শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


পদ্মাবোট।

জমিদারি কাজে শিলাইদহে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে আবিস্কার করেছিলেন। মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষজনের জীবন কাছ থেকে দেখেছেন। সে অভিজ্ঞতার কথা গল্পে লিখেছেন। কবিতায় যা তিনি পারেননি, তা গল্পে প্রথম থেকেই পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি। তাদের দিনযাপন। দুঃখের বারোমাস্যা। শিলাইদহে না গেলে, দরিদ্র মানুষজনের কাছাকাছি না হলে বোধহয় কবির এই অভিজ্ঞতার অভাব রয়ে যেত।
নদী রবীন্দ্রনাথকে বরাবর টানত। শিলাইদাহে গেলে নির্জনতার সন্ধানে পদ্মায় বিশেষ একটি বোটে ঘুরে বেড়াতেন। ‘পদ্মাবোট’— এই নাম রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া হলেও বোটের বয়েস খুব কম নয়। রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই বোট নিয়ে কলকাতার গঙ্গায় ঘুরতেন। পশ্চিমেও বেড়াতে গিয়েছিলেন। নদীবিহারে তাঁরও মন প্রফুল্ল হত। একবার ঠিক হয় বোট নিয়ে যাবেন বেনারসে। যাবতীয় প্রস্তুতির পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা গিয়েও ছিলেন। হঠাৎই মহর্ষির কাছে খবর আসে, তাঁর পিতৃদেব দ্বারকানাথের মৃত্যু হয়েছে লন্ডনে। কোথায় সেই দূর-দেশ, সেখানে যাওয়াও সম্ভব নয়। পিতৃ-বিয়োগের চরম দুঃসংবাদ জানার পর বেনারস-মুখো বোট ঘুরিয়ে শোকস্তব্ধ মহর্ষিদেব ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা

রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ তৈরি করিয়েছিলেন এই বজরা। অনেকটা ঢাকাই বজরার আদলে তৈরি। যথেষ্ট বড়সড়ো, সাজানো-গোছানো। বজরার ঘরগুলো বেশ প্রশস্ত। বাড়ির মতোই সব সুযোগ-সুবিধা।

তখনয় বিমান কল্পনায়। উড়ানে উড়ে যাওয়ার স্বপ্নও বোধহয় কেউ দেখত না। রেলপথও সেভাবে তৈরি হয়নি। বজরাই ছিল ভরসা। পদ্মা-গঙ্গা শুধু নয়, নদী-নালা, খাল-বিলের অভাব ছিল না বঙ্গদেশে। তরী ভাসিয়ে যেখানে খুশি যাওয়া যেত। খুব বড়লোকদের বাড়িতে নৌকো শুধু নয়, বজরাও থাকত। কার বজরা কত ভালো, তা নিয়ে জমিদারে জমিদারে রেষারেষিও চলত। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, দিঘাপতিয়ার রাজার ন্যাকি “মার্বেল পাথরের মেঝে দেওয়া একটি প্রকাণ্ড বজরা ছিল।” টাঙ্গাইলের কাছে এই দিঘাপতিয়ার অবস্থান।

দ্বারকানাথ ঠাকুর।

বজরাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হত যে, অল্প জলেও দিব্যি ভেসে ভেসে এ নদী থেকে ও নদীতে যাওয়া যেত। বজরার ওপরের দিকটা অনেক চওড়া হলেও খোলের তলাটা তেমন হত না। দুটো বড় বড় ঘর, চেয়ার-টেবিল, খাট-পালঙ্ক, আসবাবপত্র কী না থাকত তাতে!

শিলাইদহে, ঠাকুরবাড়ির জমিদারিতে অনেকগুলো বজরা ছিল। বাজরাগুলো বাঁধা থাকত শিলাইদহের কুঠিঘাটে, হানিফের ঘাটে। বজরাগুলোর বিভিন্ন নামও ছিল। ‘চিত্রা’, ‘আত্রাই’, ‘লালডিঙি’ — এমন সব নাম। দ্বারকানাথের বোট রবীন্দ্রনাথের কালে পুনর্গঠন করা হয়েছিল। বোট তৈরিতে ঢাকার মিস্ত্রিদের সুখ্যাতি ছিল। তাদের সাদরে আনা হয়েছিল। এমনকি জাপানি-মিস্ত্রিও আনা হয়। পদ্মাবোট পুনর্গঠনে যথেষ্ট ব্যয়ও হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৪: কথায়-কথায়

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিল ওই পদ্মাবোট। অন্য কোনও বোটে নয়, শিলাইদহে গেলেই তিনি ইতিউতি বেরিয়ে পড়তেন এই বোটে। একক আনন্দ-ভ্রমণে। এই ভ্রমণের আড়ালে থাকত অভিজ্ঞতা অর্জনের ইচ্ছে, নিজের মতো করে নির্জন-বাস, পড়াশোনা, সাহিত্য-রচনায় মগ্ন হওয়া। ক-দিন বড়ো আনন্দে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। যেন নব আনন্দে জেগে উঠতেন। ভ্রাতুস্পুত্রী ইন্দিরাকে লেখা কবির এই চিঠিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আনন্দর ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি। কবি লিখেছেন, “যেমন ইচ্ছে ভাবি, যেমন ইচ্ছে কল্পনা করি, যত খুশি পড়ি, যত খুশি লিখি, এবং যত খুশি নদীর দিকে চেয়ে টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে আপন মনে এই আকাশপূর্ণ, আলোকপূর্ণ, আলস্যপূর্ণ দিনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে থাকি।”

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রথীন্দ্রনাথের লেখাতেও আছে, পদ্মাবোট রবীন্দ্রনাথের কতখানি প্রিয় ছিল, কেন প্রিয় ছিল। কবিপুত্রের লেখা থেকেই জানা যায়, “সুযোগ পেলেই চলে যেতেন তাঁর প্রিয় পদ্মাবোটে। বাড়িতে বাস করার চেয়ে বোটে থাকতে তাঁর বেশি ভালো লাগত…। সম্পূর্ণ নির্জনতা যখন চাইতেন, শিলাইদহের কর্মচারীদের আদেশ দিতেন কেউ যেন তাঁর কাছে না আসে।” কখনও কখনও অনেক অনেক দূরে চলে যেতেন। সেখানে তখন “সুদূর প্রসারিত শুভ্র বালুরাশি”, শোনা যেত “একমাত্র সঙ্গী জলচর পাখির কলরবধ্বনি।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা

বেজায় বড় এই বজরা। বারোজন দাঁড় টানত। তারা নজর রাখত, কোথায় জল কম, কোথায় জল বেশি। আবহাওয়ার ভালো মন্দ নিয়েও থাকতে হত সতর্ক। এরপরও নানা সমস্যার মুখে পড়তে হত। একবার খুব বড়সড়ো এক সমস্যার মুখে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অনন্ত জলরাশি। ভেসে চলেছে পদ্মাবোট। রবীন্দ্রনাথ দুচোখ ভরে দেখছেন, লিখছেন। কোথা দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে। হঠাৎই পদ্মাবোট থেমে যায়। নট নড়নচড়ন, কী ব্যাপার, উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ জানতে পারলেন, বোট কাদায় আটকে গিয়েছে। কী হবে, কবির উদ্বিগ্নতা অচিরেই কাটল। ‘বাবামশাই’কে খুব ভালবাসত প্রজারা। খবর পেয়ে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অন্তত শ-পাঁচেক প্রজা ছুটে এসেছিল। কাদায় নেমে সবাই হাতে হাত লাগিয়ে পদ্মাবোটকে ঠেলে,টেনে পৌঁছে দিয়েছিল বড়ো গাঙে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রথীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে পদ্মাবোটে বেড়াতে বের হতেন। কখনও পুত্রকে নিয়ে ‘ঠাকুর কোম্পানি’-র কাজকর্ম দেখতে বের হতেন তিনি। রথীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে কুষ্টিয়ায় গিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন। সে স্মৃতি কবিপুত্রের মনে জেগেছিল। পাশাপাশি আরও একটি জেগে থাকা স্মৃতি পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথ লেখার ব্যাপারে কতখানি নিষ্ঠাবান ছিলেন।কবিপুত্র জানিয়েছেন, “খাওয়া হয়ে গেলে, বাবা তখনি লিখতে বসে গেলেন। আমি পাশের কামরায় বসে জানলা দিয়ে সকৌতুকে নদীতে নৌকা-চলাচল ও ঘাটে জনতার দৃশ্য দেখতে লাগলুম।”
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

যৌবনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পদ্মার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। কত লেখাই না নদীবক্ষে রচিত হয়েছে! কত মানুষেরই না জীবনের গল্প জেনেছেন! জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেই প্রথম চিনেছেন, দেখেছেন গ্রামীণজীবন। পদ্মায় ঘুরতে ঘুরতে প্রকৃতির আশ্চর্য রূপে মুগ্ধ হয়েছেন। ইন্দিরাকে লেখা চিঠিতে আছে, “বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত আমার তেমনি পদ্মা—আমার যথার্থ বাহন।”

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই পদ্মাকে কখনও ভয় পাননি রবীন্দ্রনাথ। অনন্ত জলরাশি, বইছে স্রোতধারা। তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তেও দ্বিধা করেননি তিনি। ঘটনাটির সাক্ষী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। হঠাৎ তাঁর কানে আসে, জলে কিছু একটা পড়ল। তাকিয়ে দেখলেন, বাবার “বহু পুরাতন অতি প্রিয় কটকি চটি” পড়ে গিয়েছে জলে। রথীন্দ্রনাথ ভাবতেও পারেননি, এর পরে কী ঘটতে পারে! কয়েক মুহূর্ত কাটতে না কাটতেই আবার ঝপাং শব্দ। জলের দিকে তাকিয়ে দেখে রথীন্দ্রনাথ হতবাক হলেন। সাঁতার কাটছেন তাঁর পিতৃদেব। স্রোতের টানে চটি দূরে চলে যাচ্ছে। খানিক পরেই আরও দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের হাতে পদ্মার জলে পড়ে যাওয়া এক পাটি চটি। মুখে
পরিতৃপ্তির হাসি। হাতে চটির পাটি, চোখে মুখে প্রশান্তি, পদ্মাবোটে উঠে এলেন তাঁর পিতৃদেব। সে ছবিটি রথীন্দ্রনাথের মনে চিরকালের জন্য আঁকা হয়ে গিয়েছিল।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content