শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


অ্যাঙ্করেজ। ছবি: সংগৃহীত।

অ্যাঙ্করেজ শহরটা ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরের দক্ষিণে প্রায় সাড়ে তিনশো মাইল দূরে। অ্যাঙ্করেজ হল আলাস্কার সবচেয়ে বড় শহর। এখানকার জনসংখ্যাও বেশ বেশি। ফেয়ারব্যাঙ্কস জনসংখ্যার নিরিখে আলাস্কার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। অ্যাঙ্করেজকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য মাঝারি মাপের শহরগুলোর মতোই। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে শহরের সব কিছুই এখানে পাওয়া যায়। মানে শপিংমল থেকে শুরু করে, ভালো গাড়ি কেনার জায়গা, গগনচুম্বী না হলেও বেশ উঁচু উঁচু বাড়ি, অফিস, আলো ঝলমলে ডাউনটাউন সবই এখানে দেখা যায়।
অন্যদিকে, ফেয়ারব্যাঙ্কসে এসবের কিছুই নেই। অ্যাঙ্করেজে রাস্তাঘাট ভালো। শহরের বাইরে অনেকদূর চলে গেলেও পাকা পিচঢালা রাস্তা। ফেয়ারব্যাঙ্কসের মতো কাঁচা রাস্তা এখানে দেখা যায় না। সব বাড়িতেই জল সরবরাহের ভালো বন্দোবস্ত আছে। অন্যদিকে ফেয়ারব্যাঙ্কসে শহরের একটু বাইরের দিকে হলেই নিজেকে শহর থেকে জল বয়ে নিয়ে যেতে হয় গাড়ি করে। অ্যাঙ্করেজ হলো আলাস্কার মূল বাণিজ্য কেন্দ্র। অ্যাঙ্করেজ আলাস্কার মূল বাণিজ্য কেন্দ্র। আর ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরে রয়েছে মূলত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। আর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় সেনা-ছাউনীগুলোর একটি, যার নাম ফোর্ট-ওয়েনরাইট। এই দুই সংস্থাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ফেয়ারব্যাঙ্কস, একেবারেই বাহুল্যতাবর্জিত একটা জনপদ।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪০: আমার আলাস্কা ভ্রমণের কথা গোপনই রাখতে চেয়েছিলাম

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মোটের ওপর অ্যাঙ্করেজ আর ফেয়ারব্যাঙ্কস তুলনা করতে গেলে সেই ছোটবেলায় শহর ও গ্রামের তুলনা করে রচনা লেখার কথা মনে পড়ে যায়। অ্যাঙ্করেজে সুযোগ সুবিধা অনেকটাই বেশি ফেয়ারব্যাঙ্কসের তুলনায়। আমাদের ভারতীয়দের দৈনন্দিনের দিক থেকে দেখতে গেলে সেখানকার সুবিধাগুলো আরও বেশি করে চোখে পড়ে। যেমন ভারতীয় মশলাপাতি বা দৈনন্দিন মুদিখানার দোকান অ্যাঙ্করেজেই আছে, ফেয়ারব্যাঙ্কসে নয়। আমাদের সেসব কিনতে হলে অ্যাঙ্করেজেই যেতে হয়। অবশ্য বর্তমানে বৈদ্যুতিন বাণিজ্য বা ই-কমার্সের দৌলতে অনেককিছুই চলে আসে আমাদের বাড়ির দোরগোড়াতেই তবে সব জিনিসেরই দাম বেশি। এসে পৌঁছতেও অনেকটাই বেশি সময় লাগে অন্যান্য জায়গার তুলনায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

তবে বেশ কিছু জিনিস আছে যেগুলো কিনা আনতে গেলে অ্যাঙ্করেজে যেতেই হয়। যেমন ভারতীয় খাদ্য তালিকায় জনপ্রিয় কাঁচা সব্জিপাতিগুলো বা ওই মাছ মাংস গুলো যেগুলো কিনা ভারতীয়রাই মূলত খাওয়া দাওয়া করে। যেমন পাঁঠার মাংস, রুই, কাতলা, বা ইলিশ মাছ, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন সমস্যা হল, শীত কালে ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে অ্যাঙ্করেজ যাওয়ার রাস্তাটা পুরো বরফের তলায় থাকে। ওই সময় সেখানে গাড়ি চালানো খুব বিপজ্জনক। গাড়ি পিছলে গিয়ে দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে, কুয়াশায় সব কিছু ঢেকে গিয়ে দুর্ঘটনা, মুখোমুখি অন্য গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ থেকে শুরু করে হঠাৎ করে রাস্তার ধরে বরফের পিছলে আসা পাথরে সংঘর্ষ পর্যন্ত যা খুশি হতে পারে। তার ওপরে যদি মাঝ রাস্তায় তুষার ঝড় শুরু হয় তাহলে তো আর কোনও কথাই নেই।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৭: উপবাস নিয়ে শ্রীমায়ের দৃষ্টিভঙ্গি

এই রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে প্রচুর লোকেরই মৃত্যু হয়ে থাকে। এই মৃতদের তালিকায় আমাদের চেনাপরিচিত আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক এবং গবেষকের নামও আছে। কাজেই আমরা ওই শীতকালের সময়টা আর অ্যাঙ্করেজ যাই না বা গেলেও যাই একমাত্র খুব দরকারি কোনো কাজে উড়ানে চড়ে। বছরের অন্য সময়টায় অর্থাৎ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর অক্টোবর পর্যন্ত অ্যাঙ্করেজ থেকে যা কিছু আনার দরকার সব গাড়ি বোঝাই করে কিনে এনে রেখে দিই নিজের ফ্রিজে মজুত করে যাতে শীতকালের মাস পাঁচেক চলে যায়। অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে হঠাৎ করে যদি আজ পাঁঠার মাংস খাওয়ার ইচ্ছা হয় তাহলে তার কিন্তু কোনও উপায় নেই এই ফেয়ারব্যাঙ্কসে যদি না আগে থেকে সমস্ত কিছু পরিকল্পনা করে মজুত করে রাখা হয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

তবে ফেয়ারব্যাঙ্কসের সঙ্গে অ্যাঙ্করেজের আরও বড় একটা পার্থক্য হলো এর আবহাওয়ায়। যদিও দুই শহরের দূরত্ব মাত্র সাড়ে তিনশো মাইল মতো কিন্তু অ্যাঙ্করেজের প্রশ্ন মহাসাগরের উপকূলে হওয়ার জন্য এখানকার আবহাওয়া অনেকটাই মৃদুভাবাপন্ন বা নাতিশীতোষ্ণ। অন্যদিকে ফেয়ারব্যাঙ্কস আলাস্কার সমুদ্রোপকূল থেকে অনেকটা অভ্যন্তরে হওয়ার জন্য এখানে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন। অর্থাৎ শীতকালে এখানে যেমন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে, গ্রীষ্মকালেও এখানে তেমনই বেশ গরম পড়ে। শীতকালে এখানে তাপমাত্রা নেমে যায় প্রায় -৪৫ থেকে -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো আর অন্য দিকে গ্রীষ্মকালে মাঝে মধ্যে তাপমাত্রা উঠে যায় +২৫ থেকে +৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি। অ্যাঙ্করেজে উষ্ণতার এই পার্থক্যটা অনেকটাই কম প্রশান্ত মহাসাগরের জলীয় বায়ুপ্রবাহের জন্য।—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content