ছবি: প্রতীকী।
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’
প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যে রাঢ়বাংলা কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। এই রাঢ়ভূমির অন্যতম পীঠস্থান হল বর্ধমান। অসংখ্য নদী নালায় সিক্ত বর্ধমানের সর্বাপেক্ষা প্রতাপশালী নদ হল দামোদর। তবে এই সব নদী-নালার মাঝেই নিজস্বতায় স্বকীয় খড়্গেশ্বরী বা খড়ি নদী হল দৈর্ঘ্যের দিক থেকে চতুর্থ নদী এবং বর্ধমানের অনেক ছোট ছোট নদীর মধ্যে এই নদীটিই একমাত্র ভাগীরথীতে মেলার সুযোগ পেয়েছে। সেইদিক থেকে নদীটি এক বিশেষ গুরুত্বের অধিকারিনী। খড়িনদী উৎপন্ন হয়েছে মানকরের কাছে মাড়ো নামক এক গ্রামে এবং কিছুটা আঁকাবাঁকা ও কিছুটা সোজা পথে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কানলার নাদাই গ্রামের কাছে মিলিত হয়েছে ভাগীরথীতে। নদীটির উচ্ছলতা ও ব্যাপ্তি বিশেষ না থাকলেও গ্রামবাংলা বিশেষ করে জেলার মধ্যাঞ্চলকে সিক্ত রেখে চাষবাসের উপযোগী উর্বর মৃত্তিকা তৈরী করতে খড়ি তুলনাহীন। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা জনজাতি, উপজাতি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বাস করে আসছে এবং নদীটিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে নানান উপকথা, লোককথা ও জনশ্রুতি।
দামোদরের অতি প্রাচীন পরিতক্ত খাত হিসাবে খড়ির বর্ননা আছে বিভিন্ন গ্রন্থে। অতি প্রাচীন কালে, কোন এক সময়ে দামোদর নদ খড়ির খাত দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে হুগলি নদীতে এসে পড়ত, পরে অবশ্য ১৫-১৬ শতকে দামোদর নদ এই খাত ছেড়ে দিয়ে বাঁকা নদীর খাত বরাবর বইতে শুরু করে। এইভাবে দামোদর নানা খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রধানত বৃষ্টির জলে পুষ্ট এই নদীটি মানকর, গলসী, বর্ধমান, নর্জা, ভাতাড়, কুড়মুন মন্তেশ্বর, জামড়া, মালম্বা, পুটশুড়ি, কাটোয়া, পূর্বস্থলী ও কানলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভাগীরথীতে মিলিত হয়েছে। উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে বেশ কিছুটা অঞ্চল পাথুরে ও লাল ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, এই অঞ্চলগুলিতে নদীর গভীরতা ও বিস্তার খুব একটা বেশি হয় নয়। ক্রমে নদী যখন মধ্যভাগ ও নিম্নভাগে প্রসারিত হয়েছে, তখন নরম মৃত্তিকার জন্য নদীর ব্যাপ্তি ও গভীরতা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।
খড়ির চারটি উপনদী। সেগুলি হল—ব্রাহ্মণী, গৌর নদী, বাঁকা এবং বেহুলা নদী। বর্তমানে উপরোক্ত উপনদীগুলি প্রায় মজে গিয়ে ক্যা নেল বা নালায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্ষার জল পেয়ে তারা আবার কম বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যাদের প্রভাবে বর্ষাকালে খড়িনদী বেশ প্রানচঞ্চল হয়ে ওঠে। এছাড়াও ভাগীরথীর জল জোয়ার ভাটার সময়, প্রায় নিত্যনিয়ত খড়ির নদীর নিম্নাংশে জলস্ফীতি ঘটায়। ফলে জলুইডাঙা, পূর্বস্থলী ও নাদাইগ্রামে এখনও ছোট ছোট ডিঙ্গি বা নৌকা ভেসে বেড়ায়। ১৭৭৯ সালে রেনলের মানচিত্র দেখলে স্পষ্ট হয় যে, বর্তমান উৎপত্তিস্থলের প্রায় সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খড়ি নদীর উৎসস্থল ছিল। ১৮৪৬ সালে রেভারেণ্ড লঙের বিবরণে পাওয়া যায় খড়্গেশ্বরীর নিম্নস্থান ছিল সুনাব্যচ। ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৫ সালের রেভিনিউ সার্ভের মানচিত্রেও খড়ি সংক্রান্ত রেনলবর্ণিত মানচিত্রকেই সমর্থন করে।
স্থানীয় মানুষদের বর্ণনায় জানা যায়, গ্রীষ্মকালে চাষের জন্য খড়ি নদীর নিম্নাংশগুলিতে টিউবওয়েল ও পাম্প বসাতে গেলে, পূর্বে কোন কোন স্থানে ভূগর্ভস্থ জল ফোয়ারার মত বের হয়ে আসতো। এটিও নদীর প্রাচীনত্বকে প্রমাণ করে বলে অনেকে মনে করেন। কালক্রমে নদীখাতে অপ্রতুল জলপ্রবাহ, নদীবাহিত পলির সঞ্চয়, বন্যা ও নবভূগাঠনিক পরিবর্তন দামোদর নদীর গতিপথকে বারবারই পরিবর্তন করে। ১৮৫০ সালের পরবর্তী সময়ে বন্যারজল যাতে দামোদর অববাহিকা থেকে উপচে অজয় অববাহিকায় না প্রবেশ করতে পারে, সেই জন্য দামোদরের সঙ্গে খড়ি নদীর সংযোগ ছিন্ন করা হয় এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন করে অন্যান্য নদীখাতের সঙ্গে খড়ি নদীখাতের সংযোগ করার চেষ্টা করা হয়, যার ফলে খড়ি এইরূপ শীর্ণকায়া হয়ে পড়ে। এছাড়া খড়ির দুপাশে অবস্থিত একক নদী মঞ্চের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, অতীতে নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে এবং এই ঘটনা প্রমাণ করে নদীটি প্রাচীন বা প্রাচীন কোনও বড় নদীর শাখা। অতীতে নদীটি সোজাসুজি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে দামোদরের প্রধান শাখারূপে কাটোয়ার কাছে ভাগীরথীতে প্রোথিত হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে নদীবাহিত ও সঞ্চিত পলির চাপে খড়ি নদীর নিম্নাংশ তার গতিপথ পরিবর্তন করে, পূর্ব ও দক্ষিণমুখী হয়ে পড়ে এবং তার বর্তমান সঙ্গমস্থলে এসে উপস্থিত হয়।
লোককথায় খড়ি নদী
দেশে ট্রান্সফর্মারের জনক পদার্থবিজ্ঞানী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?
খড়ি নদীর জল এবং নদীর বর্তমান স্বাস্থ্য
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
নদীর পাড়ের গাছ-গাছালি
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না
নদীর মাছ
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও
খড়ির পাড়ে জীব বৈচিত্র
সুভাবনায় খড়্গেশ্বরী
গবেষকদের মতে, সাঁওতালডাঙ্গা ও বানেশ্বরডাঙ্গায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ কেন এগুলি নিয়ে আরো বেশি কাজ করছে না! খড়ি এক অনামী, অনাদৃত নদী বলে? এরই মধ্যে ভালো ব্যাপার হলো পূর্বে বর্ণিত গলাতুনের কাছে উকুনপাড়ের ডাঙ্গায় পঞ্চায়েত থেকে সামাজিক বনসৃজন করেছে। এই ভাবে কেবল সরকার নয়, কেবল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নয়, সর্বস্তরের মানুষকে সর্বতোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ নদী কারো একার সম্পত্তি নয়, নদী সবার।—চলবে।
তথ্যসূত্র:
স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতা