শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) বন লেবুর ফলসহ শাখা। (মাঝখানে) টাগরি বানির কাঁচা ও পাকা ফল। (ডান দিকে) টাগরি বানি গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

 

বন লেবু (Merope angulata)

প্রায় দুই দশক আগে চুনপিড়ি নদী পেরিয়ে সহকর্মীদের সাথে গিয়েছিলাম চুনপিড়ি জঙ্গলে। উদ্দেশ্য ছিল বনভোজন। এই জঙ্গল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। বহুদিন আগে হরিণ ও বুনো শুয়োর পাওয়া যেত। এখন তারা বিলুপ্ত। তো এই জঙ্গলে বন লেবু গাছটির সাথে প্রথম পরিচয় হয়। চিনিয়েছিলেন এক অগ্রজ সহকর্মী। এর পাতার গন্ধ অবিকল পাতিলেবুর পাতার মতো। একটি পাতা গাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে হাতের তালুতে ডলে দিলে এই গন্ধ অনায়াসে অনুভব করা যায়। এই লেবু গাছকে মনে করা হয় বর্তমান লেবু গাছের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এরা একই পরিবারভুক্ত (Rutaceae) উদ্ভিদ। যদিও এর ফলের আকার লেবুর মতো নয় বা ফলের মধ্যে রস নেই, তাও গন্ধে সাদৃশ্য থাকায় সাধারণ সুন্দরবনবাসীদের মুখে এই গাছ বন লেবু নামেই পরিচিতি পেয়েছে।

বন লেবু গাছ মূলত গুল্ম জাতীয় গাছ। উচ্চতা হয় ১২-১৩ ফুট। ৭ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৩ থেকে ৬ সেন্টিমিটার চওড়া পাতাগুলি দেখতে প্রায় লেবু পাতার মতোই। লেবু গাছের মতো এই গাছের পাতার কক্ষ থেকেও দুটি করে কাঁটা বের হয়। পাতার কক্ষ থেকে সাদা রংয়ের ছোট ছোট ফুল জন্মায়। ফুলগুলিও সুগন্ধযুক্ত। ফুল থেকে যে ফল হয় তা দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার লম্বা। এর ডিম্বাকার ফল তিন কোণা। কাঁচা ফলের রং সবুজ, আর পাকলে হলুদ। ফল থেকে পাখির চঞ্চুর মতো একটা সূচালো অংশ বেরিয়ে থাকে। দেখলে মনে হবে ছোট ছোট তেশিরা লেবু। প্রতিটি ফলের মধ্যে চারটি বড় আকারের চ্যাপ্টা বীজ থাকে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা

বন লেবু প্রকৃতপক্ষে ম্যানগ্রোভ সহযোগী উদ্ভিদ। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে বন লেবু গাছ খুব কম দেখা যায়। জোয়ারের জল চড়ার যে অংশ পর্যন্ত সর্বোচ্চ পৌঁছয় সেই অঞ্চলেই মূলত এদের দেখা যায়। বন লেবুর লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা বেশ ভালো। তবে সুন্দরবন অংশে বিশেষ করে ভারতীয় সুন্দরবন অংশে বন লেবু গাছ বর্তমানে অতি বিরল। আই ইউ সি এন-এর তালিকায় এই গাছকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শোনা যায়, অতীতে বন লেবু ফল ফুটিয়ে জুস তৈরি করা হত। বলাবাহুল্য এর স্বাদ অনেকটা লেবুর রসের মতই হতো।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৪: কথায়-কথায়

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

 

লৌকিক চিকিৎসা

বর্তমানে গাছটি অতি বিরল হওয়ায় এর লৌকিক ব্যবহার দেখা যায় না। তবে শোনা যায় অতীতে সুন্দরবনের মানুষ পেটের নানা সমস্যায় এবং প্রসূতি মহিলা সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় বন লেবুর মূল থেকে তৈরি করা ক্বাথ ব্যবহার করত। সন্তান প্রসবের সময় তলপেটের পেশির সংকোচনে বন লেবু মূলের নির্যাস সহায়ক ছিল বলে জানা যায়।

আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

 

টাগরি বানি (Scyphiphora hydrophyllacea)

বকখালির কাছে হেনরি দ্বীপে এই গাছটি এখন যথেষ্ট দেখা যায়। অন্যত্র দেখা যায় কিনা সঠিকভাবে না জানা থাকলেও এখান থেকে যে প্রথম গাছটি সংগৃহীত হয়েছিল তা জানা যায়। বকখালি এলাকার স্থানীয় অধিবাসীরা এই গাছটিকে টাগরি বানি নামে ডাকে। গাছটি নদীর চড়া ও যেখানে জোয়ার ভাটা খেলে এমন জায়গার মাঝামাঝি জন্মাতে দেখা যায়। জোয়ারের সর্বোচ্চ সীমা এবং ভাটার সর্বনিম্ন সীমায় এদের কখনওই জন্মাতে দেখা যায় না। ৬ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার টাগরি বানি গাছ দেখা যায়। এরা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ হলেও শ্বাসমূল থাকে না। এরা মূলত গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। তবে মূলের গোড়া থেকে ছোট ছোট ঠেস মূল কখনও কখনও দেখা যায়।

আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

নামের শেষে বানি কথাটা থাকার কারণ মনে হয় বাইন বা বানি গাছের পাতার সাথে এই গাছের পাতার অনেকটা সাদৃশ্য। পাতাগুলি ডিম্বাকার আর আগার দিকটা গোল। পাতার ওপর দিকের রঙ উজ্জ্বল সবুজ, চকচকে এবং পাতা অপেক্ষাকৃত পুরু। পাতার নিচের দিকে রং ফ্যাকাশে। পাতার বৃন্ত ও নরম কান্ডের রঙ হালকা বাদামি রঙের হয়। পাতার কক্ষ থেকে সাদা রঙয়ের ছোট ছোট অসংখ্য ফুল থোকা আকারে জন্মায়। ফল বেশ ছোট ও উপবৃত্তাকার।

(বাঁদিকে) টাগরি বানির ফুল-সহ শাখা। (মাঝখানে) বন লেবু গাছ। (ডান দিকে) বন লেবু ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

কাঁচা অবস্থায় রং থাকে সবুজ আর পাকলে হলদে বা বাদামি রঙের হয়। ৮ থেকে ১০ মিলিমিটার লম্বা ও চার থেকে পাঁচ মিলিমিটার চওড়া ফলগুলো রসালো আর ফলের গায়ে লম্বালম্বি ভাবে ছয় থেকে দশটি ভাঁজ থাকে। তবে ফল দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। আর প্রতি অংশে থাকে দুটি করে বীজ। জলে ভেসে বীজ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। টাগরি বানি গাছ মূলত জ্বালানি হিসেবে স্থানীয় মানুষ ব্যবহার করে তবে অনেক সময় বেড়া দেওয়ার কাজে বা চামচ তৈরি করতে এর কাঠ ব্যবহৃত হয়।
 

লৌকিক চিকিৎসা

সুন্দরবন এলাকার মানুষ পেট ব্যথা হলে টাগরি বানি পাতার রস খায়।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content