ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
মিত্রভেদ
সেই চোর ব্রাহ্মণটি মনের আনন্দে সেই বণিক ব্রাহ্মণদের সেবা করতে লাগল। কিছুদের মধ্যে সেই চোরটি তাঁদের খুবই বিশ্বস্ত হয়ে উঠল। সেই বণিক ব্রাহ্মণেরা তাঁদের সমস্ত পণ্য বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আগে সেই পত্তন থেকে অনেক বহুমূল্য রত্ন কিনল। তাঁরা সেগুলি সেই চোর ব্রাহ্মণের সামনেই তাঁদের জঙ্ঘার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে স্বদেশে ফেরার উদ্যোগ নিল। তখন সেই ধূর্ত ব্রাহ্মণটি সেই বণিকদের স্বদেশে ফিরে যেতে দেখে অত্যন্ত চিন্তিত আর ব্যাকুল হয়ে ভাবল, এই এতো সব ধন-সম্পদ কিছুই তো আমি পেলাম না। বরং আমিও এদের সঙ্গেই যাই। পথে কোথাও সুবিধা মতো এদেরকে বিষ দিয়ে মেরে সমস্ত রত্নগুলোকে হাতিয়ে নেব।
এই সব চিন্তা করে সেই ধূর্ত তখন সেই বণিক ব্রাহ্মণদের কাছে এসে করুণ স্বরে বিলাপ করতে করতে বলতে লাগল, ওহে বন্ধুগণ! আমাকে এখানে একা রেখে আপনারা সকলে ফিরে যাওয়ার তোরজোর শুরু করলেন! অথচ এতদিন ধরে আপনাদের কাজকর্ম করতে করতে ভীষণভাবে আপনাদের সঙ্গে স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছি। আপনারা চলে যাওয়ার উদ্যোগ করছেন দেখে আপনাদের অনুপস্থিতির কথা চিন্তা করে আমি কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। অনুগ্রহ করে আমাকেও আপনাদের সহকারী করে সঙ্গে নিয়ে চলুন।
সেই ধূর্ত-ব্রাহ্মণের কথা শুনে সেই বণিকদের খুব করুণা হল। এত দিন ধরে সে ব্রাহ্মণের কাজে তারা প্রসন্নও হয়েছিল খুব। তাই সেই ব্রাহ্মণটিকেও স্বদেশে নিয়ে যেতে খুব একটা আপত্তি করলো না তারা।
পাঠকদের বলব, এই দাঁড় কাকেদের চিত্কারের ব্যাপারটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটা যদিও আমার জানা নেই। কিন্তু এই সব কাকেরা প্রশিক্ষণ পেলে যে অসাধ্যসাধন করতে পারে সেটা কিন্তু আমরা কিছুদিন আগেও দেখেছি। বিখ্যাত আমেরিকান পরিচালক আলফ্রেড হিচকক ১৯৬৮ সালে ‘দি বার্ডস’ বলে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। আপনাদের মধ্যে যাঁরা সেই সিনেমাটা দেখেছেন তাঁরা মনে করুন যে পরিচালক সাহেব সেই পাখিদের দিয়ে কেমন সব অসাধ্য সাধন কাজ করিয়েছিলেন। সেখানে অসংখ্য জীবন্ত পাখি হিচকক ব্যবহার করেছিলেন, যার মধ্যে বেশ কিছু দাঁড় কাকও ছিল। পরিচালকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেই সিনেমায় মোট আঠাশ হাজার (২৮০০০) পাখি ব্যবহার করা হয়েছি। তার মধ্যে প্রায় তিন হাজার দু’শো সংখ্যক (৩২০০) পাখিকে আলাদা করে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল।
‘Ray Berwick’ বলে এক অভিনেতা সেই ৩২০০ পাখির মধ্যেও ৩০টিকে আবার বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যেগুলির মধ্যে অধিকাংশই ছিল দাঁড়কাক। ফলে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতেই পারে, কিরাতের দল যদি পল্লী গ্রামের দাঁড় কাকেদের পথিক দেখলেই চিত্কার করবার অনুশীলন দিয়ে থাকে তবে সেটাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ কাকেদের শিক্ষা দিলে তারা আজকের দিনেও যেমন ছায়াছবিতে অভিনয় করতে পেরেছে, তেমন অতীতেও নিশ্চয় কোনও পথিক দেখলে তারা আওয়াজ করে জানান দিতে পারতো—এতে খুব আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে সেই পথিকের কাছে ধনসম্পদ আছে কি নেই। সেইটা জানা হয়তো সম্ভব ছিল না। তবে দূর দেশে যদি কোনও পথিক যায় তবে তাদের সঙ্গে যে পাথেয় হিসেবে বেশ কিছু সম্পদ থাকবে সেটা হয়তো একটা আন্দাজ করা যায়।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো
অদ্য বাব্দশতান্তে বা মৃত্যুর্বৈ প্রাণিনাং ধ্রুবঃ।। (মিত্রভেদ, ৪৫২)
অর্থাৎ ওরে বোকা! মৃত্যুকে ভয় পেয়ে হবেটা কি? সে কি ভীতু লোককে ছেড়ে দেয়? আজ কিংবা একশো বছর পর প্রাণিদের মৃত্যু তো নিশ্চিত। বরং যে ব্যক্তি গো-ব্রাহ্মণ রক্ষায় নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয় সে সূর্যমণ্ডল ভেদ করে পরমগতি প্রাপ্ত হয়। তাই যদি আমাকে আগে বধ করে আমার ছামড়া ছাড়িয়ে আমার শরীরের ভিতরে কিছু না পায় তাহলে হয়তো এই তিন বিপ্রবণিক প্রাণে বেঁচে যাবে। আমার একজনের জীবন এই তিন জনকে বাঁচাবে, না হলে মৃত্যু তো সামনেই দাঁড়িয়ে। তাই একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? যদি এঁদের তিনজনকে অন্ততঃ বাঁচানো যায়।
সেই চৌর-ব্রাহ্মণটি এইসব চিন্তা করে সেই কিরাতের দলকে গিয়ে বলল, ওরে কিরাতগণ! আমাদের যখন মারবিই বলে করেছিস তাহলে আমাকেই প্রথমে মেরে দেখ, কিছুই নেই আমাদের কাছে।
তখন কিরাতেরা সেই ধূর্ত-ব্রাহ্মণটিকে হত্যা করে তার শরীরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুঁজেও যখন কিছুই পেলো না তখন তারা বাকি চার ব্রাহ্মণ-বণিককে ছেড়ে দিল।
২৩ কাহিনি সমাপ্ত।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৭: ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও?
করটক আর দমনকের মধ্যে যখন এইরকম ঝগড়াঝাঁটি চলছিল ঠিক সেই সময়েই সিংহ পিঙ্গলক তার ধারালো নখ দিয়ে সঞ্জীবককে এমনভাবে ঘায়েল করে দিল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হল। সঞ্জীবকের বিশাল শরীরটাকে প্রাণহীন অচঞ্চল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পিঙ্গলকের খুবই কষ্ট হল। তার সদ্গুণাগুলোর কথাই শুধু পিঙ্গলকের মনে হতে লাগল। আপন মনেই বিলাপ করতে করতে সে বলতে লাগল—সঞ্জীবককে মেরে খুবই অন্যায় করে ফেলেছি আমি।কারণ বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে বড়ো পাপ কিছু হয় না। শাস্ত্রেও বলে, যে বন্ধুর অপকার করে, উপকারীর উপকার যে মনে রাখে না এমন অকৃজ্ঞ ও বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি ততদিন নরকে বাস করে যতদিন আকাশে সূর্য-চন্দ্রের অস্তিত থাকে। সত্যি বলতে, রাজ্যের সীমার মধ্যে থাকা কোনও জমি যদি অন্যের অধীনে চলে যায় কিংবা বুদ্ধিমান সেবকের যদি বিনাশ হয়ে যায় তাহলে সেই রাজারও নিশ্চিত বিনাশ হয়। তবে এই দুটি দৃষ্টান্তকে সমান বলাটাও হয়তো ঠিক নয়। কারণ অন্যের দখলে থাকা জমি যদিও বা কালক্রমে ফিরে পাওয়া যায় কিন্তু একজন সৎ সেবকের কোনও বিকল্প হতে পারে না।
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার
ন তস্য দোষো বক্তব্যঃ প্রতিজ্ঞাভঙ্গভীরুণা।। (ঐ, ৪৫৬)
অর্থাৎ সভার মধ্যে একবার কাউকে গুণবান বলে প্রশংসা করলে পরে যদি আবার সেই ব্যক্তিরই দোষের বর্ণনা করতে হয় তাহলে পূর্বে প্রশংসাকারী ব্যক্তিকেই মিথ্যাবাদী হতে হয়। এইজন্যেই রাজনীতিতে প্রশংসা বা নিন্দা ব্যক্তিগতস্তরে করাটাই উচিত। আজ যে অনুকুল, কাল সে প্রতিকুল হতেই পারে। সভামধ্যে তাই পূর্বেকারোও প্রশংসা করলে নিজের কাছেই পরে নিজেকে বোকা প্রমাণিত হতে হয়। ফলে তাকে শাস্তি দিতে গেলেও সভামধ্যে প্রশংসাকারীকেই মিথ্যাবাদী হতে হয়। তাই যে সঞ্জীবকের গুণের কথা আমি রোজ সভায় উচ্চকণ্ঠে প্রচার করেছি আজ নিজেই এখন তাকে হত্যা করে কিকরে সভা মধ্যেতা ন্যায়সঙ্গত বলে দাবী করব?—চলবে।