রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ। প্রথম ভারতীয় আইসিএস। সেই যুগে চিন্তায়-চেতনায় এমন আধুনিক, এমন স্বাধীনচেতা মানুষ খুব বেশি ছিল না। কত দিকে তাঁর আগ্রহ, নানা ক্ষেত্রে দক্ষতা। সাহিত্যে ও সংগীতে পারদর্শিতার কথা আমরা জানি। তাঁর স্মৃতিচর্চার বইগুলো ঠাকুরবাড়িকে জানার জন্য, সেই সময়কে জানার জন্য কাজে লাগে। অন্য লেখাপত্তর আড়ালেই রয়ে গিয়েছে। ছোটোদের জন্যও সত্যেন্দ্রনাথ কলম ধরেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর তখন ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদক। ‘সন্দেশ’-এর পাতায় সত্যেন্দ্রনাথ গল্প লিখেছিলেন। সে গল্পের নাম ‘হাবুর বাবুগিরি’। ছাপা হয়েছিল প্রথম বর্ষের, দ্বিতীয় সংখ্যায়। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সেই অবিস্মরণীয় দেশাত্মবোধক সংগীত, ‘মিলে সবে ভারত সন্তান।’
সত্যেন্দ্রনাথের উজ্জ্বল ছাত্রজীবন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এন্ট্রান্স পরীক্ষা সবে তখন চালু হয়েছে। প্রথম বছরই পরীক্ষা দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। প্রথম বিভাগে পাশ করে বর্ধমানরাজের বৃত্তি পেয়েছিলেন, মাসিক দশটাকা। ওই একই বছরে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রও।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় সহপাঠী হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন কেশবচন্দ্র সেনকে। সহপাঠী বন্ধুকে সত্যেন্দ্রনাথই তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কেশবচন্দ্রের ব্রাহ্মধর্মের প্রতি যে আকর্ষণ, এই ধর্ম বিস্তারে পরবর্তীকালে তাঁর যে সক্রিয় ভূমিকা, তার আড়ালে ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রেরণা। পরস্পরের সেই প্রীতিময় সম্পর্ক পরে অবশ্য বিঘ্নিত হয়েছিল। সে আর এক প্রসঙ্গ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৪: জোড়াসাঁকোয় পাগল-যাচাই

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?

ছাত্রাবস্থাতেই বিবাহ, যশোরের জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে। বালিকা বয়সেই জ্ঞানদানন্দিনীর ঠাকুরবাড়িতে আগমন। নিজের মতো করে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে গড়েছিলেন। অন্তঃপুরে রক্ষণশীলতার যে বেড়াজাল ছিল, তা ভাঙার জন্য জ্ঞানদানন্দিনীকে তিনি পাশে পেয়েছিলেন। সহসা পত্নী পাশে এসে দাঁড়ালেন, একই সুর, একই ভাবনা তাঁর মধ্যেও দেখা গেল, ব্যাপারটি ঠিক তেমন নয়। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে আলো-অন্ধকার চেনাতে পেরেছিলেন। মেয়েজীবন নিয়ে যে সংকীর্ণ ভাবনাচিন্তা প্রচলিত ছিল, তার বাইরে জ্ঞানদানন্দিনীকে আনতে চেয়েছিলেন। আনতে পেরেওছিলেন।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।

মহর্ষিদেবের ভাবনার সীমাবদ্ধতা ছিল। ছিল রকমারি সংকীর্ণতা। এই সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সত্যেন্দ্রনাথ কথা বলেছিলেন। পত্নীকে লেখা সত্যেন্দ্রনাথের এক চিঠি থেকে মহর্ষিদেবের অবস্থান বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বাবামহাশয় চান আমি যেন অন্তঃপুরের মানমর্যাদার উপরে হস্তক্ষেপ না করি, অর্থাৎ তোমাকে চিরজীবনের মতো চারি প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখি। তোমাকে আমি কারারুদ্ধ রাখিয়া কখনোই সুখী থাকিতে পারিব না।’
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পরীক্ষায় সাফল্য-লাভ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। পরাধীন দেশের এক নাগরিকের বিরল স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি, এই সাফল্য দেশের মানুষকেও উজ্জীবিত করেছিল। সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে আইসিএস পড়তে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনোমোহন ঘোষও গিয়েছিলেন। একাধিক ধাপে এই পরীক্ষা হয়ে থাকে। শেষ পরীক্ষা দিয়েছিল বাহান্নজন। তার মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ষষ্ঠ, এটা কম বড়ো কথা নয়। মনোমোহন ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরস্পরের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। মনোমোহনের পিতা রামলোচন ঘোষ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথের পরম বন্ধু। সেই সূত্রেই এই সখ্য।

মনোমোহন ঘোষ।

দুই বন্ধু, সত্যেন্দ্রনাথ ও মনোমোহন একই মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তেন। মাস্টারমশায় সত্যেন্দ্রনাথের নয়, প্রশংসা করতেন মনোমোহনের। বলতেন,‘যুবার ধড়ে বুড়ার মাথা।’ এ তাঁর মেধার স্বীকৃতি, বুদ্ধিমত্তার স্বীকৃতি। আসলে বয়সে নয়, মেধায়, মনন, ভানায় মনোমোহন পরিপক্কতা অর্জন করেছিলেন। তখন সত্যেন্দ্রনাথের বছর সতেরো বয়েস। ওই বয়সেই ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার সম্পাদকীয় ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। ওই বয়সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ার ভাবনাও অভিনব। আসলে বয়সে নয়, মেধায়, মননে মনোমোহন পরিপক্বতা অর্জন করেছিলেন। ‘আমার বাল্যকাল’ নামে সত্যেন্দ্রনাথের একটি বই আছে। সে বই থেকে জানা যায়, মনোমোহন ওই পরীক্ষায় সফল হতে পারেননি। তাঁর মনের সাধ অপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল। শেষে ব্যারিস্টারি পড়েন। ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেছিলেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৩: জোর কা ঝটকা

মনোমোহনের কৃতকার্য না হতে পারায় বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথও বিচলিত হয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ নিজের পাশ করা নিয়েই খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। তাই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে আগেভাগে চিঠি লিখে জানিয়ে রেখেছিলেন, আইসিএস হতে না পারলে তিনি ব্যারিস্টার হবেন। ব্যারিস্টারির পরীক্ষায় বসবেন। খুড়তুতো দাদা গণেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর খুব নৈকট্য ছিল। মুখে বলতেন ‘মেজদা’, আসলে বন্ধুর মতো মিশতেন। গণেন্দ্রনাথকে লেখা, তাঁর কিছু চিঠি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসদনে সংরক্ষিত রয়েছে। তেমনই এক চিঠিতে আছে, ‘সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাতে নিরাশ হইলেও শূন্য হস্তে না ফিরিয়া গিয়া বার-এর মধ্যে একজন হইয়া যাইতে পারি। এ বিষয়ে মনে করিতেছি বাবা মহাশয়কে লিখিয়া দেখিব, দেখি তিনি কী বলেন।’

গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভাবলে মনে বিস্ময়ের উদ্রেক হয়, সত্যেন্দ্রনাথ ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী; অথচ পরীক্ষায় সাফল্য-লাভ নিয়ে তার মনে যথেষ্ট সন্দেহ জেগেছিল। দৃঢ়চেতা হয়েও নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। সে কারণেই এভাবে পিতৃদেবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আগাম জানিয়ে রেখে নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে রাখতে চেয়েছিলেন। কয়েক মাস কাটতে না কাটতেই প্রমাণিত হয়, কতখানি ভুল ধারণার দ্বারা তিনি চালিত হয়েছেন। নিজের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের কোনও কারণ নেই। জীবনের সব পরীক্ষায় যেমন তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন, এ পরীক্ষা যতই শক্ত হোক না কেন, উত্তীর্ণ হয়েছেন তেমনই কৃতিত্বের সঙ্গে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৩: ইউ এফ ও

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

‘মেজদা’ গণেন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন সেই আনন্দ সংবাদ। তাঁর মেধার গভীরতা সম্পর্কে কম বেশি সকলেই জানতেন। তিনি কৃতকার্য হবেন, এমনটি প্রিয়জনরা ভেবে নিলেও তিনি তো ভাবেননি। তাই মেজদাকে লেখা চিঠিতে মিশে রয়েছে বিস্ময় ও আনন্দ। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার পরীক্ষা সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে এবং যাহা কখনো আশা করি নাই, আমি তাহাতে কৃতকার্য হইয়াছি। ষাটজন এ বৎসর পরীক্ষায় পরিগৃহীত হইয়াছে। তাহার মধ্যে আমার সংখ্যা ৪৩ —নিতান্ত নীচে নয়।’

এই চিঠিতেই সত্যেন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু ‘মনোমোহন উত্তীর্ণ হইতে পারে নাই।’ ছিল আরও রকমারি পরিকল্পনার কথা। প্যারিসের কথা। প্যারিস-ভ্রমণকালে তিনি ম্যাক্সমুলারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন, রয়েছে সেই আনন্দস্মৃতি।

কেশবচন্দ্র সেন।

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত চাকরি হয় সত্যেন্দ্রনাথের। অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেটের পদে। চাকরির প্রথম কর্মস্থল আমেদাবাদ। সত্যেন্দ্রনাথের স্বাধীনচেতা মনোভাব চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর আরও দৃঢ় হয়। মহর্ষিদেবের যে ব্যক্তিত্ব, যে কঠোরতা, তাতে চিড় ধরে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেবেলা’ বইতে লিখেছেন, ‘আমি তখন শিশু, মেজদাদা সিভিলিয়ান হয়ে দেশে ফিরেছেন। বোম্বাইয়ে প্রথম তাঁর কাজে যোগ দিতে যাবার সময় বাইরের লোকদের অবাক করে দিয়ে তাদের চোখের সামনে দিয়ে বউ ঠাকুরাণকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন বাড়ির বউকে পরিবারের মধ্যে না রেখে দূর বিদেশে নিয়ে।… আপন লোকদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।’

জ্ঞানদানন্দিনীকে সামনে রেখে আধুনিকতার আলোর যে বিচ্ছুরণ সত্যেন্দ্রনাথ ঘটিয়েছিলেন, তা বৃহত্তর সমাজজীবনে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content