শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


শ্রীকান্ত ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যে রাজকুমার ও জ্যোতিকা।

 

শ্রীকান্ত

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: বায়োপিক (২০২৪)
ভাষা: হিন্দি
প্রযোজনা: ভূষণ কুমার, কৃষ্ণন কুমার, নিধি পারমার হীরানন্দানি
পরিবেশনা: চক অ্যান্ড চিজ ফিল্মস, টি-সিরিজ
রচনা: জগদীপ সিধু, সুমিত পুরোহিত
নির্দেশনা: তুষার হীরানন্দানি
অভিনয়ে: রাজকুমার রাও, জ্যোতিকা, আলিয়া এফ, শরদ কেলকর প্রমুখ
সময়সীমা: ১৩৪ মিনিট
দেখা যাবে: নেটফ্লিক্স
রেটিং: ৯.০/১০

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি”…এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এই প্রতিবেদনের পাঠক-পাঠিকাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই জানতেন চিনতেন। কিন্তু ২০২৪ সালে মুক্তি পাওয়া অসাধারণ একটি ছবি ‘শ্রীকান্ত’ দেখার আগে পর্যন্ত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কৃতী ছাত্র দৃষ্টিহীন শিল্পপতি বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকান্ত বোল্লার নামধাম বা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।

দৃষ্টিহীনতা বা শারীরিক অক্ষমতাকে আজকের সমাজ এক বিশেষ নামে অভিহিত করে। হীন শব্দকে প্রতিবন্ধকতা বলে দিলেই সেই বিশেষ অক্ষমতার প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কোনও বদল হয় না। ছোটবেলায় শোনা, কানা খোঁড়া অন্ধ পাগলা। এই বেয়াব্রু শব্দগুলোকে ঝকঝকে পোশাক পরিয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, মানসিক অক্ষমতা বা বিশেষভাবে সক্ষম করা হয়েছে বটে, কিন্তু আপামর মানুষের সচেতনতার বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি। এই ছবির ক্লাইম্যাক্সে বহুদিনের স্বপ্ন সত্যি করে বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রিজ’র অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য শিল্পপতি শ্রীকান্ত বোল্লা দেশের সেরা শিল্পপতির সম্মান ছিনিয়ে নিয়েও মঞ্চে পুরস্কার নিতে উঠে সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ, পুরস্কারটি তাকে বিশেষভাবে সক্ষম ক্যাটেগরিতে দেওয়া হয়েছিল।

মঞ্চে শ্রীকান্ত বলেছিলেন, যেদিন তিনি সকল সাধারণ প্রতিযোগীর সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচারে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবেন, সেদিন তিনি পুরস্কার নেবেন। এই অসাধারণ দৃশ্যে শ্রীকান্ত বোল্লা সেই অনুষ্ঠানের দর্শক এবং এই গোটা সমাজকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও শারীরিক অক্ষমতাকে দয়া দেখাবেন না। একজন দৃষ্টিহীন মানুষকে ট্রাফিক সিগন্যাল পার করে দেওয়াটাই যথেষ্ট সহানুভূতির কাজ নয়। পারলে তার পাশে দাঁড়ান। ব্যক্তি জীবনে ছোটবেলা থেকে দেশের এক সার্থক শিল্পপতি হয়ে ওঠার পথে শ্রীকান্তর সঙ্গে ছিলেন তাঁর শিক্ষিকা দেবিকা, তাঁর বিজনেস পার্টনার ইনভেস্টার বন্ধু রবি মন্থ বা প্রেমিকা এবং পরে স্ত্রী বীর স্বাতী।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

মুভি রিভিউ: মির্জাপুর সিজন ৩: সেই চমকে আর ধার নেই

একটা কথা খুব প্রচলিত, প্রতিভা থাকলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই। কেউ তাকে বাধা দিতে বা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। কথাটা সত্যি হলেও আসল ধোঁয়াশাটা রয়েছে ওই প্রতিভা শব্দটুকুর মধ্যে! কতটা প্রতিভা সব বাধা, রাজনীতি, অকারণ সমালোচনা, নোংরামি টপকাতে পারে? উত্তরটা হল, অবিস্মরণীয় প্রতিভা চাই। শ্রীকান্ত’র মতো এমন অসীম ক্ষমতা চাই, যাতে বিরোধিতা করতে করতে চক্রান্তকারী দলবাজরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তবে প্রতিভার যোগ্য সম্মান লাভ হবে, নচেৎ নয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

অন্ধ্রপ্রদেশে মছলিপত্তনমের এক প্রত্যন্ত গ্রাম সীতারামপুর। সেখানেই এক গরিব পরিবারে শ্রীকান্তর জন্ম। বাবা আনন্দে ক্রিকেটার কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত’র নামে ছেলের নাম রেখেছিলেন। শ্রীকান্ত-কিন্তু জন্মান্ধ। নবজাতককে দেখে তীব্র হতাশায় বাবা তাকে মেরে ফেলে কবর দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা তাকে রক্ষা করেন। ঐশ্বরিক জীবনপ্রাপ্তি হলেও শ্রীকে কিন্তু তার দৃষ্টিহীনতার জন্য ছোটবেলা থেকেই বারবার সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে।
গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার পর শ্রীকে হায়দরাবাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই শিক্ষিকা দেবিকার সাহচর্য মিলে। তারপর শুরু হয় আশ্চর্য মেধাবী শ্রীকান্তের লড়াই আর শিক্ষিকা দেবিকার সহৃদয় সহায়তা।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

হায়দরাবাদের স্কুল কর্তৃপক্ষ শ্রীকান্তকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া থেকে, কলেজে ব্রেইল মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা বা আইআইটি দ্বারা প্রত্যাখিত হওয়ার পরেও আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় এমআইটি-তে নিখরচায় পড়াশোনা সুযোগ পাওয়া বা দৃষ্টিহীনতার কারণে একা বিমানযাত্রায় বাধা টপকানোর চমকপ্রদ কাহিনির বর্ণনা করেছে এই ছবি।

দৃষ্টিহীন জেনেও ডাক্তারির ছাত্র স্বাতীর অনুরাগ বা পরবর্তী জীবনের ব্যবসার প্রাথমিক ইনভেস্টার হিসেবে প্রভু মন্থ-এর নিঃশর্ত সহায়তা সবটাই দুরন্ত নাটকীয়। আর সেই নিখুঁত চিত্রকাহিনিকে মননে উপলব্ধি করার জন্য ছবিটি দেখতে হবে।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

অবাক হয়ে দেখতে হবে রাজকুমার রাও অভিনেতা হিসেবে কীভাবে অক্লেশে একটি জীবন্ত চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন। দেখতে হবে তাঁর শিক্ষিকা দেবিকার চরিত্রে সেরকম নাটকীয়তা না থাকলেও কি অসাধারণ পরিমিত বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষিণ ভারতের অত্যন্ত গুণী অভিনেত্রী জ্যোতিকা। শোনা যায়, প্রাথমিকভাবে দেবিকার চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হননি। যদিও তাঁর স্বামী বিখ্যাত অভিনেতা সূর্যা তাঁকে রাজি করান। জ্যোতিকা তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রটি পেলেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ দর্শকদের উপহার দিলেন। দেখতে হবে শরদ কেলকারের অনবদ্য সংযত অভিনয়।

চলচ্চিত্র সান্ধ্ কী আঁখ বা জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ স্ক্যাম ২০০৩-এর নির্দেশক তুষার হীরানন্দানি’র কেরিয়ারে শ্রীকান্ত একটি মাইলস্টোন ছবি হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুষার তাঁর কুড়ি বছরের ফিল্মি কেরিয়ারের ২৮টি ছবির মধ্যে ২৬টির একক বা যৌথ রচয়িতা আর মাত্র দুটি ছবির নির্দেশক। আশ্চর্যভাবে যে ছবি দুটিতে তিনি নির্দেশক সেই দুটি কিন্তু তুষারের নিজের লেখা নয়।

কিছু কিছু ছবি আমাদের জীবনের স্বাভাবিক দৈনন্দিন হতাশার সরিয়ে আবার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়, শ্রীকান্ত ঠিক তেমনি একটি ছবি।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content