রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

অলঙ্করণ: লেখক।

ঋষি অত্রি বললেন, হে প্রভো! কলিযুগে মানবগণের পারস্পরিক সৌহার্দ্যবন্ধন কীদৃশ হবে তা যদি বিশেষরূপে ব্যাখ্যা করেন তাহলে কৃতার্থ হই। আমরা শুনেছি কলিজীবী মহাত্মাগণ সকলেই পরব্রহ্মের সাকার রূপ। তাঁরা অচিন্তনীয় ও অদ্ভুতকর্মা, কিন্তু মর্ত্যবন্ধনে থেকে তাঁদের মর্ত্যলীলা কীদৃশ হবে তা আরও আরও জানতে হৃদয় ব্যাকুল হয়, তাঁদের ভাবী আবির্ভাবের কথা কল্পনা করলে রোমাঞ্চ জাগে। হে সর্বজ্ঞ! আমাদের আলোকিত করুন।

বৈশম্পায়ন বললেন, তোমাদের জ্ঞানপিপাসা অনন্ত। তোমরা কলিজীবীদের তুল্য সর্বজ্ঞ ও বিদগ্ধ নও, জ্ঞান তোমাদের জানার ইচ্ছাকে ক্রমবর্দ্ধমান করছে। সকল বিষয় তত্ত্বতঃ না জানলে তোমাদের শান্তি নেই। কিন্তু কলিজীবীগণ বিন্দুতেই সিন্ধুসাক্ষাত্ করে মহতত্তত্ত্বজ্ঞ হন। এঁরা কলিযুগে জুলাই মাসের তিরিশ তারিখ বিশ্ববান্ধব দিবস সাড়ম্বরে উদযাপন করবেন। বহু পূর্বেই ভারতাত্মাগণ বসুধৈব কুটুম্বকমের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কলিকালে এই ভাবনার বীজ-ই বিশ্বময় হবে। এও অবশ্য নতুন নয়, অভিজ্ঞানশকুন্তলে ধীবর যখন পুরস্কারের অর্ধভাগ নগরপালকে অফার করল, তখন নগরপাল সেই বন্ধুত্বের উদযাপন করতে নতুন বন্ধু সহ সদলে শৌণ্ডিকাপণে গেল।
জন্ম থেকে মৃত্যু, মিলন থেকে বিচ্ছেদ, অর্জন থেকে বিসর্জন–কলিজীবীগণ সর্বত্রই বন্ধুবত্সল ও ভক্ষণপারঙ্গম। কুক্ষি ও কুক্ষিগত করার অভিপ্রায় এই তাঁদের মহতী অভীপ্সা। মনে হত পারে, কলিজীবীগণ স্বার্থজীবী, “আই গো আপের” মন্ত্রে দীক্ষিত। তবে এ জানা নিতান্তই অজ্ঞানাক্রান্ত। কলিজীবীগণ মূলত সৌহার্দ্যকুশল।

এই যেমন ভোজবাড়িতে মোদকলিপ্সু কলিবান্ধব “ওই ওঁকে দিন আগে” বলে মৈত্রী প্রদর্শন করেন। বিজ্ঞানী বলেন, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া আছে। এক্ষেত্রে মূল ক্রিয়ার সম প্রতিক্রিয়া বিপরীতগামী না হয়ে ভিন্নতর হয়। ধরা যাক, ‘A’ বাবু ‘B’ বাবুকে রসগোল্লা দিতে বলছেন ‘C’ বাবুর পাতে। এই হল ক্রিয়া। ‘C’ বাবু নারাজ নন, তবু তিনি শশব্যস্ত হয়ে অনাগ্রহ দেখিয়ে ‘A’ বাবুকেই দিতে বললেন। এই হল প্রতিক্রিয়া। দেখা যাচ্ছে, ‘A’ বাবু কর্তা নন। কর্তা, যিনি পরিবেশন করছেন তিনি, অর্থাৎ ‘B’ বাবু। কিন্তু ‘A’ নমস্কার বাবুই এখানে মুখ্য। ‘B’ বাবু যে ক্রিয়া করছেন, অর্থাৎ ‘C’ বাবুকে মিষ্টান্ন দিতে উদ্যত হচ্ছেন, এই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় ‘C’ বাবু কি মিষ্টান্ন পরিবেশক ‘B’ বাবুকেই খাইয়ে দেবেন? কখনওই না। তিনি ‘A’ বাবুকেই মিষ্টান্ন দিতে বললেন, আগ্রহ চেপে রেখে।

এখানে তাই প্রতিক্রিয়া ভিন্নগামী হল। বিপরীতে ‘A’ বাবুও আগ্রহ উত্তেজনা সম্বরণ করে খানিক আপত্তি জানাবেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের নিষেধ ও সঙ্গে থাকা অ্যাণ্টাসিড দেখাবেন। কিন্তু শেষে মধুরেণ সমাপয়েত্ হবেই। একেই কবি বলেছেন, কেন বঞ্চিত হব চরণে?
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৬: ম্যাঙ্গো বাইট

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

বস্তুত মৈত্রীর শর্ত হল, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। আর কলির কর্তৃত্ব ওই মিষ্টান্নের তত্ত্ব অনুসারে আপাত পরোক্ষ হবে, বন্ধুত্ব হবে ত্রিকোণ। কখনও কখনও একে প্রেম বলা হবে। এছাড়াও বহুকৌণিক মৈত্রী কিংবা রিলে রেসের তুল্য সম্পর্কবদ্ধ সখ্যও কলিতে প্রকট হবে। দিব্য দৃষ্টিতে দেখলে এই সম্পর্ক রাজপথের উচ্চে তারের মায়াজালের মতো বোধ হবে। এ থেকে বোঝা যাবে এই যে, গিভ অ্যান্ড টেকের মৈত্রীবন্ধনেই কলিযুগে মৈত্রীর বিচিত্রগতি। রাজনীতিতে শত্রুর শত্রু বন্ধুরূপে জ্ঞাত হত। কলিতে পরিচিত অপরিচিত শত্রু মিত্র সকলেই সকলের ভাই, তাকে ‘বাই বাই’ বলতে কলিতে নিমেষের ব্যবধানই যথেষ্ট। কলির দ্বিপদগণ মহান তত্ত্ববিদ বলেই এমন ক্ষিপ্রবুদ্ধি ও সর্বদর্শী।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

শাস্ত্রে বলেছে, আতুরে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, আদালতে, শ্মশানে যারা থাকে তারাই প্রকৃত বন্ধু। গীতায় অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের সখ্য ভুবনবিদিত। কলিকালে এই আদর্শ বৃহত্তর ও ব্যাপক হবে। আপন হতে বহির্গত হয়ে কলির মহাত্মা সখার দল দায়িত্ব নিয়ে বান্ধবজনকে সৌভ্রাতৃত্বের প্রেমে নিমজ্জিত করার জন্য ভিড় বাসে হস্তলাঘবে, পরীক্ষার হলে পিছনের বেঞ্চে কিংবা কাদায় পড়লে প্রকটিত হবেন। নিন্দুকের দল একে “ডোবানো” বলবেন।

কলিকালের মৈত্রীতে আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জালিক বিশেষ আলোচ্য হবে। আন্তর্জালিক মৈত্রী মূলত মায়াময়, সর্বথা অপরিমেয় ও অপরিচিত দুটি মানসের শূন্যগর্ভ সংবেদন এখানে মূলীভূত। তবে আন্তর্জাতিক মৈত্রীর স্বরূপ দুরধিগম্য হবে। তা ব্রহ্মতুল্য ধ্রুব ও সত্য। তার অস্তিত্ব যেমন নিশ্চয়াত্মক, অভাবও সংশয়াত্মক। সার্বিকভাবে কলিকালের মৈত্রী আপেক্ষিকতায় আক্রান্ত হবে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

একটি উদাহরণে এর স্বরূপ প্রতিপাদিত হতে পারে। কলিযুগের কোনও কোনও পরীক্ষার্থী বন্ধুকে পাশ করানোর ব্রত নিয়ে হলে প্রবিষ্ট হবেন। এঁরা অতীতের হরিশ্চন্দ্র, প্রহ্লাদাদির অধস্তন উত্তরপুরুষ। পরীক্ষাকেন্দ্রের বন্ধুর কণ্টকাকীর্ণ ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে এঁরা পারস্পরিক দূরত্ব হ্রাস করতে করতে একসময় পরস্পরে লীন হওয়ার উপক্রম করবেন। এঁরা মূলতঃ অংশাবতার হবেন, তাই এবম্বিধ লীলা করবেন। কখনও কখনও প্রমাদবশত এঁরা যথার্থ উত্তর দিয়ে থাকেন। আর অপ্রমত্ত হয়ে সদা সর্বদা প্রমাদ ঘটানোই এদের ব্রত হবে। বন্ধু এদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখবেন। এরাও আবার অন্যতর বন্ধুর দ্বারা চালিত হবেন। বিশ্বাস নামক বিষয়টি কেবল এরা পরীক্ষাকেন্দ্রেই চর্চা করবেন, বহির্গত হয়ে ভুলেও তাতে আস্থা রাখবেন না।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এ ভাবেই কলিতে ধান, কানে পরিণত হবে এবং কাক সেই কান নিয়ে পলায়ন করবে। বন্ধুর আদর্শে সেই পলায়নপর কাককে অনুধাবন করবে কলির প্রকৃত বন্ধুর দল। এদের নিন্দুকের দল হাবা, গঙ্গারাম ও গবেট বলবে। এভাবেই কলির মৈত্রী বিচিত্র ও আপেক্ষিক হবে। তবে এও সত্য যে, সর্বকালের মতো কলিকালেও ব্যতিক্রম থাকবে, তাদৃশ মৈত্রীও কলিকালে দুর্লভ হবে না, একেই কবি বলবেন, বিষম কালা ধুইলে ছাড়ে না। এজন্য-ই কবি মধুর হেসে বলেছেন, জানি বন্ধু জানি… কলির বিশ্বমৈত্রী প্রাচীরে গ্রথিত গজালের তুল্য পরস্পরসংবদ্ধ, বাতব্যাধির তুল্য অজেয়, গোময়ে স্ফুট কমলের তুল্য সম্ভাবনাপ্রবণ হোক, শিবমস্তু।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content