রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) কালি লতার পুষ্পমঞ্জরী। (ডান দিকে) কালি লতার ফুল-ফলসহ শাখা। ছবি: সংগৃহীত।

 

কালি লতা (Derris scandens)

আমাদের গ্রামের বাড়ির বাঁশ বাগানের কাছে একটা বড়সড় ঝোপ ছিল। আর সেই ঝোপ ছিল যে গাছের তাতে জানুয়ারি থেকে জুন মাসে চমৎকার থোকা থোকা ফুল ফুটত। হালকা গোলাপি রঙের ফুলগুলো দেখতে ভারি সুন্দর। আমরা গাছটাকে বলতাম কালি লতা। যদিও নামে লতা কিন্তু প্রকৃত লতানে গাছ নয়। এর কাণ্ড খুব সবল না হলেও কাষ্ঠল। আশেপাশে থাকা গাছগুলোকে অবলম্বন করে অনেকটা উঁচুতে উঠে যেত। আর যেগুলো অবলম্বন পেত না সেগুলো কিছুটা উঠে নিচের দিকে ঝুলে থাকতো। এজন্যই কালি লতার বড় ঝোপ তৈরি হত। গাছটির অবশ্য স্থান ভেদে অন্য নামও আছে যেমন নোয়া লতা, মহাজনি লতা, খোলা লতা ইত্যাদি।

কালি লতা বা নোয়া লতা হল এক ধরনের ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। গাছটি বহুবর্ষজীবী ও চিরহরিৎ। যেহেতু লতানে স্বভাব রয়েছে তাই কালি লতাকে কাষ্ঠল লতানে উদ্ভিদ বলা যায়। অবলম্বন পেলে এই গাছ ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই গাছের বাকল হয় সামান্য অমসৃণ এবং গাঢ় বাদামি রঙের। যৌগিক পাতার গঠনে বৈচিত্র্য দেখা যায়। চকচকে গাঢ় সবুজ রঙের প্রতি পাতায় ৭ থেকে ১৩ টি পত্রক রয়েছে, আর আগার দিকের পত্রকগুলো গোড়ার দিকের তুলনায় বড়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?

আগেই বলেছি, হালকা গোলাপি রঙের ফুলগুলো থোকা হয়ে ফোটে। কালি লতা গাছের আসল সৌন্দর্য এই পুষ্পমঞ্জরীতে। মধুলোভী মৌমাছিরা এই ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। এদের ফলের গঠনও বেশ ব্যতিক্রমী। চ্যাপ্টা শুঁটির মত ফলগুলোর আগা ও গোড়া দু’প্রান্ত অনেক চাপা, আর ফলের মধ্যে সাধারণত একটি বীজ থাকে। নদীর তীরে কালি লতা খুব একটা দেখা যায় না। স্থলভাগের দিকেই এদের প্রাচুর্য দেখা যায়। সুন্দরী, গেঁওয়া, ভোলা, চাঁদি, সিঙ্গরা ইত্যাদি গাছের সাথে কালি লতাকে জন্মাতে দেখা যায়। যেখানে মিষ্টি জল সহজলভ্য, জোয়ারের জলে প্লাবিত হয় না এবং বেশি পরিমাণে সূর্যালোক পাওয়া যায় সেখানে কালি লতা ভালো জন্মায়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

কালি লতার কান্ড নমনীয় কিন্তু খুব শক্তপোক্ত হওয়ায় দড়ি বা কাছির বিকল্প হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে সুন্দরবনের মানুষ এই গাছটিকে ব্যবহার করে এসেছে। এই গাছের বাকল ও মূলের বিষক্রিয়ায় মাছ ভেসে ওঠে ও মারা যায়। তাই অনেক সময় পুকুরের জলে কালি লতার বাকল বা মূল ফেলে দিয়ে সহজে মাছ ধরা যায়। কালি লতায় থাকা রাসায়নিক রোটেনোন এই বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। তবে এই বিষে আক্রান্ত মাছ মানুষ খেলে কোনও সমস্যা হয় না। কীটপতঙ্গদের ক্ষেত্রে রোটেনোন ক্ষতিকর। তাই কীটনাশক হিসেবে এই গাছটির মূল বা বাকল চূর্ণ ব্যবহার করা যায়। প্রকৃতির পক্ষেও এই রাসায়নিক ক্ষতিকর নয়। জলে বা ডাঙ্গায় এর বিষক্রিয়া ছয় দিনের বেশি থাকে না। সূর্যালোকের প্রভাবে রোটেনোনের বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। এদের বাকল থেকে নিম্নমানের তন্তুও পাওয়া যায়।

(বাঁদিকে) পান লতার পুষ্পমঞ্জরী। ছবি: লেখক। ডান দিকে) পান লতার ফল। ছবি: সংগৃহীত।

 

লৌকিক চিকিৎসা

পেশির যন্ত্রণা নিবারণে কালি লতা গাছের শুকনো কাণ্ড গুঁড়ো করে খাবারের সাথে মিশিয়ে রোগীকে খাওয়ানোর প্রাচীন পদ্ধতি থাইল্যান্ডে কিছু জনজাতির মানুষের মধ্যে এখনও দেখা যায়। তবে সুন্দরবনের মানুষ এই লৌকিক চিকিৎসার কথা জানত কিনা তা জানা নেই। হয়তো জানত। কালের প্রবাহে সেই জ্ঞান হারিয়ে গেছে। কফ, কাশি ও কোষ্ঠবদ্ধতার চিকিৎসায় এবং মূত্রবর্ধক হিসেবে কালি লতার কাণ্ডের গুঁড়ো লৌকিক ঔষধ হিসেবে কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হত। অতীতে এই গাছের মূল বেটে তা থেকে নিষ্কাশিত রস জলের সাথে মিশিয়ে সদ্য প্রসূতি মহিলার দুগ্ধ নিঃসরণ বাড়ানোর জন্য খাওয়ানোর প্রচলন ছিল। যদিও বর্তমানে এইসব ব্যবহার আর দেখা যায় না।

আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

 

পান লতা (Derris trifoliata)

পান লতা গাছটি কালি লতা গাছের খুব নিকটাত্মীয়। তবে ফুলের রং, পাতার গঠন ও ফলের গঠনে কালি লতার সঙ্গে এর অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। মিলও আছে অনেক। পান লতা গাছটি কালি লতার মতোই ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। কালি লতার মতোই এরা বহুবর্ষজীবী, চিরহরিৎ এবং কাষ্ঠল লতা। তবে কালি লতার মতো এরা অতটা লম্বা হয় না। পানলতার পত্রকের আকার কালি লতার পত্রকের থেকে অনেকটাই বড়। এর বাকল সামান্য অমসৃণ এবং গাঢ় বাদামি বা কালচে রঙের হয়। তবে বাকলের ভেতরের দিক হালকা গোলাপি বা সাদা। কান্ডের গোড়ার দিক থেকে অল্প স্বল্প বায়বীয় মূল বের হয়। কালি লতার মতো এদেরও যৌগিক পাতা, তবে পাতায় তিন থেকে পাঁচটি পত্রক থাকে। ফুলের রং হয় হালকা গোলাপি। অনেক ফুল থোকা হয়ে ফুটে থাকে। পুষ্পমঞ্জরী পাতার কক্ষ থেকে উৎপন্ন হয়ে ঝুলে থাকে নিচের দিকে। জানুয়ারি থেকে জুন মাসে ফুল ফোটে। ফলের আকার প্রায় গোলাকার শুঁটির মতো। কাঁচা অবস্থায় শুঁটির রং হালকা হলুদ বা সবুজ। প্রতি শুঁটিতে সাধারণত একটি বীজ থাকে।

আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৮: কালীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মহানায়ক বলেছিলেন, ‘কাউকে বলো না’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

পান লতার লবণ সহ্য করার ক্ষমতা মাঝারি ধরনের। তাই এরা মিষ্টি জলের কাছাকাছি যেমন জন্মাতে পারে তেমনই হালকা লবণাক্ত এলাকাতেও জন্মাতে পারে। সুন্দরবনের দ্বীপগুলিতে স্থলভাগের দিকে এদের বেশি দেখা যায়। নদীর চড়ায়, ঝোপে-ঝাড়ে এদের বেশি দেখা যায়। তবে উপকূলের কর্দমাক্ত এলাকায় নদী ও খাঁড়ির তীরে যেসব জায়গায় জোয়ারের জল পৌঁছায় সেখান থেকে ভাটার সীমা পর্যন্তও এদের দেখা যায়। কালি লতা, চাঁদি, ভোলা, গেঁওয়া, সিঙ্গরা ইত্যাদি গাছের সাথে পান লতাকে সহাবস্থান করতে দেখা যায়। কালি লতার মতো পান লতার কাণ্ড দৃঢ় হয় বলে দড়ি হিসেবে প্রাচীনকালে সুন্দরবনের মানুষ এই গাছ ব্যবহার করত। এই গাছের মূল ও বাকল বিষাক্ত হওয়ায় মাছ ধরার কাজেও এই গাছ একসময় ব্যবহৃত হত।

(বাঁদিকে) কালি লতার ফলসহ শাখা। ছবি: সংগৃহীত। (ডান দিকে) ঘোড়ামারা দ্বীপে নদীর চড়ায় পান লতা গাছ। ছবি: লেখক।

 

লৌকিক চিকিৎসা

পান লতা গাছের মূল প্রাচীনকালে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ বাত, পঙ্গুত্ব, অনিয়মিত রাজস্রাব, জ্বর, যন্ত্রণাদায়ক সংক্রমণ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করত। তবে দেহের বাইরে প্রয়োগ করা হত। বিষাক্ত হওয়ায় খাওয়ানো হত না। এই গাছের ছাল ডাবের জলে রাতভর ভিজিয়ে সেই জল অল্প পরিমাণে সদ্য প্রসূতি মায়েদের খাওয়ানো হত। আবার যে সব ব্যক্তি অসুস্থ মানুষের দেহ তরলের সংস্পর্শে আসত তাদেরও এই জল সামান্য মাত্রায় পান করানো হত যাতে কোনও সংক্রমণ না হয়। তবে পান লতার এইসব লৌকিক ব্যবহার কালের স্রোতে সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।।

Skip to content