নেতাই বুধুনি ঘাট।
শান্তনু মুনির সুন্দরী শ্রী অমোঘার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন স্বয়ং ব্রহ্মা। ব্রহ্মা এবং অমোঘার একটি পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। সেই পুত্র ছিল তেজস্বী জলময় সন্তান। তাই শান্তনু মুনি সেই জলকুণ্ডুকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কৈলাসের চারটি বিখ্যাত পর্বত শৃঙ্গ স্থাপিত করেলেন। চারটি পর্বত শৃঙ্গ হল—উত্তরে কৈলাসনাথ, পূর্বে সম্বর্তক, দক্ষিণে গন্ধমাদন এবং পশ্চিমে জরুধি। সেই জল রাশি ধীরে ধীরে বিশাল সরোবরে পরিণত হতে লাগল। আর তার নাম হয়ে গেল ব্রহ্মাকুণ্ডু।
এ দিকে মাতৃহত্যা করার পর পরশুরামের হাত থেকে কিছুতেই সেই কুঠার পড়ে যাচ্ছিল ছিল না। মাতৃ হত্যার পাপ বোধ থেকে যেন সেটি তাঁকে জড়িয়ে রেখেছিল। মুনি ঋষিরা পরশুরামকে সেই ব্রহ্মাকুণ্ডুতে গিয়ে স্নান করতে পরামর্শ দেন। পরশুরাম সেই কুণ্ডের জলে হাত ধুয়ার ফলে সেই কুঠারটি খসে পরে যায়। পরশুরাম এই জলের মাহাত্ম্য বুঝতে পেরে সাধারণের মানুষের মঙ্গলের জন্য তার বাঁধ কেটে দেন। এই কুণ্ডের বিশাল জল রাশি সমতলে নেমে আসে। ব্রহ্মার পুত্র বলে এই নদের নাম হয় ব্রহ্মপুত্র।
আরও পড়ুন:
অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩৩: শিবসাগরে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের বহু নিদর্শন
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৭: যাজ্ঞসেনী স্বয়ংবরা দ্রৌপদী কি শুধুই প্রতিহিংসার বাতাবরণ বিনির্মাণ করেন?
অসম এবং ব্রহ্মপুত্র এ যেন অবিচ্ছেদ্য দুই নাম। অসমের সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সেখানকার মানুষের নিত্য দিনের সুখ-দুঃখ, জীবিকা সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই নদ। লোহিত, ছিরি লোহিত, লৌহিত্য ইত্যাদি অনেক নাম রয়েছে এই নদের। চিন, ভারত, বাংলাদেশ এই তিন দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে ব্রহ্মপুত্র। হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও অসমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এই ব্রহ্মপুত্রেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী দ্বীপ মাজুলি। এই দ্বীপকে অসমের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র বলা হয়ে থাকে। মজুলি শ্রীমন্ত শংকর দেব এবং তাঁর শিষ্য মাধব দেবের সংযোগ স্থল হিসেবে অসমের বৈষ্ণব মতাদর্শীয় নাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম কেন্দ্র। জোরহাট থেকে ব্রহ্মপুত্রের বুকে ফেরি করে মজুলি যাওয়া যায়। নদী পথের এই যাত্রার এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক
ব্রহ্মপুত্রের পাড়েই রয়েছে আরও একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা ধুবরি। এর সঙ্গে পৌরাণিক গল্পের এক যোগ সূত্র রয়েছে। ধুবরী শব্দটি এসেছে ধুবি বা ধোপা শব্দ থেকে, অর্থাৎ যাঁদের পেশা কাপড়চোপড় ধোয়া। বলা হয় পদ্মপুরাণ আখ্যানের লখিন্দর -বেহুলার কাহিনির সঙ্গে এই জায়গার নাম জড়িয়ে রয়েছে। পদ্মপুরাণের কাহিনি অনুযায়ী, চাঁদ সদাগরের সাত সাতটি পুত্রকে দেবী মনসার আদেশে শাপ সংশন করে। চাঁদ সদাগরের কনিষ্ঠ পুত্রকে সাপে কামড়ালে মৃত স্বামীর জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁর স্ত্রী বেহুলা লখিন্দরের মৃত দেহ নিয়ে কলার ভেলায় করে যাচ্ছিলেন মনসার কাছে পৌঁছনোর জন্য। ওই কলার ভেলা ভাসতে ভাসতে এক সময় এই ধুবরির ঘাটে এসে পৌঁছয়। এই ঘাটে নেতা দেবতাদের কাপড় ধুতেন। নেতার সাহায্যে বেহুলা মনসা পর্যন্ত পৌঁছন। শেষমেশ অনেক কষ্টে স্বামীর প্রাণ ফিরে পান বেহুলা। ধুবরি শহরে আজও রয়েছে সেই নেতার ঘাট, যা নেতাই ধুবরির ঘাট নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো
ব্রহ্মপুত্রের পাড়েই রয়েছে মহানগরী গুয়াহাটি। গুয়াহাটিকে কেন্দ্র করেও রয়েছে অনেক পৌরাণিক গল্প। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের একদিকে যেমন রয়েছে অনেক জনশ্রুতি, তেমনি রয়েছে সভ্যতার অগ্রগতির ছাপও। ব্রহ্মপুত্রের বুকে গড়ে উঠতে দেখা গিয়েছে একাধিক সেতু। সাধারণ মানুষের জীবনে এই সব সেতুর ভূমিকা যথেষ্ট। সরাইঘাট সেতু, কালিয়া ভোমরা সেতু, নরনারায়ণ সেতু, ড. ভূপেন হাজারিকা সেতু এবং বগিবিল সেতু ব্রহ্মপুত্রের উপর নির্মিত বড় সেতু। ব্রহ্মপুত্রের বুকে প্রথম সরাইঘাট সেতু নির্মাণ হয়েছিল ১৯৬২ সালে। তার আগে ফেরিই ছিল একমাত্র ভরসা। ১৬৬৯ সালে আহোম রাজা চক্রধ্বজ সিংহের রাজত্বকালে দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর সেনাপতি রাম সিংহের নেতৃত্বে এক বিশাল সেনা অসম জয় করার জন্য পাঠান। সেই বিশাল সেনাবাহিনীকে অসমের বীর সেনাপতি লাচিত বরফুকন তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই ব্রহ্মপুত্রের বুকেই যুদ্ধ করে অসমকে মোঘলের অধীনে যেতে দেননি। সেই যুদ্ধে সরাইঘাট একটি বিশেষ স্থান। এই যুদ্ধ সরাইঘাট যুদ্ধ হিসেবেই বেশি পরিচিত।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা
ব্রহ্মপুত্র নদ এবং তার উপত্যকাকে ঘিরে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক কিংবা পৌরাণিক গল্প। ব্রহ্মপুত্র একদিকে যেমন অসমের গৌরব, ঠিক তেমনি অতিরিক্ত বর্ষায় তার উত্তাল জলরাশি অসমে বন্যা ডেকে আনে। আসলে প্রকৃতি তার নিজস্বতা নিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু আধুনিক জীবনের প্রয়োজন মেটাতে আমাদেরকে হাত দিতে হয় প্রকৃতির পরিসীমায়। আর তাতেই প্রকৃতি হন বিরূপা, যার ফল ঘন ঘন বন্যা। বিশাল জলরাশির এই ব্রহ্মপুত্রের বুকে যাতে পলি না পড়ে, নালা নর্দমায় যাতে জল জমা না হয়—এসব বিষয়ে সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রক বিভাগকে নিতে হবে শক্ত পদক্ষেপ।—চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।।