মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

রাম, অরণ্যপথে গঙ্গানদী অতিক্রম করে দক্ষিণে গহন অরণ্যে প্রবেশ করলেন। তাঁরা প্রথম নিশি যাপন করলেন একটি বটগাছের তলায়। এর পরে নির্মল সকালে গঙ্গাযমুনার সঙ্গমস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আসন্ন সন্ধ্যায় প্রয়াগতীর্থের নিকটবর্তী হয়েছেন অনুমান করলেন রাম। কারণ চারিদিকে যেন অগ্নিদেবতার পতাকার মতো ধোঁয়া উঠছে। নিশ্চিতভাবেই মুনিদের উপস্থিতি অনুমান করলেন রাম। দুটি জলধারার মিলনে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের শব্দ শুনে আরও নিঃসংশয় হলেন, তাঁরা গন্তব্যের নিকটবর্তী হয়েছেন। দেখলেন, জীবিকা নির্বাহের কারণে বনজীবীরা গাছের কাঠ সংগ্রহ করেছেন, গাছের কেটে রাখা কাঠ, ছিন্ন ডালপালা তার প্রমাণ। মহা উৎসাহে দীর্ঘ পথ পরিক্রমনের পরে সূর্যাস্তের সময়ে উপস্থিত হলেন ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রমে। বহিরাগতদের উপস্থিতিতে ত্রস্ত হয়ে উঠল, আশ্রমের পশুপাখীরা। যজ্ঞসমাপনান্তে, মহর্ষির সাক্ষাতের অনুমতি নিলেন, রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা।

শিষ্যপরিবৃত, কঠোর ব্রতধারী, সমাহিতচিত্ত, তপশ্চর্যার ফলে, দিব্যদৃষ্টির অধিকারী, ঋষির দর্শনার্থী রাম, আত্মপরিচয় জানালেন। লক্ষ্মণ ও স্ত্রী সীতার স্বেচ্ছায় নির্বাসনের সিদ্ধান্তও অবহিত করলেন। পিতার আদেশে তাঁরা তিনজনে বনবাসী হয়ে প্রব্রজ্যা অবলম্বন করেছেন। বন্য ফলমূলভোজন করে তাঁরা এখন ধর্মাচরণরত। ঋষি তাঁদের স্বাগত জানালেন, আতিথ্যদানে আপ্যায়িত করলেন। ভরদ্বাজ মুনি রামের অকারণ বনবাসের নেপথ্যের বৃত্তান্ত জেনেছেন। মহর্ষির প্রস্তাব, এই নির্জন দুই মহনদীর পবিত্র মনোরম সঙ্গমস্থল বসবাসের উপযোগী। তাই এখানেই স্বচ্ছন্দে বাস করুন রাম। বসত্বিহ ভবান সুখম্। সকলের কল্যাণকামী রাম, সবিনয়ে এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। এই আশ্রম থেকে জনপদ বেশী দূরে নয়। পুরবাসীরা সহজেই আমার ও সীতার দর্শনার্থী হয়ে হয়তো উপস্থিত হবেন। সেই কারণেই এই স্থানটি বসবাস তাঁর অভিপ্রেত নয়। আগমিষ্যতি বৈদেহীং মাঞ্চাপি প্রেক্ষকো জনঃ। অনেন কারণেনাহমিহ বাসং ন রোচয়ে।।

আপাতত তাঁর পছন্দ, সুখযাপনে অভ্যস্ত বৈদেহী সীতার স্বচ্ছন্দ যাপনের জন্যে একটি জনহীন আশ্রম। ঋষি ভরদ্বাজ প্রস্তাব দিলেন, দশ ক্রোশ দূরে বানর, ভল্লুক অধ্যুষিত, গন্ধমাদন সদৃশ মনোলোভা চিত্রকূট পর্বত হতে পারে সেই অভীষ্ট বাসস্থান। চিত্রকূট পর্বতের সুন্দর শৃঙ্গদর্শনে সুখলাভ, মোহমুক্তি হয়, কল্যাণচিন্তা আসে মনে। বহু মুনি, ঋষিরা সেখানে তপস্যা করে দেবলোক প্রাপ্ত হয়েছেন। ভরদ্বাজ মুনির মতানুসারে রামের দুটি বিকল্প আছে, হয় নিরালা সেই চিত্রকূটে সুখে বাস, তা না হলে, এইখানে তাঁর আশ্রমে বনবাস। প্রবিবিক্তমহং মন্যে তং বাসং ভবতঃ সুখম্। ইহ বা বনবাসায় বস রাম ময়া হহ।। কথায় কথায় রাত হয়ে এল। ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে সুখে রাত্রি যাপন করলেন রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ। সকালে ঋষির কাছে বিদায়কালীন সাক্ষাৎকারে চিত্রকূট পর্বতে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে অনুমতি প্রার্থনারত রামকে ঋষি বললেন, মধু, ফলমূলে পরিপূর্ণ যে পর্বতে যাচ্ছেন, সেই পর্বত পবিত্র,অতি সুন্দর। সেখানে কিন্নর ও উরগদের নিবাস।
ময়ূরের কেকারবে মুখরিত, গজরাজ বহুল সেই বিচিত্র বিখ্যাত চিত্রকূট পর্বতই রামের যথাযথ গন্তব্য হওয়া উচিত। সেখানে বনের মধ্যে দেবী সীতার সঙ্গে ভ্রমণ করবেন যখন,তখন দেখবেন, বিচরণরত হাতির দল ও যূথবদ্ধ হরিণের পাল, সেই সঙ্গে নদী, প্রস্রবণ, পর্বতের সানুদেশ, গিরিকন্দর, ঝর্ণা প্রভৃতি নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে আনন্দে উদ্বেল হবে মন। সেই আনন্দমুখর টিট্টিভ ও কোকিলের কলকাকলিতে হবে মনের বিনোদন, কত না হরিণ ও কত শত হাতি সেখানে। এমন সুরম্য চিত্রকূট পর্বতে সুখে বাস কর। সুরম্যমাসাদ্য সমবসাশ্রমম্।

রামচন্দ্রের এবার গন্তব্য চিত্রকূট। বিদায়বেলায় মহর্ষি ভরদ্বাজ, ঔরসজাত সন্তানতুল্য রামের মঙ্গলকামনায় স্বস্ত্যয়ন করলেন, দিলেন পথনির্দেশ। গঙ্গযমুনার সঙ্গমস্থল পার হয়ে, ধাবমানা যমুনার পশ্চাতমুখী স্রোত অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হবে। পৌঁছবেন প্রতিকূল স্রোতে বয়ে চলা যমুনার তীরবর্তী তীর্থের ঘাটে। ভেলার সাহায্যে যমুনা অতিক্রম করে কিছু দূর গিয়ে একটি বিশাল শ্যামল বটগাছের দেখা পাবেন। সেই সুবিশাল গাছটির পাতাগুলি হরিদ্বর্ণ, গাছটিকে জড়িয়ে আছে বহু সবুজবরণ গাছ, সিদ্ধ পুরুষরা সেই মহান মহীরুহের সেবারত।

জনকনন্দিনী সীতা যেন করজোড়ে সেই পাদপের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। সেখানে তরুতলে রাম বাস করতে পারেন,তা না হলে, সেই স্থানটি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতেও পারেন। সেখান থেকে এক ক্রোশ পথ পার হয়ে সামনে পরবে নীলরঙের একটি বাগান। সেই বনের শোভা—শাল, বদরী এবং যমুনার উপকূলবর্তী বিভিন্ন গাছ। ওখান থেকেই রাম, চিত্রকূটে যাবার সহজগম্য পথ পেয়ে যাবেন।

মহর্ষির বহুবার চিত্রকূটের গমনাভিজ্ঞতা আছে। তিনি জানেন, পথটি সুন্দর, কোমল, দাবানলের ভয় নেই সেই পথে। ভরদ্বাজমুনির আশীর্বাদধন্য রাম ও লক্ষ্মণ, দেবী সীতাকে সম্মুখে রেখে যমুনার তীর ধরে এগিয়ে চললেন। ক্রমান্বয়ে গন্তব্যের নিকটবর্তী হয়ে যমুনার পরপারে পৌছতে ব্যস্ত হলেন। সত্বর কাঠ সংগ্রহ করে বিশাল ভেলা প্রস্তুত হল। বন্য শুকনো পাতা ও লতাগুল্মর সাহায্যে বাঁধা হল ভেলা। লক্ষ্মণ সেখানে বেতস ও জামগাছের শাখা দিয়ে নির্মাণ করলেন সীতা দেবীর জন্যে সুখাসন। দাশরথি রাম, অনিন্দ্য সুন্দরী লক্ষ্মী তুল্যা, ঈষৎ লজ্জিতা, সীতাকে ভেলায় তুললেন। দেবী সীতা সাবধানে পাশে রাখলেন তাঁর বসন ও ভূষণ। ভেলায় উঠলেন দুই ভাই। দুখানি কাঠের সাহায্যে বাইতে লাগলেন ভেলা।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭১: মহাভারতে বর্ণিত পোষ্যপ্রাণী ও পালকপিতার সম্পর্কের বাঁধন, আজও খুঁজে পাওয়া যায় কী?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

ক্রমে যমুনার মধ্যবর্তী হল ভেলা। দেবী সীতা, যমুনা নদীকে বন্দনা করে বললেন, হে দেবি, তোমায় উত্তীর্ণ হয়ে পারাপার করছি, তোমার প্রসাদে আমাদের মঙ্গল হোক। আমার পতিও যেন ব্রতপালনে এমনভাবেই উত্তীর্ণ হন। স্বস্তি দেবি তরামি ত্বাং পারয়েন্মে পতির্ব্রতম্। যক্ষ্যে ত্বাং গোসহস্রেণ সুরাঘটশতেন চ।। স্বস্তি প্রত্যাগতে রামে পুরীমিক্ষ্বাকুপালিতাম্। সীতাদেবী হাত জোড় করে প্রার্থনা জানালেন, ইক্ষ্বাকবংশীয় রাজাদের পালিতা অযোধ্যা নগরীতে রাম ভালয় ভালয় ফিরে এলে, তিনি হাজার গাভী ও শতসংখ্যক সুরাপূর্ণ কলস দিয়ে যমুনাকে পূজা করবেন। তাঁরা পৌঁছলেন যমুনার দক্ষিণতীরে। নদী তীরভূমি অতিক্রম করে বনের মধ্যে মহর্ষি ভরদ্বাজনির্দিষ্ট শ্যামল সুশীতল বটগাছটিকে দেখতে পেলেন।

আবারও সীতার নম্র প্রার্থনা— হে মহীরুহ, আপনার কাছে প্রণতা সীতার নিবেদন, আমার স্বামীর ব্রত সার্থক হোক। আবার যেন দেবী কৌশল্যা ও সুমিত্রার দেখা পাই আমি। এই বলে অঞ্জলিবদ্ধ অবস্থায় প্রার্থনারতা সীতা বটবৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করলেন। অনিন্দিতা, প্রিয়ার প্রার্থনার দৃশ্য দেখে রাম লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন, দেবী সীতাকে সামনে নিয়ে লক্ষ্মণ যেন এগিয়ে যান। পিছন থেকে তাঁদের অনুসরণ করবেন সশস্ত্র রাম। পথে জনকনন্দিনীর পছন্দের ফল ফুল লক্ষ্মণ সংগ্রহ করে এনে দেবেন যেন সীতার মনটি প্রফুল্ল থাকে। যদ্ যত্ ফলং প্রার্থয়তে পুষ্পং বা জনকাত্মজা।। তত্তত্ প্রযচ্ছ বৈদেহ্যা যত্রাস্যা রমতে মনঃ।

দেবী সীতা পারিপার্শ্বিকের এই সব গাছপালা, লতাগুল্ম, ফুল আগে দেখেননি কখনও। তাঁর অপার কৌতূহল। সেগুলির পরিচয় জানতে ইচ্ছুক তিনি। রামকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। দেবর লক্ষ্মণ, সীতার ইচ্ছানুসারে বিচিত্র সেই সব প্রকৃতির সম্ভার এনে দিতে লাগলেন। ঠিক সেই সময়ে হংসসারসের কলধ্বনিতে মুখরিত, যমুনার বালুময় তটভূমি দেখে দেবী সীতা খুশী হলেন। ক্রোশখানিক পথ অতিক্রম করে যমুনার তীরবর্তী বনে, রাম ও লক্ষ্মণ দুই ভাই মিলিতভাবে অনেক হরিণ শিকার করে আহার সারলেন। সেই রমণীয় বনে ময়ূরের কেকাধ্বনি শোনা যায়, বানর ও গজযূথ পরিবৃত সে অরণ্যভূমি। এমন নদীতীরবর্তী সুন্দর বনটিতে সারাদিন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ালেন তিনজনে। সন্ধ্যায় নদীর উপকূলে একটি সমতলভূমিতে আশ্রয় খুঁজে পেলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩১: হেমন্তবালা দেবী— রবি ঠাকুরের পত্রমিতা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৭: গাড়ি থেকে নেমেই ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘তোদের ছবির নামই তো পথে হল দেরি’

এখনও চিত্রকূটে পৌঁছানো হয়নি।সকাল সকাল ঘুমন্ত লক্ষ্মণকে তাড়া দিলেন রাম।পাখীদের কলরব জানিয়ে দিচ্ছে রাত্রি অবসান। লক্ষ্মণ তাড়াতাড়ি পথশ্রমের ক্লান্তি আলস্য ও তন্দ্রার ঘোর কাটিয়ে উঠলেন। যমুনার জল স্পর্শ করে ঋষির নির্দিষ্ট চিত্রকূটের পথে রওনা দিলেন। বনে সমাগত বসন্তশোভা দেখে বিমুগ্ধ রাম, স্ত্রী ও ভাই লক্ষ্মণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। পলাশবনে যেন আগুন লেগেছে। শীতের শেষে, কুসুমিত ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ গাছগুলি। দেখ, ভল্লাতক (কাজুবাদাম) ও বেলগাছগুলি ফুল ও ফলের ভারে নত হয়ে আছে। কারণ এরা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে,তাই এরাই হবে আমাদের বেঁচে থাকার রসদ। পশ্য ভল্লাতকান্ বিল্বান্ নরৈরনুপসেবিতান্। ফলপুষ্পৈরবনতান্ নূনং শক্ষ্যাম জীবিতুম্।।

রামচন্দ্র ভাইকে দেখালেন, মধুকরদের সঞ্চিত মৌচাকগুলি মধুচক্রের সৃষ্টি করে, ভাণ্ডের আকারে গাছে গাছে লম্বা হয়ে ঝুলছে। মনোরম অরণ্যে ছড়িয়ে আছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ফুলের সম্ভার,ডেকে চলেছে নত্যুহ (চাতক) পাখিটি, তার কূজনের যেন প্রত্যুত্তর দিচ্ছে ময়ূর। ওই দেখা যায় চিত্রকূট। পরিণত উঁচু শিখরবিশিষ্ট চিত্রকূট পাখপাখালির কলরবে ভরা, গজরাজ বিচরণ করে বেড়াচ্ছে সেখানে। রাম সিদ্ধান্ত নিলেন, সমভূমিতলে রম্যে দ্রুমৈর্বহুভিরাবৃতে। পুণ্যে রংস্যামহে তাত চিত্রকূটস্য কাননে।। দেখ ভাই, পর্বতের সমতল ভূভাগে যেখানে বহুবিচিত্র গাছেরা ভিড় করে আবরণ সৃষ্টি করেছে, সেই রমণীয় পবিত্র কাননে আমরা ঘুরে বেড়াব।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

অবশেষে তিনজনে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলেন সেই মনোহর,অতি সুন্দর চিত্রকূট পাহাড়ে। পর্বতটি বহু পাখি, ফলমূল এবং সুপেয় জলে সমৃদ্ধ। রাম স্থির করলেন, তরুলতা ফলমূলে ভরা, মনোজ্ঞ, সুখে বসবাসের উপযোগী,মহান ঋষিদের নিবাস এই মনোরম জায়গাটিই হবে তাঁদের ভাবি আদর্শ বাসস্থান। অয়ং বাসো ভবেৎ তাত বয়মত্র বসেমহি। ভাই, আমরা এখানেই বাস করি। এরপরে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে প্রবেশ করলেন তিনজনে। উদ্দেশ্য, মুনির আশীর্বাদলাভ। পরিচয়পর্বের পরে, পছন্দের স্থানটিতে, শক্তপোক্ত কাঠ দিয়ে বসবাসের উপযোগী একটি কুটির নির্মাণের জন্য, লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন, রাম। দৃঢ়, সুগঠিত পাতায় আচ্ছাদিত সুন্দর পর্ণকুটিরটি দেখে, সেবক লক্ষ্মণের কাছে রাম, বাস্তুযাগের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দীর্ঘ জীবনকামনায় এই যাগানুষ্ঠান অবশ্যকর্তব্য। এর জন্যে প্রয়োজন হরিণের মাংস।অবিলম্বে লক্ষ্মণ রামের আদেশানুসারে কাজ করলেন। সেই দিনটিতে ছিল শুভনক্ষত্রযোগ। কৃষ্ণমৃগমাংস দিয়ে দেবযাগের হবন সম্পন্ন হল।নদীতে স্নান করে রাম বাস্তশান্তিবিধায়ক মঙ্গলকর কাজ সম্পন্ন করে পাপনাশক বৈশ্বদেব, রৌদ্র ও বৈষ্ণব বলি প্রদান করলেন। পর্ণশালার নিকটবর্তী স্থানে, আশ্রমে মানায় এমন চৈত্য, দেবালয় স্থাপন করলেন রাম।

এই গাছের পাতায় আচ্ছাদিত, মনোজ্ঞ, পর্ণকুটিরটি যথাযথ স্থানে নির্মিত হয়েছে।এর আছে বায়ুবেগ প্রতিরোধের সামর্থ্যও। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা যখন সেই কুটিরে প্রবেশ করলেন। মনে হল, দেবতারা যেন দেবসভায় প্রবিষ্ট হয়েছেন। সেখানে আছে মাল্যবতী নামে নদী। সেই সুরম্য চিত্রকূট পর্বত এবং তার অনুষঙ্গে আছে হরিণ ও পাখীসমাকীর্ণ সুন্দর তীর্থসমন্বিত মাল্যবতী নামে নদী। এই সবকিছুর প্রাপ্তিতে রাম আনন্দে আত্মহারা হলেন, ভুলে গেলেন প্রবাসজীবনে অযোধ্যা হতে বিচ্ছেদজনিত দুঃখময় গ্লানি।
সুরম্যমাসাদ্য তু চিত্রকূটং নদীঞ্চ সুতীর্থাম্।ননন্দ হৃষ্টৌ মৃগপক্ষিজুষ্টাং জহৌ চ দুঃখং পুরবিপ্রবাসাৎ।।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

রামের বনবাসযাত্রায় প্রকৃতি একটি সক্রিয় চরিত্র। রাম প্রথমে পৌঁছলেন গঙ্গাযমুনার সঙ্গমস্থলে, হর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে। মহর্ষি ভরদ্বাজ প্রথম প্রকৃতিপাঠের সূচনা করলেন। নিরালা নদীসঙ্গমে আছে নিজেকে চেনা জানার নদীসান্নিধ্যের মুক্ত পরিবেশ। রাম প্রকৃত অর্থেই বনবাসী হতে চেয়েছেন। তিনি জনগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে নির্জনে হয়তো একান্ত যাপনে আত্মশুদ্ধির সুযোগ খুঁজেছেন। শুধু রামের একান্ত ইচ্ছা,বৈদেহী সীতার একটি স্বচ্ছন্দ যাপনের আশ্রয়। ঋষি ভরদ্বাজ মনে মনে জানতেন দুঃখের অভিঘাতে,ভাঙ্গা মন নিয়ে বিপর্যস্ত রামের, মানসিক শান্তির প্রয়োজন। দশ ক্রোশ দূরের উদার উন্মুক্ত প্রকৃতি এবং প্রকৃতির অনুষঙ্গ, নদী, পাখি, প্রাণী,কীটপতঙ্গময় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ হয়তো রামের মনে শান্তির প্রলেপ দিতে সক্ষম হবে।প্রকৃতি,মানুষকে তার কাঙ্খিত পরিসর দিতে পারে,যেখানে মানুষ তার সব, সব, ক্ষোভ, দুঃখ,অভিমান ভুলে যেতে পারে।

মহর্ষির বর্ণনায় চিত্রকূটের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ছবি যেন নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। মনে বঞ্চিতের কষ্ট, রাজকীয় সুখ হঠাৎ উধাও হওয়ায়,অজানা অচেনা অরণ্যবাসের কঠোরতায় দুঃখদীর্ণ রামের এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন ছিল হয়তো। গভীর মননশীল ঋষি ভরদ্বাজের বিবেচনায় সেই অপ্রতিম সৌন্দর্যময় রম্য চিত্রকূট হল সেই আদর্শ স্থান যেখানে রাম উপলব্ধি করতে পারবেন অযোধ্যার জটিল রাজনৈতিক আবহ থেকে মুক্তির আনন্দ। একের পর এক নদী পার হয়ে রাম এগিয়ে চলেছেন উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে। গঙ্গা, যমুনা যে ভারতীয় জীবনের অঙ্গ। নদীর বহমান স্রোতে ভাসমান জীবন। জীবন, জীবিকা,যাপন সবকিছু ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই নদীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আনত হওয়া যে মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনার রকমফের মাত্র। নদীমাতৃক দেশের মানুষ যে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ। মহান মহীরুহের কাছে বিনত বিনয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনার মধ্যে যেন প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার।

ছবি: প্রতীকী।

শুধু বিশাল মহীরুহ বট নয়, নদীপ্রকৃতির অসংখ্য তরুলতা তাদের সান্নিধ্যে দিন কাটানোর জন্যে যেন রামকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। যমুনার পারাপারের মাধ্যম কাঠের ভেলাটি। সেখানেও আছে প্রকৃতির সাহায্যের হাত। সীতাদেবীর নদীপূজা,বৃক্ষবন্দনায় আছে বিশ্বপ্রকৃতিকে মনে রেখে শ্রদ্ধাবনত হৃদয়োচ্ছ্বাসের প্রকাশ। মনের কথা শুনতে সক্ষম, একান্ত শ্রোতা গাছ, নদী, পাহাড়। তাদের প্রত্যেকের কাছে নিজের উপলব্ধির উন্মোচন সম্ভব। সেই পরিসর নিয়ে অপেক্ষমান প্রকৃতি। এমন বিশ্বস্ত, প্রতিক্রিয়াহীন নীরব শ্রোতা দুর্লভ। এমন সুন্দর আস্থাভাজন বন্ধুকে পেয়ে মহাকাব্যের নায়ক ভুলেছেন শোক, জ্বালা, যন্ত্রণার যত বিরূপ নাস্ত্যর্থক উপলব্ধি।আমরা এমন প্রকৃতির সান্নিধ্য অবশ্যই উপলব্ধি করি শুধু সেটি প্রকাশ করার সামর্থ্য ও ঔদার্য আমাদের নেই। রামের মতো প্রকৃতির সান্নিধ্যে নাগরিক জীবনের সমস্ত গ্লানিমুক্তির আনন্দ আস্বাদন করতে পারি কী?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content