বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা।

মা সারদা সদা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে নিরক্ষর গ্রামবাসীদের মধ্যে বসবাস করেও মানুষের উন্নতিসাধনে যেভাবে প্রেরণা দিয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত পাওয়া জগতে দুর্লভ। তিনি মানুষের সুখে সুখী হতেন আর দুঃখে দুঃখ অনুভব করতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কতটা নিবিড় ছিল এর থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। ব্রহ্মচারি অক্ষয়চৈতন্য মন্তব্য করেছেন যে, অনেক সুশিক্ষিত মহিলা সকলের সঙ্গে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সমান ব্যবহার করতে পারেন কিন্তু সেই সুশিক্ষার সঙ্গে যদি অধ্যাত্মশিক্ষার যোগ না থাকে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সকলের প্রতি এমন সহানুভূতিসম্পন্ন হতে পারেন না।

গরীব ও আধ্যাত্মিক পিতা-মাতার গৃহে জন্মগ্রহণ করেও তিনি অল্পবয়স থেকেই তাঁদের পরিশ্রম লাঘব করেছেন। পরিবারের অন্নসংস্থানের উপায় করতেও বিধবা জননীকে সহায়তা করেছেন। এমনকি নিজের মা ও পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে কাশী, বৃন্দাবন, পুরী প্রভৃতি তীর্থক্ষেত্রে যাত্রা করেছেন। নিজের ভক্ত পিতা ও মাতার কথা সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। নিজের ভাইদের শুধু মানুষই করেননি, তাদের পড়ার খরচও বহন করেছেন।
ছোটভাইকে কলকাতায় রেখে ডাক্তারি পড়তে সাহায্য করেছেন। তার অকালমৃত্যুর পর তার অসহায় স্ত্রী ও কন্যার ভার সারা জীবন বহন করেছেন। তাই নয়, মস্তিষ্কবিকারের কারণে ছোটভাজ তাঁকে অকারণ কুকথা বললেও তিনি তার কথায় কখনও কান দিতেন না। কখনও বা রঙ্গরস করে তার কথার উত্তর দিতেন। একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘পাগলে কি না বলে। কামারপুকুরে রাতে ঘরে শুয়ে আছি, শুনতে পাচ্চি মাতালদের একজন বলচে, ওরে আমার পা টা গেল কোথা রে? আর একজন বলচে, ওরে, লাহাবাবুদের ঘরে দুর্গাপুজো হচ্চে, তোর পাটা তার প্রধান নৈবিদ্যিতেই বোধ হয় গেছে’। এই বলে শ্রীমা খুব হাসতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

আর একদিন তাঁর ছোট ভাজকে বলছিলেন, ‘প্যানপেনে, ঘ্যানঘেনে মেয়ে তার জন্য গরব করে মরে! দেখ দিকিনি, প্রবোধবাবু সহ অন্য ভক্তদের দেখিয়ে, আমার কতশত সোনার চাঁদ ছেলে, না বিইয়ে ছেলের মা’। এই প্রসঙ্গে জানা যায়, জয়রামবাটিতে থাকা কালীন সুশীল সরকার শুনেছিলেন, শ্রীমা তরকারি কুটতে কুটতে বলছেন, ‘একজনের যদি পাঁচটি ছেলে থাকে, এক-একটি এক,এক রকমের, কেউ ভাল তো কেউ মাতাল, কেউ আরও কত কি! আমার এত যে ছেলে সবই বাছা বাছা ছেলে, একটিও খারাপ নেই’।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

কখনও বা মিষ্টিমুখে ছোট বউ সুরবালাকে নানা কথা বলে বোঝাতেন। একবার শুধু তাকে বলেছিলেন, ‘তুই আমাকে সামান্য মনে করিস নি। আমি দেবাংশী, ঈশ্বরজানিত লোক। তুই যে আমাকে এত বাপান্ত, মা-অন্ত করে গাল দিচ্চিস, আমি তোর অপরাধ নিই না। ভাবি, দুটো শব্দ বই তো নয়? আমি যদি অপরাধ নিই তাহলে কি তোর রক্ষে আছে?

যে ক’দিন বেঁচে আছি, তোরই ভাল, তোর মেয়ে তোরই হবে। যে কদিন না মানুষ হয়, সে কদিনই আমি। নতুবা, আমার কি মায়া? এখুনি কেটে দিতে পারি’। শ্রীমা তাঁর অবিবাহিত, অসুস্থ ছোট খুড়োকে আমৃত্যু নিজহাতে সেবা করেছেন, সঙ্গে করে তীর্থে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর খুড়তুতো ভাই সূর্যনারায়ণ কলকাতা থেকে যখন তাঁর সঙ্গে দেশে ফিরছিলেন, তখন বিষ্ণুপুরে পৌঁছে দেখা গেল যে, সূর্যনারায়ণ কোনও জিনিস ভুলবশত কলকাতায় ফেলে এসেছেন। জিনিসটা পরবর্তী গাড়িতে পাঠানোর জন্য তার করা হল। শ্রীমাও তার সঙ্গে বিষ্ণুপুরে রইলেন। তাকে একা ফেলে যেতে চাইলেন না, বললেন, ‘সুজ্যু কি আমার পর?’ পরিবারের সকলের প্রতি তাঁর এতটাই মমত্ববোধ ছিল।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

নিজের গ্রাম ও গ্রামবাসিদের প্রতিও তাঁর একইরকম অনুভূতি ছিল। তিনি জয়রামবাটি থেকে কলকাতায় ফিরছেন, তাঁর খুড়ি তাঁকে বললেন, ‘সারদা, আবার এসো’। মা সারদা বলেন, ‘আসব বইকি, ঘরের মেঝেয় হাত দিয়ে বারবার স্পর্শ করে সেই হাত বারবার মাথায় ঠেকিয়ে বলতে লাগলেন, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্ অপি গরীয়সী’। অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও বড়। শোনা যায়, চোদ্দ বছর বনবাস পালন করার পর আপ্লুত হয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনকালে তাঁর বানরসেনাদের নিজ জন্মভূমি প্রসঙ্গে একথা বলেছিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৭: নৃপেনবাবুকে বহিষ্কার, ইতিহাসের করুণ পরিণতি

শ্রীমার সঙ্গে দরিদ্র সংসারে পরিশ্রমী অন্যান্য মেয়ে বা ভগিনীর পার্থক্য আছে। কারণ যাদের পরিবারে শ্রম করতে হয়, তারা সেই অবস্থার অধীন হয়েই সেই শ্রম করে। কিন্তু মা সারদা জীবনে সবসময় অবস্থার অধীন হয়ে কাজ করেননি। কর্তব্যবোধ এবং হৃদয়ের প্রেরণাতেই কাজ করেছেন। আর এর জন্য তিনি কখনও আত্মাভিমান বা অনুযোগ করেননি। ঠাকুরের প্রতি নিষ্ঠার সঙ্গে শুধু গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করেননি। নিজের শ্বশ্রূ মাতাকেও মায়ের মতন সেবা করেছেন।

এমনকি, ঠাকুরের তন্ত্রসাধনার প্রথম গুরু ভৈরবী ব্রাহ্মণীকেও শাশুড়িতুল্য সেবা করেছেন। এছাড়া ঠাকুরের প্রতি গোপালভাবে ভাবিত গোপালের মাকেও তিনি শ্বশ্রূমাতা জ্ঞান করে সম্মান ও সেবা করেছেন। একদিন রাতে কামারপুকুরে ঠাকুরের সহপাঠী বৃদ্ধ গণেশ ঘোষাল শ্রীমাকে দর্শন করতে আসেন। তাঁকে দেখেই শ্রীমা গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হলে তিনি বলে উঠলেন, ‘সে কি, সে কি, আমার মা, আমার মা, এতে আমার অকল্যাণ হয়’। একথা বলে সেই বৃদ্ধ মা সারদাকে প্রণাম করা থেকে নিরস্ত করেন। এমনই মহীয়সী গৃহিণী ছিলেন মা সারদা যার কোন তুলনা হয় না।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content