বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’


প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যে রাঢ়বাংলা কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। এই রাঢ়ভূমির অন্যতম পীঠস্থান হল বর্ধমান। অসংখ্য নদী নালায় সিক্ত বর্ধমানের সর্বাপেক্ষা প্রতাপশালী নদ হল দামোদর। তবে এই সব নদী-নালার মাঝেই নিজস্বতায় স্বকীয় খড়্গেশ্বরী বা খড়ি নদী হল দৈর্ঘ্যের দিক থেকে চতুর্থ নদী এবং বর্ধমানের অনেক ছোট ছোট নদীর মধ্যে এই নদীটিই একমাত্র ভাগীরথীতে মেলার সুযোগ পেয়েছে। সেইদিক থেকে নদীটি এক বিশেষ গুরুত্বের অধিকারিনী। খড়িনদী উৎপন্ন হয়েছে মানকরের কাছে মাড়ো নামক এক গ্রামে এবং কিছুটা আঁকাবাঁকা ও কিছুটা সোজা পথে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কানলার নাদাই গ্রামের কাছে মিলিত হয়েছে ভাগীরথীতে। নদীটির উচ্ছলতা ও ব্যাপ্তি বিশেষ না থাকলেও গ্রামবাংলা বিশেষ করে জেলার মধ্যাঞ্চলকে সিক্ত রেখে চাষবাসের উপযোগী উর্বর মৃত্তিকা তৈরী করতে খড়ি তুলনাহীন। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা জনজাতি, উপজাতি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বাস করে আসছে এবং নদীটিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে নানান উপকথা, লোককথা ও জনশ্রুতি।

দামোদরের অতি প্রাচীন পরিতক্ত খাত হিসাবে খড়ির বর্ননা আছে বিভিন্ন গ্রন্থে। অতি প্রাচীন কালে, কোন এক সময়ে দামোদর নদ খড়ির খাত দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে হুগলি নদীতে এসে পড়ত, পরে অবশ্য ১৫-১৬ শতকে দামোদর নদ এই খাত ছেড়ে দিয়ে বাঁকা নদীর খাত বরাবর বইতে শুরু করে। এইভাবে দামোদর নানা খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রধানত বৃষ্টির জলে পুষ্ট এই নদীটি মানকর, গলসী, বর্ধমান, নর্জা, ভাতাড়, কুড়মুন মন্তেশ্বর, জামড়া, মালম্বা, পুটশুড়ি, কাটোয়া, পূর্বস্থলী ও কানলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভাগীরথীতে মিলিত হয়েছে। উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে বেশ কিছুটা অঞ্চল পাথুরে ও লাল ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, এই অঞ্চলগুলিতে নদীর গভীরতা ও বিস্তার খুব একটা বেশি হয় নয়। ক্রমে নদী যখন মধ্যভাগ ও নিম্নভাগে প্রসারিত হয়েছে, তখন নরম মৃত্তিকার জন্য নদীর ব্যাপ্তি ও গভীরতা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।

খড়ির চারটি উপনদী। সেগুলি হল—ব্রাহ্মণী, গৌর নদী, বাঁকা এবং বেহুলা নদী। বর্তমানে উপরোক্ত উপনদীগুলি প্রায় মজে গিয়ে ক্যা নেল বা নালায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্ষার জল পেয়ে তারা আবার কম বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যাদের প্রভাবে বর্ষাকালে খড়িনদী বেশ প্রানচঞ্চল হয়ে ওঠে। এছাড়াও ভাগীরথীর জল জোয়ার ভাটার সময়, প্রায় নিত্যনিয়ত খড়ির নদীর নিম্নাংশে জলস্ফীতি ঘটায়। ফলে জলুইডাঙা, পূর্বস্থলী ও নাদাইগ্রামে এখনও ছোট ছোট ডিঙ্গি বা নৌকা ভেসে বেড়ায়। ১৭৭৯ সালে রেনলের মানচিত্র দেখলে স্পষ্ট হয় যে, বর্তমান উৎপত্তিস্থলের প্রায় সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খড়ি নদীর উৎসস্থল ছিল। ১৮৪৬ সালে রেভারেণ্ড লঙের বিবরণে পাওয়া যায় খড়্গেশ্বরীর নিম্নস্থান ছিল সুনাব্যচ। ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৫ সালের রেভিনিউ সার্ভের মানচিত্রেও খড়ি সংক্রান্ত রেনলবর্ণিত মানচিত্রকেই সমর্থন করে।
অতীতে দামোদরের জলধারা অন্তত সাতটি শাখানদী ধরে প্রবাহিত হয়েছে। এরা কেউই একই সঙ্গে সক্রিয় ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিশেষত বন্যার সময় এই শাখা নদী খাতগুলি সজীব হয়ে উঠতো। ষোড়শ শতাব্দীর আগে কোন এক সময় অতীতে খড়ি নদীর শাখাটি দামোদরের প্রধান জলধারারূপে প্রবাহিত হতো। খড়ি নদীখাতের অনতিদূরে অবস্থিত বানেশ্বরডাঙ্গা ও সাঁওতালডাঙ্গা অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত তাম্রযুগের সভ্যতা ও নিদর্শন প্রমাণ করে যে, নদীটি বেশ প্রাচীন। এর তীরে আনুমানিক প্রায় তিনহাজার বছরের প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের উপস্থিতি, এই নদীর প্রাচীনত্বের সাক্ষী দেয়। খড়ি নদীর তীরে বর্ধমানের কালী সাধক কমলাকান্ত চক্রবর্তী দীর্ঘদিন সাধনা করেন, সে স্থান আজ পুন্যদভূমিতে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় মানুষদের বর্ণনায় জানা যায়, গ্রীষ্মকালে চাষের জন্য খড়ি নদীর নিম্নাংশগুলিতে টিউবওয়েল ও পাম্প বসাতে গেলে, পূর্বে কোন কোন স্থানে ভূগর্ভস্থ জল ফোয়ারার মত বের হয়ে আসতো। এটিও নদীর প্রাচীনত্বকে প্রমাণ করে বলে অনেকে মনে করেন। কালক্রমে নদীখাতে অপ্রতুল জলপ্রবাহ, নদীবাহিত পলির সঞ্চয়, বন্যা ও নবভূগাঠনিক পরিবর্তন দামোদর নদীর গতিপথকে বারবারই পরিবর্তন করে। ১৮৫০ সালের পরবর্তী সময়ে বন্যারজল যাতে দামোদর অববাহিকা থেকে উপচে অজয় অববাহিকায় না প্রবেশ করতে পারে, সেই জন্য দামোদরের সঙ্গে খড়ি নদীর সংযোগ ছিন্ন করা হয় এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন করে অন্যান্য নদীখাতের সঙ্গে খড়ি নদীখাতের সংযোগ করার চেষ্টা করা হয়, যার ফলে খড়ি এইরূপ শীর্ণকায়া হয়ে পড়ে। এছাড়া খড়ির দুপাশে অবস্থিত একক নদী মঞ্চের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, অতীতে নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে এবং এই ঘটনা প্রমাণ করে নদীটি প্রাচীন বা প্রাচীন কোনও বড় নদীর শাখা। অতীতে নদীটি সোজাসুজি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে দামোদরের প্রধান শাখারূপে কাটোয়ার কাছে ভাগীরথীতে প্রোথিত হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে নদীবাহিত ও সঞ্চিত পলির চাপে খড়ি নদীর নিম্নাংশ তার গতিপথ পরিবর্তন করে, পূর্ব ও দক্ষিণমুখী হয়ে পড়ে এবং তার বর্তমান সঙ্গমস্থলে এসে উপস্থিত হয়।
 

লোককথায় খড়ি নদী

বর্ধমানবাসীর প্রিয় খড়িনদীর জন্মের সঙ্গে মিশে আছে লোককথা। কথিত মাড়োগ্রামে কালাচাঁদ গোস্বামী নামে এক সাত্বিক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। সর্বদা ধর্মচর্চা নিয়েই তিনি সময় কাটাতেন। রুক্ষ, শুষ্ক ওই অঞ্চলে পরপর কয়েক বছর অনাবৃষ্টি হয়। গ্রামের অসহায় মানুষ ওই ব্রাহ্মণের শরণাপন্ন হন। তিনি তখন বরুনদেবের জন্য ‘মুনুই’ পুজোর আয়োজন করেন। তাঁর এবং অসহায় গ্রামবাসীর কাতর আহবানে মহামায়া এক বালিকা বেশে তাঁর কাছে ধরা দিলেন। ওই বালিকার গাত্রবর্ণ খড়ির মতো সাদা। মেয়েটি তার আত্মপরিচয়ে বলল তার নাম খড়ি, তার সাতকুলে কেউ নেই। নিঃসন্তান ব্রাহ্মণ তাকে আদর করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান এবং কন্যারূপে তাকে মানুষ করতে থাকে। কিন্তু মেয়েটি যখন ধীরে ধীরে যৌবনবতী হয়ে ওঠে, তখন ব্রাহ্মণী কেবলমাত্র সন্দেহের বশে তার ওপর বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার করতে থাকে এবং তাকে এঁটো খাবার দাবার দিতে থাকে। এ কথা জানতে পেরে খড়ি ব্রাহ্মণ গৃহত্যাগ করে। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ খড়ি তখন মন্দিরে গিয়ে মা কালীর খাঁড়া দিয়ে নিজের জিভ কেটে, স্বমূর্তি ধারণ করে, পরে সেই স্থান ত্যা গ করে। ভক্তিপ্রবন ব্রাহ্মণ, মা মা বলে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পিছু ধাওয়া করতে থাকে। খড়িমাও কখনও আঁকাবাঁকা পথ কখনও বা সোজা পথে ছুটতে ছুটতে অবশেষে এসে ভাগীরথীর জলে ঝাঁপ দেয়।

আরও পড়ুন:

দেশে ট্রান্সফর্মারের জনক পদার্থবিজ্ঞানী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?

খড়িমা যে পথ দিয়ে চলতে চলতে ভাগীরথীতে পড়েছিল, সেটাই খড়ি নদীর গতিপথ। তাই খড়ির গতিপথ কখনো বক্র, কখনো ঋজু। কালাচাঁদ গোঁসাই তখন কন্যাসম খড়িকে হারিয়ে, হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। এমন সময় আকাশবাণী হয়, ‘আমি তোমার সেবায় খুশি হয়েছি, তুমি বাড়ি যাও। বাড়ির পাশে আস্তাকুঁড় খুড়ে যা পাবে সেটা তোমার’। ব্রাহ্মণবাড়ি ফিরে আস্তাকুঁড় কুড়ে, ঘড়াভর্তি মোহর পেল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ব্রাহ্মণী মাটি খোঁড়ার সময় সর্পাঘাতে মৃত্যুবরণ করল। এই ঘটনা ক্রমে ক্রমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তখন থেকে ওই অঞ্চলের মানুষ খড়্গেশ্বরী বা খড়িকে দেবতা জ্ঞানে পূজা শুরু করলো। এখনও মাড়ো গ্রামে দেবী মন্দির আছে, সেখানে খড়িমাতা নিত্য পূজিত হন। বছরান্তে পৌষসংক্রান্তির দিন খড়িনদীর তীরে মাড়ো গ্রাম সহ বড়কয়রাপুর, মালডাঙ্গা, পানবড়ুই, মালম্বা, ন্যাড়াগোয়াল, জামরা ও নাদনঘাট ইত্যাদি স্থানে আজও মেলা বসে এবং বিপুল ভক্তসমাগম হয়। তবে পূর্বে মেলাকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা বেশি থাকলেও, এখন তা বেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেছে। খড়িমায়ের মূর্তির উচ্চতা প্রায় দুই থেকে তিন ফুট। পরবর্তীকালে, কালাপাহাড়ের খর্গের আঘাতে মূর্তি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাই বর্তমানে অতি উজ্জ্বলবর্ণের মৃৎমূর্তি আছে। তবে এতে দেবীর মহিমা ও মাহাত্ম্য কোন অংশে কমে যায় নাই বরং আজও তা প্রবল বেগে প্রবাহমান। এ থেকে নদীর প্রাচীনত্বেরও কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

খড়ি নদীর জল এবং নদীর বর্তমান স্বাস্থ্য

নদীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত যদি জলের গুণমান বিচার করা হয়, তাহলে বলা যেতে পারে, এখনো পর্যন্ত জল স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। তবে বর্ষাকালে জলের গুণমান ও পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে, নদীর তীরে খুব একটা বেশি শিল্প গড়ে ওঠে নাই, তবে মানুষের বসবাস এবং কৃষিকাজ আছে বটে, কিন্তু তা নদীর স্বাস্থ্য ও বাস্তুতন্ত্রকে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে নাই। পলিমাটির মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে জল কিছুটা ঘোলাটে বটে, তবে তা বিষাক্ত নয়। নদীর গতিপথের অধিকাংশ অংশ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, কিছু কিছু স্থানে রাইস মিল, খাবার ডিস তৈরি করার মিল ও বিশেষ উল্লেখযোগ্য নর্জার পেপারমিল ছাড়া বড় কোন কারখানা নেই। বিশেষ স্থানগুলিকে নদীর জল কিছুটা হলেও বিষাক্ত হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে স্থানীয় মানুষের সাথে আলোচনার ফলে জানা গেছে, খড়িনদীর জলে ভাত ফোটালে ভাত হয় অত্যন্ত সাদা এবং তা সহজে গলে যায় না। কারণ হিসাবে মনে হয়, নদীর মধ্যে খনিজ লবণের পরিমাণ বেশি।

আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

তবে নদীর গভীরতা পলল সঞ্চয়ের ফলে অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে এবং নদীর পাড় বরাবর কৃষিকার্যের ফলে তৈরি হওয়া অসংখ্য সাবমার্সিবেল ও ডীপওয়েল তৈরি হওরার ফলে, নদীর জল শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীর উপর ছোট-বড় অনেক বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর সাধারণ বহতা কমে গেছে এবং সেই স্থানগুলিতে নদীর গতিপথ হয়েছে শ্লথ। কোন কোন স্থানে বাড়ি তৈরির ফিলিং বালি খনন করা হচ্ছে নদীর চর থেকে। তার ফলে নদীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেখা গেছে বর্ষা বা অতি বর্ষণের সময়, খড়ি নদী থেকে উপচে পড়া জল আশেপাশের অঞ্চলকে প্লাবিত করে, উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০০০ সালের বন্যাা, খড়ির বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে দারুণভাবে প্লাবিত করেছিল। বর্ষার সময় ব্যতীত প্রায় সারা বছর, নদীর গতিপথে জল কমে যাওয়ার ফলে কচুরিপানার আবির্ভাব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, মালম্বায় নদীর সাধারণ গতিপথ প্রায় শুষ্ক হয়ে কচুরিপানায় ভর্তি হয়ে গেছে। তারই একটি বাঁক বা স্থানীয় মানুষদের ভাষায় বাওর, পানবড়ুই গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গিয়ে আবার কুলি গ্রামে মূল নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ উপর থেকে দেখলে বাঁক এবং নদী মিলিত হয়ে একটি চোখের মতো অঞ্চল সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ নদীর অধিক বক্রতা বা মোচড় খাওয়া, স্থানে স্থানে নদীর মজে যাওয়ার কারণ বলে মনে করা হয়। মোটের উপর বলা যেতে পারে, খড়ি আর ভালো নেই।
 

নদীর পাড়ের গাছ-গাছালি

পলিমাটি সিক্ত নদীর দুকুল বরাবর স্বাভাবিকভাবেই সবুজতা ও গাছগাছালি অনেক বেশি। বৃক্ষ শ্রেণির মধ্যে বাবলা ও অর্জুন গাছের প্রাধান্য থাকলেও শিরিষ গাছ, স্থানে স্থানে বেল গাছ, শ্যাওড়াগাছ, তাল, খেজুর এবং অশথ্ব ও বটগাছের সংখ্যাও কম নয়। গুল্মশ্রেণির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাঁটাগাছ, ভেরেন্ডা গাছ এবং বঁইচি ফলের গাছ চোখে পড়ার মতো। ঔষধি গাছের মধ্যে থানকুনি, নিম গাছ ও গাঁধালপাতার গাছ অন্যতম। তৃণশ্রেণী বলতে বহু ধরনের ঘাস, বিশেষ করে বেনা ঘাস, কাশফুল গাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশগাছ লক্ষ্য করা যায়। জলের মধ্যে পাওয়া যায় স্পাইরোগাইরা সহ নানান শৈবাল, কচুরিপানা টোপাপানা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

এছাড়াও পঞ্চায়েতের নানান উন্নয়নমূলক কাজের জন্য, নদীরপাড় বরাবর মানুষ সৃষ্ট বনভূমি তৈরি করা হচ্ছে। মন্তেশ্বরের কাছে একটি গ্রাম, যা খড়ি নদীর তীরে অবস্থিত, নাম গলাতুন। সেখানে, উকুন পাড়ের ডাঙাতে প্রায় ৫০০ একর অঞ্চলজুড়ে বনভূমি তৈরি করা হয়েছে পঞ্চায়েত থেকে। এখানে সোনাঝুরি সহ নানান ধরনের গাছ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও নদীর পাড়ে পাড়ে অবস্থিত হিন্দুদের শ্মশান, বিভিন্ন মন্দির, মুসলিমদের দরগা ও কবরস্থানগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই ধর্মের কারণে মানুষের যাতায়াত কম। এর ফলে সেখানে ঘনজঙ্গল সৃষ্টি হয়েছে। যে স্থানগুলির স্যা ক্রেড গ্রোভ বা পবিত্র স্থান নামে পরিচিত অর্থাৎ ধর্মের কারণে সেখানে স্বাভাবিক বনভূমি গড়ে উঠেছে।
 

নদীর মাছ

নদী হতে পারে ক্ষুদ্র বা বৃহৎ কিন্তু তাকে ঘিরে আবর্তিত হয় নানান জীববৈচিত্র। খড়িনদী তার ব্যতিক্রম নয়। ভাগীরথীর সাথে সংযুক্ত হওয়ার কারণে, অতীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যেত বলে নদীর নিম্নাংশের স্থানীয় মানুষরা দাবি করেন। কিন্তু বর্তমানে ইলিশ মাছ যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি পাওয়া যায় না আরো নানান ধরনের মাছ। কিন্তু আজও সেখানে পাওয়া যায় বোয়াল মাছ, নদীর ট্যাং রামাছ, বাটামাছ, ল্যাটা ও চ্যাংমাছ, পাকাল মাছ, গজে পাকাল, তিতপুঁটি, সরপুঁটি, দাঁড়কে, খলসে, তেচোখো, মৌরালা, ফলুই, রুই, কাতলা ও মৃগেল মাছ ইত্যাদি। একটা সময় জেলে, দুলে, বাগদী সম্প্রদায়ের পুরুষ এবং মহিলারা মাছ ধরা ও বিক্রির ওপর নির্ভরশীল ছিল। সকালের দিকে কাঁধে ছোট ছোট মাছ ধরার জাল, হাড়ি ও থালা নিয়ে তারা বের হতো। নদীর স্রোতের দিকে জাল পেতে অথবা খাড়ুই নিয়ে তারা তুলে নিত চুনোমাছ সহ নানান মাছ। কাঁকড়া, গুগলি কিছুই বাদ যেত না এবং তা বিক্রি করে তাদের জীবন-জীবিকা চলত। কিন্তু নদীর জল কমে যাওয়া ও কিছুটা হলেও জলদূষণের ফলে জলজ প্রাণীর সংখ্যা বর্তমানে কমে গেছে, তাই হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার এই একান্ত নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

 

খড়ির পাড়ে জীব বৈচিত্র

খড়ি নদীর পাড় অত্যন্ত শান্তশিষ্ট এবং নদীতে প্রায় সারা বছরই অল্প-বিস্তর জল প্রবাহিত হয় ও নদীর শান্ত পাড় এখনও পাখপাখালিতে পরিপূর্ণ। নদীর গতিপথে বিস্তীর্ণ অঞ্চল পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে আলোচনার সুবাদে জানা গেছে আজও নদীর পাড়ে খেঁকশিয়াল ও ভোঁরশিয়ালের ডাক শোনা যায়, পাওয়া যায় খট্টাস, ভাম, গোসাপ, নানান প্রজাতির সাপ ইত্যাদি। বিভিন্ন বটগাছ ও অশথ্ব গাছগুলিতে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় বাস করে। এক বয়স্ক মানুষের সাথে আলোচনায় জানা গেল, মালম্বা থেকে পানবড়ুই যাবার রাস্তায় সন্ধেবেলায় কেউ একা হেঁটে বা সাইকেল নিয়েও আসতে পারে না, কারণ সেখানে শিয়ালের সংখ্যা এতই বেশি। নদীর সঙ্গে বেঁচে থাক এই প্রাণস্পন্দনতা।
 

সুভাবনায় খড়্গেশ্বরী

খড়ি রাঢ়বঙ্গের এক অনাদৃত নদী। তার জল যতই কাকচক্ষুর মত স্বচ্ছ হোক না কেন, তার পাড়ে যতই কলকাকলি গুঞ্জরিত হোক না কেন, এই নদী নিয়ে সরকার তথা মানুষের সচেতনতা কম, কম তাদের দায়িত্ববোধও। নদী মজে যাচ্ছে, নদীর পাড়ে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হচ্ছে কলকারখানা, নদীর বুক চিরে গড়ে উঠছে বাঁধ, নদীর পাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে, তবু লাগানো হচ্ছে না কোন গাছ। সরকার থেকে আরও বেশি সামাজিক বনসৃজনের প্রয়োজন আছে। খড়িকে নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন। কেন খড়ি নদীর জলে ভাত ফোটালে, ভাত হয় সাদা? জলের কোয়ালিটি কেমন? দূষণের মাত্রাই বা কেমন? নদীর তীরে যে কারখানাগুলি গড়ে উঠছে, তারা পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড থেকে দূষণ সংক্রান্ত উপযুক্ত অনুমতিপত্র নিচ্ছে তো? কেন খড়ি নদীর তীরে এত ইরিগেশন পাম্প বসানো হচ্ছে? সরকারের অনুমতি তারা নিচ্ছে তো? অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। এই নদীর উপনদীগুলিতে একশ দিনের কাজের সময় খননকার্যের প্রয়োজন আছে। সমগ্র খড়িনদী বরাবর বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা কচুরিপানা পরিষ্কার করার জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা ও অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন।

গবেষকদের মতে, সাঁওতালডাঙ্গা ও বানেশ্বরডাঙ্গায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ কেন এগুলি নিয়ে আরো বেশি কাজ করছে না! খড়ি এক অনামী, অনাদৃত নদী বলে? এরই মধ্যে ভালো ব্যাপার হলো পূর্বে বর্ণিত গলাতুনের কাছে উকুনপাড়ের ডাঙ্গায় পঞ্চায়েত থেকে সামাজিক বনসৃজন করেছে। এই ভাবে কেবল সরকার নয়, কেবল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নয়, সর্বস্তরের মানুষকে সর্বতোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ নদী কারো একার সম্পত্তি নয়, নদী সবার।—চলবে।

তথ্যসূত্র:
বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি- ১ম খণ্ড- যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
বাংলার নদীকথা-কল্যাণ রুদ্র: সাহিত্য সংসদ, ২০০৮
বাংলার নদ-নদী-দিলীপ কুমার চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং-২০০৭
বাংলাদেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা-কপিল ভট্টাচার্য-১৯৫৯, বিদ্যোদয় লাইব্রেরি প্রাইভেট লিমিটেড।
ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে মানকর, মাড়ো, অমরারগড়-ধীরেন্দ্রনাথ মেটে, ISBN 81-88064-00-9
Rivers of the Ganga-Brahmaputra-Meghna Delta-A fluvial account of Bengal- Kalyan Rudra, Springer- International publishing AG, part of springer Nature, ISBN 978-3-319-76543-3
Imprints of Neotectonism in the Evolutionary Record along the course of Khati River in Damodar Fan Delta of Lower Ganga Basin Quaternary Geomorphology in India, pages: 105-126, 2019- Suman Deb Barman and et. al
Bengal Dist. Gazetteers, Burdwan- J.C.K. Peterson
Archaeological discovery at Baneswar Danga, unpublished report of P.C Dasgupta
খড়্গেশ্বরী, খড়ি নদী-সব বাংলায়, ইন্টারনেট সংস্করণ
অচলা নদী-এই সময় (১৫.০৭.২০১৭)

স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতা
প্রদীপ ঘটক-মালডাঙ্গা
অরিন্দম ঘোষ-বড়কয়রাপুর
কমল ঘোষ-পানবড়ুই
বংশধর ঘোষ-জামড়া

* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content