শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সোফিয়া ও টলস্টয়।

টলস্টয় কিন্তু অতি উৎসাহে এবং দুরন্ত আশায় সংসার শুরু করলেন। নবপরিণীতাকে ভালোবাসায় ভরাবেন, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা হবেন…এমন অনেক প্রতিজ্ঞা ও স্বপ্ন তার। সোফিয়াও বিয়ে নিয়ে আদর্শবাদী কিন্তু রক্ষণশীল ছিলেন। পরবর্তীতে তাদের কন্যা তাতিয়ানা (Tatiana) লিখেছেন—মা বিয়ের পরদিন সকালে স্বামীর সঙ্গে রাত কাটানোয় এত লজ্জিত ও সঙ্কুচিত হয়েছিলেন যে, শোবার ঘর থেকে বাইরে আসছিলেন না। বালিশে মুখ ঢেকে কাঁদছিলেন।
সরলমতি, নিষ্পাপ সোফিয়ার লজ্জা আরও বেড়ে গেল যখন টলস্টয়ের প্রাক বিবাহের নারীদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা মনে পড়ল। যদিও বিয়ের পর টলস্টয় স্ত্রীর প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন, সোফিয়া তার আগের উচ্ছৃঙ্খল জীবন ভুলতে পারেননি। অনেক বছর পর ১৮৯১ সালে সোফিয়া লিখলেন—”আমি মেয়েদের বিয়ে ও পুরুষের লাম্পট্য মেলাতে পারি না। বিয়ে কখনওই সুখের হয় না পুরুষ যদি অন্য নারীর সঙ্গ করে। আমার একটি স্বাধীন সত্বা আছে বলে আমাদের বিয়ে টিঁকে আছে। ওর অতীত এর দিকে তাকাতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। ওর ডায়েরিতে পুরোনো ঘটনাগুলো পড়তে চাই না। ওকে কিছু জিজ্ঞাসানও করি না। ওর বোঝা উচিত যে, একমাত্র আমার নিষ্কলুষ চরিত্রের জন্য আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়নি।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

সোফিয়া হানিমুনে কোথাও যেতে রাজি হলেন না। বিয়ের পর কিছুদিন টলস্টয় চেষ্টা করলেন নবপরিণীতাকে খুশি করার। কিন্তু যে নিজে ঠিকই করে রেখেছে খুশি হবে না তাকে কিছু করা মানে সময়ের অপচয়। বিফল মনোরথ টলস্টয় নিজেকে স্ত্রীর থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন এ বার।

এদিকে সোফিয়াও নিজের রাগ এবং ঈর্ষা প্রকাশের জন্য অন্য পুরুষদের সঙ্গে অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। বিশেষত টলস্টয়ের উপস্থিতিতে। বিয়ের কয়েকমাস বাদে টলস্টয় তার ডাইরি তে লিখলেন—”আজ সোফিয়া যেভাবে এরলেনউইন (Erlenwein) এর সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলে আনন্দ পাচ্ছিল এটা যে আমায় আঘাত করার জন্য তা স্পষ্ট। আমি জানি এটা আমার ঈর্ষা। এ সব আমায় সাধারণ মানুষের জীবনে ঠেলে ফেলার চেষ্টা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৪: জোড়াসাঁকোয় পাগল-যাচাই

বিয়ে হয়েছে ন’ মাস হল। ভেবেছিলাম এ দিনগুলো আমার জীবনের সেরা সময় হবে, কিন্তু হল সেরা দুঃসময়। এ ন মাস আমি ওর থেকে চরম অবহেলা পেয়েছি। আমি একটু খানি সুখের আশা করেছিলাম,একটু ভালোবাসা ওর থেকে। আমি বুঝতে পারছি ও অন্য মানুষকে কেন বেশি গুরুত্ব দেয়, এ শুধু আমায় চরম অবজ্ঞা করার জন্য। ওর ভালোবাসা তো পেলামই না, নিজেও নিজেকে আর ভালোবাসতে পারছি না।”
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৩: ইউ এফ ও

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

সোফিয়া কিন্তু টলস্টয়ের তার প্রতি ভালোবাসা সম্মন্ধে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। এক সন্ধ্যায় সোফিয়া নাচের আসরে স্বামীর সঙ্গে গেলেন না। তখন তাতিয়ানাকে (Tatiana) নিয়ে টলস্টয় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেন। তারা বেরিয়ে যাওয়া মাত্র কান্নায় ভেঙে পরেন সোফিয়া। ডায়েরিতে লিখলেন—”আমি সারা সন্ধে কাঁদলাম। কেন এমন জীবন কাটাচ্ছি আমরা? নিঃসঙ্গ, নিরস, একঘেয়ে…আমার তো বয়েস সুযোগ সব আছে, তবে কেন, কেন এমন হচ্ছে?”
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৬১: গিরিশচন্দ্র ‘তপোবল’ নাটকটি ভগিনী নিবেদিতাকে উৎসর্গ করেছিলেন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭২: পথে হল দেখা

বিয়ের তিন মাস বাদে আকসিন্যা (Aksinya) এক সরল মোটাসোটা কিশোরীকে তাদের বাড়ির কাজের জন্য রাখা হল। সোফিয়া জানতেন টলস্টয়ের বিবাহপূর্বে যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এ মেয়েটি তার মধ্যে একজন। তাকে দেখেই ক্ষেপে উঠলেন…টলস্টয়ের ডায়েরি পোড়াতে উদ্যত হলেন সোফিয়া।

নভেম্বর ১৮৬২ সালে সোফিয়া ডাইরিতে লিখলেন—”লেভ ও তার লোকজনকে দেখলেই আমার বিরক্ত লাগছে। আমার মনে হয় ওর এখন বেছে নেওয়া দরকার…আমাকে লাগবে না এসব লোকজনকে”। —চলবে।
ঋণ
Married to genius by Jeffrey Meyers
*ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content