বুধবার ২৭ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

ভাগ্যই হল বলবান। না হলে, দূর আকাশের নির্জন প্রদেশে বিচরণ করে যে সব পাখিদের দল, তারাও কি করে এইরকম বিপদে ফেঁসে যায়! গভীর সমুদ্রের মাছেরাও আটকে পড়ে জেলেদের চাতুরীতে। এর থেকেই তো মনে হয় যে, এই সংসারে সুনীতি-দুর্নীতি বা পাপ-পুণ্য বলে আসলে কিছুই হয় না। সুরক্ষিত বা অসুরক্ষিত স্থানে বাস করাটাও নিরাপদ নয়। কালই একমাত্র সত্য। সে তার লম্বা বাহুদুটি বের করে প্রতিক্ষণ জগতের সকল প্রাণীদের গ্রাস করে “কালঃ সর্বজনান্‌ প্রসারিতকরো গৃহ্ণাতি দূরাদপি”।

এইসব অনেক কথা বলে হিরণ্যক তার তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁত দিয়ে প্রথমেই যখন কপোতরাজ চিত্রগ্রীবকে মুক্ত করতে জাল কাটতে যাবে ঠিক সেই সময়ে চিত্রগ্রীব তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, হে ভদ্র! এমন করবেন না। প্রথমে আমার অনুচরদের বন্ধন মুক্ত করুন—তাদের পাশ আগে কাটুন। তারপর আমাকে মুক্ত করবেন— “প্রথমং মম ভৃত্যানাং পাশচ্ছেদং কুরু। তদনু মমাপি।”

রাজার ব্যবহারটা খেয়াল করুন। ভৃত্যদের আগে বিপদমুক্ত করতে এগিয়ে যাওয়াটাই রাজার প্রথম কর্তব্য। চিত্রগ্রীবের ধর্মবিচারটি রাজা সম্পর্কে চিরন্তন ভারতীয় পরম্পরারই বাঙ্ময়রূপ মাত্র। অমরশক্তি দুর্মেধা তিন পুত্রকে রাজনীতি-কূটনীতির পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয় ধর্মনীতিটিও বলতে ভুলে যাননি পঞ্চতন্ত্রকার। তবে কূটদৃষ্টি দিয়ে দেখতে হলে বলবো কপোতরাজ চিত্রগ্রীবের ব্যবহারটি ধুরন্তর রাজনীতিবিদ্‌দের মতোই। চরম বিপদের সময় নিজের প্রাণ বাঁচাতে নীতিশাস্ত্রকারেরা বলেন, “আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি”।
নিজেকে সব সময় আগে বাঁচাতে হয় প্রয়োজনে নিজের টাকাপয়সা, এমনকি বউকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে। সেখানে চিত্রগ্রীব যখন আগে অনুচরেদের বন্ধনমুক্ত করতে বলছেন, তখন যারা সবকিছু বক্রভাবে দেখেন তারা বলবেন, আসলে চিত্রগ্রীব এখন হিরণ্যকের কাছে এসে নিজেকে বিপদমুক্ত বুঝেই এতসব কথা বলছে। প্রকাশ্যে তাই এখন আদর্শ রাজধর্মের মুখোশ পরছে। জানে যে পাশছেদনের কাজটা একটু আগে পরে হলেও বিশেষ কিছু আসবে যাবে না। \

কিন্তু এইটাই যদি বিপদের সময়ে হতো তাহলে ক’জন রাজার রাজধর্ম স্মরণ থাকতো সেইটাই দেখার। লোকে বলে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তাই এইটাও একটি শিক্ষা যে নিরুপদ্রব অবস্থায় রাজাকেও প্রজাবত্সলতার নাটক করতে হয়। সবসময় রাজভাব দেখিয়ে প্রথম সুযোগ-সুবিধা নেওয়াটাও একরকম বোকামি। মিত্রভেদ অংশে তো পঞ্চতন্ত্রকার রাজাকে গণিকার মতন অভিনয় নিপুণ হতে হবে বলে উল্লেখই করেছেন। সময় বিশেষে তিনি দয়া করবেন আবার সময় বিশেষে দণ্ডও দেবেন।

যাইহোক অবান্তর কথা পাশে রেখে আমরা মূল কাহিনীতে ফিরে আসি। অনুচরদের আগে বন্ধন মুক্ত করবার কথা শুনে হিরণ্যক কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “ভোঃ ন যুক্তমুক্তং ভবতা”। ওহে একথাটি তো আপনি ঠিক বললেন না। কারণ নীতি বলে, “স্বামিনোঽনন্তরং ভৃত্যাঃ”। স্বামীর পরেই ভৃত্যদের স্থান।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬: কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৮: নির্দোষ প্রাণীহত্যা কী সমর্থনযোগ্য?

চিত্রগ্রীব শান্ত স্বরে বললেন, হে সৌম্য! এমন বলবেন না। এই বেচারারা সকলেই আমারই আশ্রিত। আমারই বাহুবলের ভরসায় এরা আমার সঙ্গে থাকে। আমারই উপর ভরসা করে নিজের নিজের স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়-পরিজনকে ছেড়ে আমার সঙ্গে চলাফেরা করে। তাই এইটুকু সম্মানও কি এঁদের প্রতি আমার করা উচিত নয়? শাস্ত্রে বলে—
যঃ সমানং সদা ধত্তে ভৃত্যানাং ক্ষিতিপোঽধিকম্‌।
বিত্তাভাবেঽপি তং দৃষ্ট্বা তে ত্যজন্তি ন কর্হিচিৎ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি ২৩)


যে রাজা সবসময়ে নিজের সেবকদের অধিক সম্মান প্রদর্শন করেন সেই সেবকেরা বৈভবের সময়ে পাশে তো থাকেই এমন কি যখন রাজা রাজ্য বা ক্ষমতা হারিয়ে হীনবৈভব হন তখনও তারা রাজাকে ছেড়ে যায় না। সত্যি বলতে লোকের বিশ্বাস অর্জন করাটাই রাজার আসল ঐশ্বর্য। এরজন্য টাকাপয়সা খরচ করতে হয় না। রাজার কাছ থেকে সেই বিশ্বাসটুকু পেলেই লোকে তাকে ঘিরে রাখে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যেতে পারে, একটি হাতিও যে তার দলের রাজা হয় সে কি টাকাপয়সা খরচ করেছে বলে? হাতির তো সেটা করা সম্ভব নয়। সে দলের রাজা হয় এই কারণে যে “বিপদের সময়ে সে অন্যদের রক্ষা করতে পারবে” এই বিশ্বাস সকলের মনে জন্ম দিতে পারে তাই।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

এই কথাগুলো ধর্মনীতির মতো শোনালেও ভুললে চলবে না আসলে এই গ্রন্থটি কিন্তু কূটনীতির। আমাদের আশেপাশে তাকালেই দেখতে পাবো যে হাজার হাজার লোকে চিরকাল যে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকে সেটা শুধু এই ভরসাতেই যে তারাবিপদে-আপদে বা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজ নেতাদের পাশে থাকবে তাই। নির্বাচনের সময়ে প্রতিশ্রুতির বন্যায় বা কাজে কর্মে জনগণের মনে এই বিশ্বাসটুকু যদি কোনও রাজনৈতিক দল অর্জন করতে পারে তাহলেও তাদের কার্যসিদ্ধি।

মানুষের মনে যতদিন এই বিশ্বাস থাকে যে সেই রাজনৈতিক দল বা তার মুখপাত্র তাদেরকে রক্ষা করবে ততোদিন মানুষ চিন্তাহীন হয়ে তার পাশে পাশে থাকে। সত্যি বলতে বছরের পর বছর তার কাছে বিন্দুমাত্র উপকারটুকু না পেয়েও তার পাশে থাকে। তারা এই বিশ্বাসে পাশে থাকে যে সেই রাজনৈতিকদল তার পাশে আছে। কিন্তু যেদিন বুঝতে পারে এই সবটাই মিথ্যা। আসলে তার পাশে রাজা নেই। তখনই তার মোহভঙ্গ হয় এবং রাজনৈতিক পালাবদলের খেলাটাও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ধর্মনীতি বলে, সত্যিই যদি এমন রাজা বা রাজনৈতিক দল থাকে যারা শুধু কথায় নয়, কাজেও মানুষের পাশে বরাবর থাকে, মানুষ কিন্তু সেই রাজা বা রাজনৈতিক দলের সুসময়ের মতন দুঃসময়েও পাশেই থাকে।

এইরকম রাজা বা রাজনৈতিক দলের জনসমর্থন কখনও কমে না। তাই রাজার ছেলেদের এইটাও শিখতে হবে যে তারা কি শুধু কথায় এবং আচরণেই প্রজাবর্গের পাশে থাকবে? নাকি কাজেও পাশে থাকবে? ভুলে গেলে চলবে না যে কপোতরাজ চিত্রগ্রীবের কথাগুলো কেবল শিশুপাঠ্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। করা হয়েছে এমন এক গ্রন্থে যে গ্রন্থের লেখক দাবি করেন যে এই গ্রন্থ পড়ে ছ’মাসের মধ্যে রাজপুত্রেরা যদি রাজনীতিতে অনন্যসাধারণ না হয়ে উঠতে পারে তবে তিনি স্বনাম পরিত্যাগ করবেন।

তাঁর দাবি অনুযায়ী এই গ্রন্থ চর্চা করলে লোকে রাজনীতিতে দেবরাজ ইন্দ্রকেও পরাজিত করতে পারবেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই গ্রন্থটিকে কেবল একটি শিশুপাঠ্য গ্রন্থের মতো পড়লে চলবে না। প্রতিটি গল্পের প্রতিটি ছত্রে বিচার করে দেখতে হবে কেন পঞ্চতন্ত্রকার এই গল্পটি এখানে নিয়ে এলেন বা কেন কাহিনির পাত্রদের মুখ দিয়ে এই কথাগুলি বলাচ্ছেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

রাজনৈতিক তথা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসিদ্ধির উপায় যে শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়েছে সেই শাস্ত্রই হল ‘অর্থশাস্ত্র’। এ শাস্ত্র একজন উন্নতিকামী রাজা বা শাসকের অবশ্যপাঠ্য একটি গ্রন্থ। সেই অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বই বলছেন পঞ্চতন্ত্রকার এখানে গল্পের মোড়কে। তাই গল্পের মাঝে মাঝে সেইদিকেও খেয়াল করতে করতে যাওয়া প্রয়োজন।

যাইহোক তত্ত্বকথা রেখে আবার গল্পে ফেরা যাক। উপরে চিত্রগ্রীবের সোজা কথাগুলো অনেক বাঁকা ভাবে এখানে আলোচনা করা হলেও মনে রাখতে হবে সব মানুষ কিংবা সব রাজাই কিন্তু জটিল হন না। ব্যতিক্রম কিন্তু সব জায়গাতেই থাকে। সত্যি বলতে কপোতরাজ চিত্রগ্রীব এমনই একজন প্রজাবত্সল ব্যতিক্রমী রাজা ছিলেন। হিরণ্যককে যে তিনি তাঁর সকল অনুচরদের বাঁধন আগে কেটে দিতে অনুরোধ করেছিলেন তার পিছনে ভিন্ন কারণ ছিল। চিত্রগ্রীবের অনুরোধে হিরণ্যক যখন কিছুটা ইতস্তত করছিল তখন চিত্রগ্রীব তাঁর আশঙ্কার মূল কারণটি খুলে বলল।

চিত্রগ্রীব বলল, যদি পূর্বে আমার জাল কাটতে গিয়েই আপনার দাঁত ভেঙে যায়? বা সেই দুরাত্মা শিকারীটি যদি আবার এসে উপস্থিত হয়? তাহলে আমার নরকবাস ছাড়া পরকালে আর কিছুই লেখা নেই ভাই। পণ্ডিতরাও সে কথাই বলেছেন। যে স্বামী বা প্রভু তাঁর সচ্চরিত্র সেবকদের কষ্টের সময়েও তাদের দিকে মনোনিবেশ না করে কেবল নিজের সুখই খোঁজে তাঁর এই সংসারে তো বটেই পরলোকেও তাঁর নরকেই গতি হয়।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা

এ বার সেই মুষিক-হিরণ্যক কপোতরাজ-চিত্রগ্রীবের কথা শুনে অত্যন্ত খুশী হয়ে বলল, ওহে বন্ধু! রাজধর্ম আমিও জানি। কিন্তু আমি তোমার একটু পরীক্ষা নিলাম — “ভোঃ বেদ্ম্যহং রাজধর্মম্‌। পরং মযা তব পরীক্ষা কৃতা।” আপনার এই ন্যায়ধর্মের জন্যেই আপনার অনেক প্রজাবৃদ্ধি হবে। বহু কপোত পরিবার চিরকাল আপনার সঙ্গে থাকবে। শাস্ত্রে বলে, যে রাজার নিজের সেবকের প্রতি সর্বদা করুণা ও কৃপাদৃষ্টি বজায় থাকে সে রাজা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল।

এই তিনলোককেই অনায়াসে রক্ষা করতে পারে। কারণ সেই রাজার সেবকেরা সব সময়ে সেই সহৃদয় রাজার সঙ্গে থাকে আর অর্থশাস্ত্র বলে “সহাযসাধ্যং রাজত্বং চক্রম্‌” রাজত্ব একটা বিশাল রথের মতো। রথ যেমন একচাকায় চলে না, রাজত্বও তেমনই। তার জন্যে একাধিক দ্বায়িত্বশীল লোকের সহায়তার প্রয়োজন হয়। ফলের রাজাকে সাহায্য করার যথার্থ লোক যদি পাশে থাকে তাহলে তাহলে একজন রাজা কেবল ত্রিলোক কেন? তিনি সপ্তলোক শাসন করতে পারেন।

এই বলে সেই চিত্রগ্রীব সকল পায়রাদের জাল মুক্ত করে দিয়ে বললেন, ওহে মিত্র! এবার আপনারা নিজ নিজ আশ্রয়ে ফিরে যান। আবার কখনও বিপদ উপস্থিত হলে বন্ধুকে স্মরণ করতে ভুলবেন না। কপোতরাজ তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে সকলকে নিয়ে ফিরে গেলো নিজেদের আশ্রয়ে আর হিরণ্যকও আবার সেই বিলদুর্গে প্রবেশ করলো। সত্যি বলতে, যে মানুষের বন্ধুর সহায়তা থাকে সে কঠিন থেকে কঠিনতর কাজও অনায়াসে সম্পন্ন করে দিতে পারে। এই জন্যেই সবসময় ভালো বন্ধু তৈরি করতে হয়। মিত্রসম্পদ সবচেয়ে বড় সম্পদ—
মিত্রবান্‌ সাধযত্যর্থান্‌ দুঃসাধ্যানপি বৈ যতঃ।
তস্মান্‌ মিত্রাণি কুর্বীত সমানান্যেব চাত্মনঃ।। (ঐ, ২৭)

—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content