শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মা সারাদা।

স্বামীর দ্বারা নির্যাতিতা বা পরিত্যক্তা, বালবিধবা আথবা কোনও কারণে বিয়ে না হওয়া কুমারী মেয়েরা যাতে লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেদিকে মা সারদার লক্ষ্য ছিল। শ্রীমার ভক্ত প্রফুল্লমুখী বসুর কথা আগে বলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “১৩২১ সালে দেবীর বোধনের দিনে শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দেখি। তিনি কাছে ডেকে বসতে বলেন। কেন জানি না আমার সমস্ত প্রাণ আকুল করে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। তখন আমায় বিধবা বলে চেনা যেত না, চওড়া পাড়ের শাড়ি, গায়ে গয়না সব পরা ছিল।
মা সারদা প্রথম দর্শনেই বলেন, “মা, তোর স্বামী নেই?” এমন স্নেহমাখা কথা কখনও শুনিনি। চেষ্টা করেও একটা কখা বলতে পারলাম না, তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ভয় কি মা, তোমাদের ঠাকুর আছেন, তিনিই দেখবেন, শান্তি দেবেন, আনন্দ দেবেন। তোমাদের দিয়ে তিনি অনেক কাজ করাবেন। কোনও ভয় নেই মা, কোনও ভাবনা নেই”। মা সারদা শরীরনাশকারী কঠোরতার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি কখনও নিরম্বু উপবাস করতেন না। প্রচলিত বিধান মেনে এদেশের বিধবারা নির্জলা উপবাস করে থাকে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

একাদশীর দিন মা সারদা ভাত না খেয়ে লুচি খেতেন। শিবরাত্রির দিনও ঠাকুরের প্রসাদী অন্ন গ্রহণ করতেন। একবার শ্রীঅন্নপূর্ণাপুজোতে কিরণবাবুদের বাড়ীতে শ্রীমার নিমন্ত্রণ ছিল। তিনি তখন বলে পাঠালেন যে, অন্নপ্রসাদ না খেলে তাঁর শরীর ভালো থাকে না। তিনি তাদের বলেন, “তোমরা সেদিন ঠাকুরকে অন্নভোগ দেবার ব্যবস্থা করবে”। এই নিয়ে শ্রীমাকে বলতে শোনা যায়, “খেয়ে দেয়ে শরীরটা ঠাণ্ডা করে নিয়ে ভগবানকে ডাক। না করবে চুরি, না করবে দারী, খাওয়াদাওয়ায় কিছু দোষ নেই”।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

বালবিধবা শবাসনা দেবী একাদশীর দিন নির্জলা উপবাস করতে চাইলে তিনি বলেন, “আত্মাকে কষ্ট দিয়ে কি হবে? আমি বলচি, তুই জল খা”। বিধবা ছোটভাজ সুরবালা তার বাকি জীবন হবিষ্য খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি বলেছিলেন, “আত্মা যদি কোন কিছু খেতে চায়, আত্মাকে দিতে হয়। না দিলে দোষ হয়, অপরাধ হয়। আত্মা কাঁদে, আমাকে দিলে নি বলে”। অবশ্যই একথাগুলি বিধবাদের জন্যই তিনি বলেছিলেন। তাঁর সময় বালবিধবাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তাই বলে একথা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে মা সারদা, যা খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ঠিক নয়, তাও খেতে বলেছেন। মানুষের স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্যই হল, নিজের ইচ্ছানুরূপ অর্থের অনর্থ করা। সধবার বেশে থাকলেও মা সারদা নিজে মাছ খেতেন না। তিনি বলেছেন, বিধবা লক্ষ্মীমণি একাদশী করেছে শুনে ঠাকুর শ্রীমাকে বলেছিলেন, ‘আমি শাস্ত্রের পার, খুব খাবে, আর থান ধুতি যেন রাক্ষুসে বেশ’। এই নিয়ে শ্রীমার এক দূর সম্পর্কের অন্ধকাকা তাঁর কাছে মাছ না খাওয়ার কারণ জানতে চান।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

শ্রীমা বলেন, “এই বিষয়ে ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, “বেদাচার মেনে চলো, লোকাচার মেনে চলো না”। আমি মাছ খাইনা কেন, তা আমার জ্ঞানী ছেলেরা বলতে পারে বটে, কিন্তু আমাকে সমাজে ভাইদের সঙ্গে থাকতে হয়। আমি যদি মাছ খাই, এদের উপর অত্যাচার হবে”। বালবিধবা প্রমীলা বসুকে প্রথম সাক্ষাতের দিন শ্রীমা ‘সতী হও মা’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। তাঁর বড় ভাইকে বলেছিলেন, “বেশ ঠাণ্ডা মেয়েটি, অনেকদিন বাঁচতে হবে, ওকে শ্বশুরবাড়ী থেকে নিয়ে যেও না”।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৮: কালীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মহানায়ক বলেছিলেন, ‘কাউকে বলো না’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

প্রমীলাবালা লিখেছেন যে, শ্রীমা যখন কাশীতে ছিলেন তখন তিনি জববলপুর থেকে তাঁকে দর্শন করতে যান। শ্রীমা তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এখানে আসার টাকা কোথায় পেলেন। তিনি বলেন যে, ভাইরা যে টাকা দেয়, তার থেকে মাঝে মাঝে কিছু বাঁচে। শুনে শ্রীমা বলেছিলেন, ‘ভাইরা নিজেদের সংসারের মতো টাকা দেয়, তা থেকে বাঁচাবার চেষ্টা আর কোরো না, তাহলে সংসারে আসক্তি আরও বেড়ে যাবে, তাদের খরচার টাকা থেকে বাঁচালে তাদের বঞ্চিত করা হয়’। প্রমীলা বলেন যে, সে নিজ ভগিনীর একটি মেয়েকে পালনের ভার নিয়েছে। সেই শুনে মা সারদা বলেন, ‘আমাকে দেখেও কি তোমার চৈতন্য হল না? আমি রাধুকে নিয়ে কি কষ্টে পড়েচি, তা তো দেখচ’। —চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content