শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁ দিকে) মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিচ্ছেন ডাঃ মানিক সাহা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লবকুমার দেব (ডান দিকে)।

মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বিপ্লব দেবের পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পরই বিজেপি’র পরিষদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হলেন প্রদেশ বিজেপি’র সভাপতি ডাঃ মানিক সাহা। পরদিনই রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। সব মিলিয়ে যেন এক সাজানো চিত্রনাট্য। ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী বদলের ঘটনাটি আকস্মিক ভাবে ঘটে গেলেও এটা ধারণা করা যায় যে, কিছুদিন ধরেই বিজেপি’র শীর্ষ নেতৃত্বের বিশেষ নজর ছিল ত্রিপুরার দিকে। নতুন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব-সহ বিজেপি’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন যে একটি স্বাভাবিক বিষয়, বিজেপি’র মতো রেজিমেন্টেড দলে যে এর কোনও বিরূপ প্রভাব পড়েনি এটাই যেন শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল অথবা স্পষ্ট করা হয়েছিল।
শপথ গ্রহণের পর নতুন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বিপ্লব দেব রাজ্যে যেসব উন্নয়ন কাজ শুরু করেছিলেন দ্রুত সেই সব কাজ শেষ করা হবে। গত চার বছরে রাজ্যে বিজেপি সরকার যে ধারায় কর্মকাণ্ড চালিয়ে গিয়েছে তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের হাতে নেওয়া সব প্রকল্প রূপায়ণে জোরদার প্রয়াস নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী।

এ দিকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বদলে দৃশ্যত উৎফুল্ল বিরোধী দল নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সিপিএম’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ত্রিপুরায় সর্ব ক্ষেত্রে ব্যর্থ বিজেপি সরকার। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ যখন শেষের পথে তখন মুখ্যমন্ত্রী বদল হচ্ছে সরকার ও দলের চরম ব্যর্থতার নিদর্শন। দেশের সংবিধান চার বছর ধরে অচল রাজ্যে। মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। আক্রান্ত সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা। চলছে কাজ খাদ্যের সংকট। মানিক সরকার আরও বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বদল করেও আগামী নির্বাচনে বিজেপি তাদের পরাজয় রুখতে পারবে না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২০: বিপ্লববাবুর অপসারণ রহস্যাবৃত

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের তখন এক বছরও বাকি ছিল না। এই অবস্থায় নতুন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে দায়িত্বভার সামলানো মোটেই সহজ ছিল না। একদিকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নানা বাধ্যবাধকতা এবং অপর দিকে ভোটের আগে মানুষের প্রত্যাশার চাপ। কর্মসংস্থান একটি বড় সমস্যা। এর মধ্যে শিল্পহীন ত্রিপুরায় কর্মসংস্থানে মানুষের অন্যতম ভরসা সরকারি চাকরি। কিন্তু সরকারি চাকরির সুযোগ খুবই সীমিত। সরকারি চাকরি দেয়ার প্রক্রিয়াও দীর্ঘমেয়াদী। ভোটের আগে নতুন মুখ্যমন্ত্রী কি ভাবে এইসব পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন সেদিকেই নজর ছিল কৌতুহলী মহলের। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করে নতুন মুখ্যমন্ত্রী অগ্রসর হতে থাকেন। অবশ্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আসতে থাকে নানা চ্যালেঞ্জ। একদিকে কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই অপরদিকে তাদের সঙ্গে সিপিএমের সখ্যতাও বাড়তে থাকে। জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় আবার অন্য চিত্র। পাহাড়ে পাহাড়ে তখন জনজাতি ভিত্তিক আঞ্চলিক দল তিপ্রা মথার একচ্ছত্র আধিপত্য। ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’-এর শ্লোগান তুলে তিপ্রা মথা জনজাতিদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে। এ ভাবেই এগিয়ে আসতে থাকে আগামী বিধানসভার নির্বাচন। রাজ্যে রাজনৈতিক তৎপরতাও দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ত্রিপুরাতে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। যারা এর দাবিদার সেই তিপ্রা মথা দলের পক্ষেও কিন্তু এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়নি। তবে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড যে ত্রিপুরা ভাগ করে পৃথক এক রাজ্য সৃষ্টির দাবিই এরকম ধারণাই মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। আর এজন্য শুরু থেকেই এধরণের দাবি অর্থাৎ ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’-এর বিরোধী ছিল রাজ্যের এক বড় অংশের মানুষ।

ত্রিপুরার ৬০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০টি আসন জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি জনজাতিদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করায় তিপ্রা মথা জনজাতি সংরক্ষিত আসন গুলোতে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি, কংগ্রেস বা সিপিএম সবাই তাই চাইছিল তিপ্রা মথার সঙ্গে জোট করতে। কিন্তু মথা চেয়েছিল জোটের জন্য গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের পক্ষে লিখিত সমর্থন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্যাপক অংশের অজনজাতি ভোট হারানোর ভয়ে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবির পক্ষে আর এগিয়ে আসেনি অন্য সব দল। মথা শেষপর্যন্ত একক ভাবেই ভোটে লড়াই’র প্রস্তুতি নেয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

বিরোধী সিপিএম ও কংগ্রেসের মধ্যে জোট হয় নির্বাচনে। ত্রিপুরার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল সিপিএম ও কংগ্রেসের জোট রাজ্য রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রার সঞ্চার করে।ভোটে মূলত ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দিতা হয়। বিজেপি জোট, সিপিএম-কংগ্রেস ও তিপ্রা মথা-এই তিন শিবিরের প্রতিদ্বন্দিতায় সামান্য ব্যবধানে বিজেপি’র ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ঘটে। ফলাফলের পর সিপিএম তিপ্রা মথার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ জানাতে থাকে যে, মথা রাজ্যের অসংরক্ষিত আসনগুলোতে প্রার্থী দিয়ে বিরোধী ভোটের ভাগাভাগি করে বিজেপি’কে জিতিয়ে দিয়েছে। যাইহোক, ডাঃ মানিক সাহা আবার বিজেপি’র পরিষদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় বারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণ করেন। তিপ্রা মথা বিধানসভায় প্রধান বিরোধীদলের মর্যাদা লাভ করে। বিরোধী দলনেতা হন অনিমেষ দেববর্মা।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

রাজনৈতিক চমক অবশ্য বাকি ছিল আরও। রাজ্যে দ্বিতীয় বিজেপি জোট মন্ত্রিসভা গঠনের বছর খানেক পর বিরোধী দল তিপ্রা মথা সেই মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়। বিরোধী দলনেতা অনিমেষবাবুও মন্ত্রী হন। বিরোধীদলের সরকারে অংশগ্রহণ রাজ্য রাজনীতির এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। অন্যত্রও এ ধরণের উদাহরণ বিরল! আর গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড? ভোটের আগে জনজাতিদের মধ্যে এক প্রবল আবেগের সঞ্চার করেছিল যে শ্লোগান তা ক্রমেই যেন স্তিমিত হয়ে পড়ে।ত্রিপুরার রাজনীতি আগামী দিনে কোন খাতে প্রবাহিত হয় এখন এটাই দেখার বিষয়! —চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content