শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


জাতিঙ্গা।

পৃথিবীর চার পাশে রয়েছে বিভিন্ন অশ্চর্যকর জিনিস। কত জায়গার কত গল্প। রাজ্য হিসেবে অসমের বন্ধুর মাটির ভৌগোলিক পরিসীমা খুব একটা কম নয়। তাই অসমের বুকেও একাধিক এমন স্থান রয়েছে যা কৌতুহলী মানুষের আকর্ষণের বিষয় হয়েছে।

অসমের জাতিঙ্গা এমনই একটি রহস্যময় গ্রামের নাম। ডিমা হাসাও জেলার হাফলং শহরের কাছে একটি ছোট গ্রাম জাতিঙ্গা। মাচরাঙা, বক, ব্লাক, বিটার্ন, টাইগার বিটার্ন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পাখি আসে এখানে এবং মৃত্যু বরণ করে। তবে পরিযায়ী পাখি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। হাফলং অসমের শৈল স্টেশন। প্রকৃতি নিজের হাতে যেন সাজিয়ে দুলেছে এই পার্বত্য অঞ্চলকে। সবুজ, ঝর্না, পাহাড় আর পাখি সব মিলিয়ে সুন্দরের আরেক নাম হাফলং। আর এই হাফলংয়ের কাছেই রয়েছে রহস্য ঘেরা জাতিঙ্গা।
পাহাড়ের গায়ে ঘেষা একটি ছোটো সুন্দর গ্রাম, যা কি না পাখিদের মৃত্যু উপত্যকা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু স্বাধীন পাখি যে আকাশের বুকে নিজের মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় সে কেন আত্ম হত্যা করবে? তাও কি না একেবারে দল বেঁধে। নিদৃষ্ট সময়ে পাখির মৃতদেহের যেন বৃষ্টি হয় এখানে। এ ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। বর্ষাকাল শেষ হবার পরই শুরু হয় এই অদ্ভুদ ঘটনার। ১৪-১৫ অগাস্ট এর থেকে অক্টোবরের শেষের দিক পর্যন্ত জাতিঙ্গার রাস্তায় দেখা যায় পাখির মৃত দেহের ভিড়। মূলত অন্ধ্যকার রাতে অর্থাৎ চাঁদ আকাশ থাকলেই উপর থেকে টপ টপ করে পড়ে পাখির মৃত দেহ।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৩১: জাদুবিদ্যা ও তন্ত্রসাধনা নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক অজানা কাহিনি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে মানুষ আসেন স্বচক্ষে এ ঘটনা দেখতে। মশাল কিংবা কোনো আগুন দেখে আকাশে উড়তে থাকা পাখিরা ঝাঁপিয়ে পরে আত্মহত্যা করে। শোনা যায়, এক সময় এ অঞ্চলে নাগাদের বসবাস ছিল। এক বর্ষামুখর অমাবস্যার রাতে গৃহপালিত এক পশুকে ঝুঁজতে বেরিয়েছিলেন কয়েকজন। তাদের হাতে ছিল মশাল। কিছু সময়ের মধ্যেই পাখিদের মৃতদেহ বৃষ্টির মতো তাদের উপর পড়তে থাকে। নাগারা ঘটনাটিতে খুব স্বাভাবিক ভবেও ভয় পেয়ে যায় এবং এ স্থান ছেড়ে চলে যায়। এ ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করা শক্ত।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ

১৯৫৭ সালে অসমের জাতিঙ্গার কথা গোটা বিশ্বে সামনে আনেন পক্ষীবিশারদ ইপিগি। তিনি তাঁর বই ‘দ্য ওয়াইল্ড লাইফ অফ ইন্ডিয়া’তে এ নিয়ে অনেক তথ্য তুলে ধরেন। স্থানীয়রা মৃত পাখিদের মাংস খান। বহু মানুষের আগমন ঘটে তখন সেখানে। এখানকার বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন এ কোনো অলৌকিক ঘটনা। অনেকের মতে, দুষ্ট আত্মারা শাস্তি দেবার জন্যই এমনটা করে। সন্ধেবেলা থেকে রাত দশটার মধ্যেই এই অদ্ভুদ ঘটনাটি ঘটতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ

অসমে বন্যা প্রায় প্রতি বছরই হয়। এই বন্যার সময় পাখিরাও নিজেদের আশ্রয়স্থলটি হাড়ায়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাসস্থানের খোঁজে তারা যাত্রা করে। পরিস্থিতির জন্য কিছুটা বিশাদ গ্রস্থও হয়ে পড়ে তারা। যাত্রাপথে পড়ে জটিংঙ্গা। গ্রামের আলো দেখে বিহ্বলিত পাখিরা দ্রুত নেমে আসে, আর অনেক সময় বাতাসে কিংবা ধোঁয়ায় দিশেহারা হয়ে কোনও কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খায়ে মাটিতে পড়ে যায় আর মৃত্যু হয়। ১৯৮৮ সালে অসমে প্রচুর বন্যা হয়, সেই সময় পাখিদের মৃত্যুর হারও যথেষ্ট বেশি ছিল।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

আবার অনেকে মনে করেন ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে যাওয়ায় আর স্থানীয় মানুষ বাঁশ বা লাঠি দিয়ে পাখিদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। বিভিন্ন ধরনের পাখি আসে এখানে। ১৯৭৭ সালে জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষীবিশেষজ্ঞ ড. সুধীন সেনগুপ্ত পাখিদের এই আত্মহত্যা সম্পর্কে অনেক গবেষণা করেন। তাঁর মতে, আবহাওয়া এবং এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে এর পিছনে। তিনি মনে করেন, জাতিঙ্গা পাহাড়ের উপরিভাগে উচ্চ চুম্বক শক্তি যুক্ত খনিজ পদার্থ রয়েছে। এ দিকে অতিরিক্ত বৃষ্টির এখানে প্রতিবছর হয় ফলে মাটিতে জল এবং খনিজ পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। বায়ু চাপেও হটাৎ পরিবর্তন হয়ে যায় অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে তাছাড়া ভূ-চুম্বক, মধ্যকর্ষণ শক্তি ইত্যাদিতে পরিবর্তন হয়। এ সমস্ত বিষয় গুলি পাখিদের স্নায়ুর উপর প্রভাব ফেলে ফলে তারা নিজেদের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মারা যায়।

জাতিঙ্গা বার্ড ওয়াচ টাওয়ার।

এই অদ্ভুদ ঘটনা যেমন পুরো জাটিঙ্গা জুড়ে হয় কিংবা হাফলংয়ের অন্য কোথাও হয় না তেমনি যেকোনও দিন পাখিদের এমন মৃত্যু হয় না। আবহাওয়া হতে হবে মেঘলা ,কুয়াশা থাকবে, একটু একটু বৃষ্টি হলে এমন পরিস্থিতির সম্পূর্ণতা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাতাস বইবে, আকাশে চাঁদ দেখা যাবে না।

বিজ্ঞানের সঠিক যুক্তি এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকদের ধারণা মেনে নিতেই হয়। তবে একই সঙ্গে একথাও মেনে নিতে হয় যে, পৃথিবীতে কত যে এমন আশ্চর্য জায়গা রয়েছে তার হিসেব নেই। প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং রহস্য যখন হাত মেলায় তখন জিজ্ঞাসু মনে হাজারো উকি দেয়। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সেই সব না জানা তথ্য সামনে আসবে হাজার প্রশ্নের সমাধান নিয়ে।—চলবে।
*ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content