রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।

মন্ত্রদান করার আগে মা সারদা তাঁর ভক্তদের ব্যক্তিগত ও কুলপরম্পরাগত সংস্কার দেখে নিতেন। দুটি সংস্কার প্রায়ই একে অপরের অনুরূপ হলেও এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। শশিভূষণ মুখোপাধ্যায় মা সারদার কাছে শক্তিমন্ত্র নিতে চান। শ্রীমা তাঁকে বলেন, “তোমার ভিতরে তো বাবা, রামকে দেখচি। তোমাদের বংশে কি সকলে রামমন্ত্রের উপাসক? রাম আর শক্তি তো আলাদা নয়। তবে আর রামমন্ত্র নিতে আপত্তি কি?”
সত্যই তাঁরা কুলপরম্পরায় রামমন্ত্রের উপাসক ছিলেন। ব্রাহ্মণের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে মন্ত্র দেবার আগে শ্রীমা জানতে চেয়েছিলেন যে, তাঁর কোন মূর্তি ভাল লাগে। তিনি বলেন, “শিবের কোলে কালী বসে আছেন, এমনটি আমার খুব ভাল লাগে।” শুনে শ্রীমা বললেন, “শক্তি কি কখনও শিব ছাড়া থাকেন? তোমার জন্য শক্তিমন্ত্র।” একথা বলে মা সারদা শক্তিমন্ত্র উচ্চারণ করলে তিনি তাঁর মধ্যে যেন তড়িৎ প্রবাহ চলে গেল, এমন বোধ করলেন। তাঁর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত একটা আনন্দের ঘোর তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৭: উপবাস নিয়ে শ্রীমায়ের দৃষ্টিভঙ্গি

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৫: আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া

শ্রীমার ভক্ত সারদাকিঙ্কর রায়ের পূর্বপুরুষেরা ছিল শাক্ত। তিনি বাল্যকাল থেকে বৈষ্ণবদের সঙ্গে মিশে বৈষ্ণবভাবাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীমা তাঁকে কুলপরম্পরাগত শক্তিমন্ত্রই দান করেন। এর ফলে সারদাকিঙ্করের মনে খটকা লাগলেও তিনি মুখে কিছু বলেননি। বিকেলে যখন তিনি আবার শ্রীমার কাছে যান, তখন মা সারদা তাকে বলেন যে, তিনি তাকে ঠিক মন্ত্রই দিয়েছেন। অনেক সময় কারও ক্ষেত্রে তার ইষ্ট নিরূপণ করতে শ্রীমার যে দেরি হত, সেকথা তিনি নিজেই বলেছেন।

এক্ষেত্রে যাদের জন্মান্তরগত সংস্কার তেমন প্রবল নয় বা কর্মদোষে বাধা ঘটেছে, তাদের বেলাতেই এমন বিলম্ব হত। তবে অল্প সময়ের মধ্যে শ্রীমা সমাধিস্থ হয়ে তাদের ইষ্টকে জেনে নিতেন। শ্রীমা কারো কারো ক্ষেত্রে ইষ্টমন্ত্ররূপে ঠাকুরের মন্ত্র দিয়েছেন। কারোর বেলায় ঠাকুরের মন্ত্র ইষ্টমন্ত্রের আগে জপ করতে বলেছেন। এই বিষয়ে তারকনাথ রায়চৌধুরী লিখেছেন যে, ঠাকুরের নাম ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত সকলকে দেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

স্বামী জগদানন্দ বলেছেন, মাদ্রাজের একটি বিধবা মেয়ে শ্রীমার কাছ থেকে মন্ত্র নিয়ে বলে, “এখন থেকে আমি মন্ত্র দেব। আমাদের সব শিষ্যরা আসে, এতদিন কি মন্ত্র দিতে হয়, জানতাম না।” শুনে শ্রীমা বলেন, “না, না, নিজেরটি দিও না, আমি তোমাকে আর একটি শিখিয়ে দিচ্চি, সেটি দেবে।” মন্ত্র দিতে হলে নিজের ইষ্টমন্ত্র কখনও দিতে নেই, শ্রীমাও দিতেন না। মা সারদা যেমন ঠাকুরের নাম সকলকেই দেওয়া যেতে পারে বলেছেন, তেমনই ঠাকুরের মধ্যে সকল দেবদেবীরই পুজোর বিধান দিয়েছেন। আবার ঠাকুরের উপরে যেকোন ভাবের আরোপেও শ্রীমার সম্মতি ছিল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

কমলেশ্বরানন্দ ঠাকুরকে পতিজ্ঞানে বৈষ্ণবদের মতন মধুরভাবে ভজনা করতেন। একথা তিনি মা সারদাকে জানালে তিনি বলেন, ‘বেশ তো বাবা, তাতে কিছু দোষ নেই। ঠাকুরের সব ভাবই ছিল। তন্ময়ানন্দ আহারের সময় ইষ্টকে অন্ন নিবেদন করার জন্য মন্ত্র জানতে চাইলে শ্রীমা তাঁকে বলেন, “যে মন্ত্র দিয়েছি, ওই মন্ত্র’। এই মন্ত্রেই সকল দেবদেবীর পুজোও হবে।” তন্ময়ানন্দ জানতে চান যে, মন্ত্র না নিলে কি পুজো করা যায় না? তার উত্তরে শ্রীমা বলেন, “মন্ত্র না নিলে কি পুজো করবে? সে তো ছেলেখেলা!” মন্ত্রদান করে মা সারদা অনেক ভক্তকেই ঠাকুরের ছবি দেখিয়ে বলেছেন, “এই তোমার গুরু।” একথা শুনে সাধনানন্দ জানতে চান, “ঠাকুরই গুরু বললেন, তবে আপনি কি?”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৬: বার্নার্ড শ ও শার্লটি —তবে কেন মিছে ভালোবাসা/২

শ্রীমা বলেন, “বাবা, আমি কিছুই না, ঠাকুরই গুরু, ঠাকুরই ইষ্ট।” মা সারদার এই কথা শুনে সকল ভক্ত সন্তুষ্ট হত না। যেমন এক ভক্তকে শ্রীমা ঠাকুরের মূর্তি দেখিয়ে বললেন, “এই তোমার গুরু।” শুনে ভক্তটি বললে, “হ্যাঁ, মা, উনি তো জগদ্ গুরু।” আবার কোন ভক্তকে যখন শ্রীমা দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মাকে দেখিয়ে বলেন, “এই তোমার ইষ্ট।” তখন ভক্ত বলে ওঠে, “মা সাক্ষাতে থাকতে অসাক্ষাতে যাব কেন?” ভক্তের আন্তরিকতায় খুশি হয়ে স্মিত হেসে মা সারদা জোর দিয়ে বললেন, “আচ্ছা, বাবা, তাই-ই হবে।”—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content