানানো হল। ভোর বেলা গাছের কঠিন ডালে কঠিন শপথের মতো উড়তে লাগল ভারতের পতাকা। দুটি তরুণী মেয়ের কণ্ঠে সেই ভোরে নির্ভয়ে, উদাত্ত কন্ঠে গান ভেসে এল—‘জয় হোক, জয় হোক, নব অরুণোদয়।’ এই দুটি মেয়ের একজন ছিলেন নন্দিতা, রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরার কন্যা, সাংবাদিক ও দেশপ্রেমিক কৃষ্ণ কৃপালনির স্ত্রী।
নন্দিতার ছেলেবেলা খুব স্বস্তির ছিল না। মা মীরাদেবী এবং বাবা নগেন্দ্রনাথের অসুখী দাম্পত্যজীবন নন্দিতার জীবনে অস্বস্তির ছায়ার মতো জেগেছিল। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই প্রবল কর্মপ্রবাহে পূর্ণ ছিল নন্দিতার জীবন। মনের অস্থিরতা হয়তো তাঁকে কাজের পরিসরেই স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিত। সহোদর নীতিন্দ্রনাথ বিদেশে লেখাপড়ায় মগ্ন থাকতেন আর ছিলেন স্বল্পায়ু। নন্দিতা রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী হলেও জীবনে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর বিচিত্র কর্মপ্রবাহের কথা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। আজকের কথকতার কেন্দ্রে থাক নন্দিতা, নন্দিতা কৃপালনি।

গোখেল মেমোরিয়ালে লেখাপড়া করলেও নন্দিতার আন্তরিক টান ছিল শান্তিনিকেতনের প্রতিই। সংগীতভবন এবং কলাভবনে নন্দিতার উপস্থিতি সকলকে সমৃদ্ধ করেছিল। রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবী তখন রবীন্দ্রনৃত্য নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন। নন্দিতা ছিলেন তাঁর এক উজ্জ্বল ছাত্রী। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে অসংখ্যবার চিত্রাঙ্গদার অভিনয় হয়। শান্তিনিকেতন থেকে নাচের দল নিয়ে পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেরিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নন্দিতা দ্বিতীয় পর্বের চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় অনায়াস অভিনয় করে সকলের নজর কেড়েছিলেন। প্রয়োজনে দুটি পর্বেই চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় তাঁকে দেখা গিয়েছে। এরপর চন্ডালিকা, শ্যামা, তাসের দেশ—প্রতিটি নৃত্যনাট্যেই তাঁর নাচের ভঙ্গি ও মুদ্রা সকলের নজর কেড়েছিল। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আদরের ‘বুড়ি’।
আরও পড়ুন:

সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৭: লেডি রাণু— সেকালের এক শিল্পমনস্ক মানুষ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৮: নির্দোষ প্রাণীহত্যা কী সমর্থনযোগ্য?

যখনই ডাক পেয়েছেন, ছুটে এসেছেন শান্তিনিকেতনে। একবার হঠাৎ করেই জাপান থেকে শান্তিনিকেতনে কয়েকজন নৃত্য বিশারদ আসার খবর পাওয়া গেল। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখলেন মীরাদেবীকে—‘…বিপদে পড়েছি। হঠাৎ সংবাদ পেয়েছি এক ঝাঁক জাপানি আসবে আমাদের নাচের পরীক্ষার জন্য। …বুড়িকে না পেলে এমন এক লোক হাসানো ব্যাপার হবে যা সমুদ্র পার হয়ে যাবে।’ নন্দিতা এসেছেন এবং আবার জয় করেছেন সকলের মন।

কৃষ্ণ কৃপালনি তখন শান্তিনিকেতনের তরুণ অধ্যাপক। নন্দিতারও আসা যাওয়া শান্তিনিকেতনে। দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নন্দিতার বন্ধুমহলে বেশ চর্চার বিষয় ছিল এই বিশেষ বন্ধুত্ব। দুপুরবেলা মা ঘুমোলেই নন্দিতা নাকি রীতিমত অভিসারে আসতেন রতনকুঠিতে। সেখানেই ছিল তরুণ কৃষ্ণ কৃপালনির বাসা। এরপর ঘটনাটা রূপকথার মতো। সমাজে তখনও তো অসবর্ণ বিবাহের তেমন প্রচলন হয়নি। সেক্ষেত্রে কৃষ্ণ কৃপালনি বাঙালি পর্যন্ত ছিলেন না। অথচ তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের কাছে নন্দিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ এককথায় রাজি হয়ে সকলকে তাজ্জব করে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

আসলে মীরাদেবীর অসুখী দাম্পত্য রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন অপরাধী করে রেখেছিল। মীরা দেবীর মেয়ের সুখী দাম্পত্যজীবন হোক—এই স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথও দেখতেন। রবীন্দ্রনাথের চোখে কৃষ্ণ কৃপালনি ছিলেন আদর্শ ভদ্রলোক। তাই আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ তখন সমাজের সব অর্থহীন দ্বিধার শিকল কাটিয়ে উঠেছেন অনেকটাই।

রবীন্দ্রনাথ যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন নন্দিতা সেবা করেছিলেন একমনে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্য লিখেছিলেন—
‘দিদিমণি—
অফুরান সান্ত্বনা খনি।
কোনো ক্লান্তি কোনো ক্লেশ
মুখে চিহ্ন দেয় নাই লেশ।
কোনো ভয় কোনো ঘৃণা
কোনো কাজে কিছুমাত্র গ্লানি
সেবার মাধুর্যে ছায়া নাহি দেয় আনি।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর স্বামীর সঙ্গে একই মাধুর্য নিয়ে দেশের সেবায় ব্রতী হয়েছিলেন নন্দিতা। অহিংস আন্দোলনের অংশ ছিলেন তিনি। সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির আরো অনেক মেয়েও ছিলেন। কারাবরণও করেছিলেন। জেল থেকে চিঠি লিখতেন মাকে। সেসব চিঠি একটা বিশেষ সময়ের দলিল। আশ্চর্য সুন্দর ভাষার দখল ছিল তাঁর। শান্তিনিকেতনে বাটিক, চামড়ার কাজ, ব্লক প্রিন্টিঙের কাজ করতেন মগ্ন হয়ে। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়,রামকিংকর বেইজ ছিলেন শিক্ষক। এখনও চিনাভবনের দেওয়ালে তাঁর একটি শিল্পকাজ রয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ। সহজাত শিল্পী বলেই হয়তো।

ভারতের স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণে সুচেতা কৃপালনি এবং নন্দিতা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলেন। কৃষ্ণ কৃপালনির জীবনে তিনি ছিলেন যথার্থ ছায়াসঙ্গিনী। বিদেশে গিয়ে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের নৃত্যাভিনয় শিখিয়ে এসেছিলেন নন্দিতা। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। গল্পও লিখতেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

স্কুলে নাচ শেখাতেন। তাঁর বাবা এবং মায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না, বিচ্ছেদও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নন্দিতা পৃথকভাবে দু’ জনেরই দেখাশোনা করেছেন। তাও নিজের অর্জিত অর্থে। তিনি জোর গলায় বলতেন, মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়াটা খুব জরুরি। শান্তিনিকেতন আশ্রম নিয়ে শেষজীবনে তাঁর একটা হতাশা তৈরি হয়েছিল। আসলে রবীন্দ্রনাথের আদর্শের শান্তিনিকেতন তাঁর দুচোখে স্বপ্নের মতো জেগেছিল। অকালমৃত্যু তাঁর অনেক কাজকে অসমাপ্ত রেখে দিয়েছিল। একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রেও অংশ নেওয়ার কথা ছিল তাঁর। জীবনে তো সব স্বপ্ন পূর্ণ হয় না।

অদৃশ্য জীবনীকার কার জন্য কতটুকু সময় এবং কাজ বরাদ্দ করে রেখেছেন, তিনিই জানেন। নন্দিতা কৃপালনি বহু চর্চিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রচর্চায় তাঁরও ভূমিকা রয়েছে, একথা অস্বীকার করা যায় না। আধুনিক মেয়েদের জীবনের অনুচ্চারিত বিপ্লবের প্রতীক ছিল তাঁর জীবন। সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে তিনি রইলেন মহীয়সীর মতো।

ঋণ স্বীকার
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content