শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


নিয়ন আলোয় সাজানো রাস্তা।

 

অডিও ক্লিপ, পর্ব-২

আজ নীলাঞ্জনের কোনও ভুল হয়নি। বাড়ির চাবি নিতে ভুল হয়নি। ওয়ালেটে আলাদা করে টাকা ক্রেডিট কার্ড চেকবই নিতে ভুল হয়নি। মোবাইল নিতেও কোনও ভুল হয়নি আজ। ঘনিষ্ঠ বন্ধু মৃদুল আর ঋষভকে ফোন করে দিয়েছে। মারাত্মক দুর্ঘটনাটা কার ঘটেছে সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি নীলাঞ্জনের। তাহলেও তার মাথা ঠান্ডা রয়েছে কাজে ভুল হচ্ছে না। সুচেতার এমন একটা বিপদের সময় তো আরও বেশি করে ভুলভ্রান্তি হবার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে তা হচ্ছে না কারণ সুচেতার বিপদে তাকে শক্ত থাকতে হবে। তার মানে এতদিন যে বারবার ভুলভ্রান্তিগুলো হত সেগুলো সুচেতা সঙ্গে বা পিছনে সবসময় আছে এটা ভেবেই। সুচেতা একটা সাংঘাতিক ব্যাকআপ সিস্টেম, তার ওপর নির্ভর করেই নীলাঞ্জন বেমালুম সবকিছু ভুলে থাকতে পারতো।

গাড়ি চালাতে চালাতে বারবার মনে হচ্ছিল অ্যাক্সিডেন্টটা হল কোথায়? হাওড়া যথেষ্ট জনবহুল এলাকা সেখানে হাইওয়ের মতো জোরে ড্রাইভ করার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু নিউজ টিভির গাড়ির ড্রাইভার যদি স্পট ডেড হয়ে থাকেন তার মানে সাংঘাতিক কলিশন হয়েছে। সুচেতা এখন কেমন আছে? নীলাঞ্জন নিশ্চিত সুচেতা কোনও লড়াই হারে না। হ্যাঁ, ইনজুরিটা হয়তো সাংঘাতিক, মাথায় চোট বলেছে, কিন্তু সুচেতা সামলে নেবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৩৫: সাদা রাস্তা, কালো গাড়ি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

গোলপার্ক থেকে হাওড়া অনেকটা রাস্তা। যদিও রাত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু রাস্তায় ভিড় আছে। একবার মনে হল গাড়িটা না এনে অ্যাপক্যাব নেওয়া উচিত ছিল। পরক্ষণে ভেবে দেখল এই সিদ্ধান্তটাও সঠিকই নিয়েছে নীলাঞ্জন। বেশি রাতে কোনও ভরসা নেই হাওড়া থেকে ফেরার ট্যাক্সি পাবে কি না, বা যদি সুচেতাকে উডল্যান্ড বা বেলভিউতে শিফট করানোর দরকার হয়?
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ হয়ে হাওড়া ঢোকার রাস্তাটা ঠিক সড়গড় নয়। ময়দানের বুক চিরে রেড রোড হয়ে এগোচ্ছে নীলাঞ্জনের গাড়ি। হঠাৎ মনে হল একদিন প্রায় মাঝরাতে পার্ক হোটেলে ডিনার খেয়ে নীলাঞ্জনের পুরনো গাড়ি নিয়ে ওরা রেড রোডে এসেছিল। ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল ওরা গাড়ি থেকে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল। রাস্তার দু’ধারে মায়াবী নিয়ন ভেপার ল্যাম্পের আলো যেন বৃষ্টির জলে ধুয়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু ছিল এসি চলছিল কিন্তু ওয়াইপার থামিয়ে রেখেছিল। গাড়ির সামনে পিছনে দু’ পাশের কাচে অবিরাম বৃষ্টিধারায় মোটা জলের পরত। খুব মৃদুভাবে কিশোর কুমারের বিখ্যাত গান, রিমঝিম গিরে শাওন বাজছিল। রাহুল দেব বর্মণের কম্পোজিশন। অনেক পুরনো ছবির গান। বাসু চট্টোপাধ্যায়ের মঞ্জিল। অমিতাভ বচ্চন আর মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্র-অপর্ণা অভিনীত মৃণাল সেনের আকাশ কুসুম গল্পের একটা ছাপ রয়েছে মঞ্জিল ছবিতে। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে ২৪ ঘণ্টা জড়িয়ে থাকলেও নীলাঞ্জনের কাছে সিনেমা সংক্রান্ত সবকিছুর আপডেট থাকে। এটা তার শখ।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৭: মূর্খকে উপদেশ দিলে সেটা তার রাগের কারণ হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

ড্রাইভিং সেটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে গিয়ারে বাঁ হাত রেখে চোখ বুজে গান শুনতে শুনতে সিনেমা নিয়ে সুচেতাকে এ সব কথা বলছিল নীলাঞ্জন। কথা শেষ হবার পরেই সুচেতা বলে উঠল—
—আচ্ছা গানটা কার লেখা?
বন্ধ চোখ খুলে গেল নীলাঞ্জনের- মাথার এ-কোণে ও-কোণে ধাক্কা মেরেও গীতিকারের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। যেমন আমরা অনেকেই পারি না। শিল্পী আর সুরকার বিখ্যাত হন, সিনেমার নায়ক নায়িকা, কোন মুহূর্তে এই গান সব মনে থাকে। কিন্তু বেচারি গীতিকারকে আর কে মনে রাখে? ছবির ক্ষেত্রেও তাই, ঝাঁ-চকচকে সংলাপ ঠোঁটের আগায় ছবি পরিচালক গল্প নায়ক নায়িকা পার্শ্বচরিত্র কমেডিয়ান সবকিছু খেয়াল থাকে, কিন্তু সংলাপ কে লিখেছেন সেটা? উঁহু!
—কি হল বলো?
গিয়ারে রাখা বাঁ হাতের ওপর সুচেতার নরম হাত! বাইরের বৃষ্টি আর অন্দরে এসি-র প্রকোপে সুচেতার হাত ঠান্ডা। প্রাক-বিবাহ আলাপের প্রথমদিন থেকেই আপনি ভেঙ্গে তুমি শুরু করেছিল সুচেতা।
—এসিটা বন্ধ করি?
—না!… নামটা জানো না?
—উঁহু।
—য়োগেশ। ইনিই হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের আনন্দ সিনেমার বিখ্যাত গান লিখেছিলেন, কাহিঁ দূর যব দিন ঢল যায়ে…।
সিনেমার খোঁজখবর রাখার বিষয়ে নীলাঞ্জনের একটা লুকোনো গর্ব ছিল, কিন্তু সুচেতার কাছে হেরে গিয়ে সেদিন ভীষণ তৃপ্তি হয়েছিল। তবু হাসতে হাসতে বলেছিল—
—এক্সেলেন্ট। তবে ভেবো না পরীক্ষা নিচ্ছি। অরিজিনাল গল্পটা কি মৃণাল সেনের লেখা?
—না। আশিস বর্মণ। আসলে আমি সাফল্যের পিছনে থাকা অথচ প্রচার না পাওয়া মানুষকে বেশি মনে রাখি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

এরপর সুচেতাকে তারিফ করার আগেই গাড়ির জানলার পাশে পুলিশের জিপ এসে দাঁড়িয়েছিল। কি ভাগ্যি সেদিন ওরা খালি রাস্তায় ইউ টার্ন করে উল্টো দিকে মানে ভিক্টোরিয়ার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে আলো জ্বালিয়ে কাঁচ অল্প নামাতেই ড্রাইভিং সিটের পুলিশ অফিসার সুচেতাকে একঝলক দেখেই চিনতে পেরেছিলেন।
—ম্যাডাম আপনি? এখানে এত রাতে।
সুচেতা হেসে বলেছিল—
—ইনি আমার পরিচিত। বিশেষ পরিচিত একটু আগে ডিনার করেছি। এখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি এঞ্জয় করছিলাম।
—আসলে এতটা রাত হয়ে গিয়েছে তো?
—হ্যাঁ ঠিকই! এ বার চলে যাবো।
—আপনার সাদারাস্তা কালোবাড়ি দেখি ম্যাডাম। খুব ভালো লাগে!
—থ্যাঙ্ক ইউ!
বেলুড় স্টেট জেনারেল হসপিটাল বালি ব্রিজ দিয়ে হয়তো কাছে পড়তো, কিন্তু বেশি রাতে ওখানে লরি ছেড়ে দেবে তাই হাওড়া ব্রিজ হয়ে ডান দিক নিতে হল নীলাঞ্জনকে। ঋষভ শ্যামবাজারের ছেলে, মৃদুল থাকে কলেজস্ট্রিটে। ওরা দু’জনেই অনেকটা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। নীলাঞ্জন পৌঁছতেই ওরা দু’জনে ছুটে এলো।—চলবে।
 

সুচেতা মুখোপাধ্যায় হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ৪ জুলাই, ২০২৪।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content