শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


নিপুণ কারিগর।

‘‘বাবুই পাখিরে ডাকি,
বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই।
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।’’—সজনীকান্ত সেন


বাবুই গ্রাম বাংলার একান্ত নিজস্ব এক ছোট্ট পাখি। এরা শিল্পী পাখি নামে খ্যাত। পাখিটি চড়ুই পাখির থেকে সামান্য বড়, তালগাছে থাকতেই বেশি পছন্দ করলেও খেজুর গাছ বা অন্যান্য গাছেও এদের বাসা দেখা যায়। পাখিটি ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি লম্বা, পুরুষ পাখি উজ্জল কালো-হলুদ বর্ণের এবং স্ত্রী পাখিটি হালকা ধূসর হলুদ বর্ণের দেখতে। এদের বাসাটি দেখতে উল্টানো কলসির মতো এবং যে গাছে থাকে সেই গাছের পাতা বা ডালের সুন্দরভাবে আটকে রাখে, যাতে সহজে ঝড়ঝঞ্জায় বা অন্য কারণে ছিঁড়ে না যায়।
খড়-কুটো, কিছু লতা-পাতা, বিশেষ করে কাশ গাছের পাতা নিয়ে এরা নিপুণভাবে, দক্ষশিল্পীর মতো বাসা বানায়। বাবুই এর বাসার নির্মাণশৈলী আধুনিক যুগের কারিগর, বাস্তুবিদ ও প্রকৌশলীদেরও ভাবিয়ে তোলে। উলের সোয়েটার বোনার মতো অতি সুক্ষ ভাবে তারা তাদের বাসাটি বানায় এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই বাসা সম্পূর্ণরূপে ওয়াটারপ্রুফ, বাসার ভিতরে জল প্রবেশ করতে পারে না। শত্রুরা যাতে সহজে বাসার মধ্যে প্রবেশ না করতে পারে সে জন্য তাদের প্রবেশপত্র অত্যন্ত সরু। মানবসমাজে লাইট বা ইলেকট্রিক এসেছে মাত্র কয়েক শত বছর আগে, কিন্তু এই প্রাণীটি তাদের বাসা আলোকিত করছে কয়েক কোটি বছর ধরে। তারা বাসার ভিতর সামান্য কিছুটা গোবর বা নরম কাদা রেখে তার মধ্যে জোনাকি পোকার মাথাটি গুঁজে দেয়, ফলে টিপ টিপ করে জ্বলতে থাকা আলোয় সমগ্র বাসাটি আলোকিত হয়ে ওঠে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭১: মহাভারতে বর্ণিত পোষ্যপ্রাণী ও পালকপিতার সম্পর্কের বাঁধন, আজও খুঁজে পাওয়া যায় কী?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

বাসা বাঁধার কাজ চলাকালীন এরা আপন আপন সঙ্গী খুঁজতে বের হয় ও অন্যান্য বাবুই পাখির বাসায় ঘুরতে থাকে। পুরুষ বাবুই কোন স্ত্রী বাবুইকে পছন্দ হলে তার অর্ধসমাপ্ত বাসা দেখাতে নিয়ে আসে তা দেখে যদি পছন্দ হয় তাহলে স্ত্রী বাবুই পুরুষ বাবুইকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেয়। যদি স্ত্রী বাবুই এর বাসা পছন্দ না হয়, তাহলে পুরুষ বাবুই ওই অর্ধসমাপ্ত বাসা পরিত্যাগ করে আবার নতুন বাসা তৈরির দিকে মন দেয়। সহজ কথায় স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণায় পুরুষ বাবুই বাসা তৈরিতে উৎসাহিত হয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩১: হেমন্তবালা দেবী— রবি ঠাকুরের পত্রমিতা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৭: গাড়ি থেকে নেমেই ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘তোদের ছবির নামই তো পথে হল দেরি’

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই পাখি তাদের জনন ঋতুতে ৫ থেকে ১০টি বেশি বাসা বুনতে পারে। এত নিখুঁত ভাবে বানানো বাসা তৈরিতে তাদের সময় লাগে মাত্র চার থেকে পাঁচ দিন। পাখিটি তার ছোট ঠোঁট দিয়ে খাবার খুঁটে খুঁটে খায়। খাদ্য হিসেবে এরা গ্রহণ করে বীজ, পোকামাকড়, ছোট কম্বোজ প্রাণী, ফুলের রেণু-মধু-মকরন্দ, ভাত ইত্যাদি। জননঋতু চলাকালীন তারা খুব জোরে চিৎকার করে কিন্তু অন্যান্য সময়ে তারা আসতে আসতে চিৎকার করে। এটি তাদের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী খুঁজতে বিশেষ সাহায্য করে বলে মনে করেন পক্ষীবিশারদ বা বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

ভারত-সহ পৃথিবীর অন্যান্য স্থান যথা আফ্রিকা, সাহারা ইত্যাদি জায়গাতেও এই পাখি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আইইউসিএন-এর লাল তালিকার পাখিটিকে লিস্ট কনসার্ন আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক ও গল্পকারদের সাহিত্যে বাবুই পাখির বর্ণনা পাওয়া যায়। বর্তমানে অন্যান্য প্রাণীদের মতোই বাংলার এই প্রাণীটির সংখ্যাও কমছে অতি দ্রুত ভাবে। তাই গ্রামেগঞ্জে এই ঐতিহ্যবাহী বাবুই পাখির বাসাও কমে গিয়েছে। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন, তাদের বাসযোগ্য গাছ এর অভাব, মাত্রারিক্ত দূষণ, জল ও খাদ্যের অভাব, চোরা শিকারীদের উপদ্রব, মোবাইলের টাওয়ার ও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সিগনালের প্রভাব, প্রচুর পেস্টিসাইডের ব্যবহার এবং অন্যান্য কারণে এদের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

গ্রামে-গঞ্জে ও শহরের কোনও নির্জন নিরিবিলি স্থান যা পূর্বে ‘পবিত্র স্থান’ নামে পরিচিত ছিল সেই স্থানগুলির সংখ্যাও বর্তমানে নষ্ট হতে বসেছে। তাই কমে যাচ্ছে বাবুই পাখি। ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’ প্রতিবছর পাখি পর্যবেক্ষণ ও গণনা করেন তাদের ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য, সময় হিসাবে বেছে নেয় জুন এবং জুলাই মাসকে। তাদের হিসাব ও অন্যান্য বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া হিসাব অনুসারেও দেখা যাচ্ছে সমগ্র ভারত এবং বাংলায় তাদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।

তাহলে কি বাবুই পাখিও, ডোডো পাখির মতো এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? এদের বাঁচার উপায় কী? এর উত্তরে বলা যেতে পারে প্রচুর গাছ লাগানো, গ্রীষ্মকালে প্রবল জল সংকট থেকে বাঁচাতে হলে প্রায় বাড়ির প্রত্যেকটি ছাদেই অল্পবিস্তর জল রাখা এবং সেই সাথে সামান্য কিছু খাদ্য রাখা, যেকোনও উপায়ে দূষণ কমাতে হবে। না হলে দূষণে জর্জরিত এই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রাণীকুলই ধ্বংস হয়ে যাবে!
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content