শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

করটক স্বভাবগতভাবেই অত্যন্ত সাবধানী। শুরু থেকেই সে বারে বারে দমনককে তার উদ্দেশ্য আর কর্মপন্থা নিয়ে সতর্ক করছে। স্বামী-পিঙ্গলক আর বৃষ-সঞ্জীবকের মধ্যে যুদ্ধের ফল যে ভয়ানক কিছু হতে পারে সে আন্দাজ করতে পারছিল। তাই আবার সে দমনকের প্রতি সমস্ত বিরক্তি উগরে দিয়ে বলল, এই উপায় চতুষ্টয়ের মধ্যে তোমার যে চিরকারল দণ্ডনীতির উপরেই ভরসা এটা আমরা জানি। কার্যসিদ্ধির জন্য দণ্ডনীতি ছাড়াও অন্য উপায় আছে। শাস্ত্রে বলে স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মা সাম থেকে শুরু করে দণ্ডনীতি পর্যন্ত যে চারটি উপায়ের কথা বলেছেন। তার মধ্যে দণ্ডনীতিটা হল—সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপায়। দণ্ডনীতি সম্পূর্ণরূপে পাপে ভরা। তাই সাম, দান আর ভেদনীতি প্রয়োগ করার পর অসফল হলে তবেই সবশেষে দণ্ডনীতি প্রয়োগ করা উচিত। যে ক্ষেত্রে শুধু “সামনীতি” প্রয়োগ করেই কার্যসিদ্ধি হয়ে যায় সেক্ষেত্রে রাজনীতি জানা লোকেরা কখনওই “দণ্ডনীতি”র প্রয়োগ করেন না। মানেটা হল, মিষ্টি খেলেই যদি কারো পিত্তদোষ শান্ত হয় তাহলে মিষ্টিই তার ওষুধ; অকারণে পটলের ঝোল খাওয়ানোর কোনও দরকার নেই তাকে। তাই প্রাচীন রাজনীতিবিদেরা মনে করেন—

আদৌ সাম প্রযোক্তব্যং পুরুষেণ বিজানতা।
সামসাধ্যানি কার্যাণি বিক্রিযাং যান্তি ন ক্বচিৎ।। (মিত্রভেদ, ৪১০)


অর্থাৎ রাজনীতিজ্ঞ পুরুষদের উচিত প্রথমে সামনীতিরই প্রয়োগ করা; কারণ সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে কোনও কার্যসিদ্ধি হলে সেটা সাধারণত উল্টোপাল্টা হয় না। পণ্ডিতেরা বলেন, শত্রুতার বশে মানুষ মানুষের প্রতি যে অপকার করে তা হল সম্পর্কের এক অন্ধকার দশা। সামনীতির প্রয়োগে সন্ধিচুক্তি করে সে অন্ধকার যতটা না দূরীভূত হতে পারে আকাশে প্রকাশমান চন্দ্রমা, সূর্য, অগ্নি কিংবা জ্যোতিষ্মতী ঔষধিও ততটা অন্ধকার দূর করতে পারে না।
করটক বলেই চলেছিল দমনককে, আর তুমি নিজে যে মন্ত্রী হতে চাইছো সেইটাও অনুচিত; কারণ যথার্থ মন্ত্রীর কাজকর্ম সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই নেই। মন্ত্রীর কাজ রাজাকে মন্ত্রণায় সহায়তা করা—রাজাকে সঠিক বুদ্ধি দিয়ে তাঁকে সঠিক দিশায় পরিচালনা করা। মন্ত্রণা পাঁচ রকমের হয়ে থাকে—
● ১. কর্মণামারভ্যোপায: যে কোন কার্য আরম্ভ করবার উপায় বা নিয়ম। যেমন, রাজার নিজের রাজ্যে দুর্গ প্রভৃতি নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে পররাজ্যে সন্ধিবিগ্রহ ও দূতাদি প্রেরণবিষয়ে আলোচনা।

● ২. পুরুষদ্রব্যসম্পৎ: পুরুষ বা কার্যকুশল লোকজন ও রত্নরাশিতে রাজাকোশ বৃদ্ধি করার উপায় চিন্তা করা.

● ৩. দেশকালবিভাগ: কার্যসম্পাদনের উপযোগী দেশ ও কালের বিভাগ বিচার বিশ্লেষণ করা। অর্থাৎ কোন সময়ে শত্রুরাজ্য আক্রমণ করলে শত্রুর বেশী ক্ষতি হতে পারে কিংবা কোন দিন দিয়ে শত্রুরাজ্যে প্রবেশ করলে বিজিগীষু রাজার জয় সম্ভব, এইসব নিয়ে চিন্তা করা।

● ৪. বিনিপাতপ্রতীকার: পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজকর্ম শুরু করলেও মাঝে যদি হঠাৎ কোনও বিঘ্ন এসে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় তার প্রতিকার বা প্রশমনের উপায় চিন্তা করা।

● ৫. কার্যসিদ্ধি: কার্যসিদ্ধি বিষয়ক বিবেচনা। অর্থাৎ সাম-দান প্রভৃতি নীতি প্রয়োগ করে কোনও কার্য সম্পন্ন হলে সেক্ষেত্রে কতটা সুবিধা-অসুবিধা বালাভ-ক্ষতির সম্ভাবনা আছে সেগুলোকে চিন্তা করা। তুমি এই বৃষ-সঞ্জীবক আর সিংহ-পিঙ্গলকে পরস্পরের মধ্যে লড়িয়ে দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করোনি। কারণ এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলাফলে কি কার্যসিদ্ধি হবে সেটা তুমি চিন্তা করোনি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

স্বামী-পিঙ্গলক বা মন্ত্রী বৃষ-সঞ্জীবকের মধ্যে কেউ একজন বা দু’জনেই পরস্পর আহত হয়ে যদি মারা যায় যায় তাহলে আমাদের কি হবে সেটা ভেবে দেখেছো? তাই যদি ক্ষমতা থাকে তো “বিনিপাতপ্রতিকার” করো। এই বিপদে এখন কি উপায় করা যায় সেইটা ভাবো। কারণ এ ভাবে দুজনের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকলে দুজনের কেউ-ই বেঁচে থাকবে না।পরস্পর বিদ্বেষীর মধ্যে সন্ধি করিয়ে সামাল দিতে পারে যে, সেই মন্ত্রীই যথার্থ মন্ত্রী। মন্ত্রীত্বের পরীক্ষাতেও তিনিই পাশ করেন। কিন্তু তুমি যে সেটা করতে পারবে না সেটা আমি জানি, কারণ তুমি মূর্খ! তুমি বিপরীতবুদ্ধি সম্পন্ন। তুমি ভেদ মেটাতে পারো না। উল্টে তুমি কেবল পরস্পরের মধ্যে ভেদ তৈরী করতেই ওস্তাদ।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: প্রাক-কথন

পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন, পরস্পর ভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে মিল করাতে পারলে অর্থাৎ তাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া মিটিয়ে তাকে ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বে পরিণত করতে পারলে তবেই মন্ত্রীত্বের পরীক্ষায় সে পাশ করে। যেমন বায়ু-পিত্ত-কফ মিলিত হয়ে যে সান্নিপাতিক জ্বর হয় সেই জ্বরের সময়েই বৈদ্যরাজের যথার্থ পরীক্ষা হয়। কারণ সাধারণ পরিস্থিতিতে সকলেই নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে ওস্তাদ। বিপদের সময়েই লোকের আসল বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। আর বাস্তব সত্যিটা কি জানো ভাই? যারা ক্ষুদ্র স্বভাবের হয় তারা সবকিছু কেবল নষ্টই করতে জানে, বিনষ্ট জিনিষকে ঠিক করতে বা তাকে পুনরায় বানাতে জানে না। যেমন ইঁদুর কেবল রান্নাঘরের তাকের উপর থেকে কৌটো ফেলতেই পারে, সেটাকে আবার তুলে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে না।
সত্যি বলতে এটা তোমারও দোষও নয়; এটা আমাদের স্বামী-পিঙ্গলকেরই দোষ যে তোমার এই সব কুপরামর্শ এতোটা মন দিয়ে শুনেছেন। লোকে ঠিকই বলে—

নরাধিপা নীচজনানুবর্তিনো
বুধোপদিষ্টেন পথা ন যান্তি যে।
বিশন্তি দুর্গমমার্গনির্গমং
সমস্তসম্বাধমনর্থপিঞ্জরম্‌।। (ঐ, ৪১৪)


অর্থাৎ যে রাজা দুষ্ট লোকের পরামর্শে চলে সে কখনওই পণ্ডিত কিংবা যথার্থ রাজনীতিবিদদের কথা শোনেন না। এমনকি তাঁদের কথা মতন কাজও করেন না। তাই তারা একদিন সকল বাধা-বিপত্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে এমন এক কঠোর সঙ্কটরূপ খাঁচায় আটকে পড়ে যে তার থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা তাদের আর সম্ভব হয় না। তাই ওহে দমনক! তোমার মতন লোক যদি আমাদের স্বামী-পিঙ্গলকের মন্ত্রী হয় তাহলে আর কোনও সজ্জনলোকে আরতার ধারে কাছেও আসবেন না।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

শাস্ত্রকাররা বলেছেন, সর্বগুণসম্পন্ন রাজা যদি অনেক দান-ধ্যানও করেন তাহলেও তিনি যদি দুষ্ট মন্ত্রীদের কথায় চলেন তাহলে সে রাজাকে ত্যাগ করাই উচিত। যেমন কোনও জলাশয় পরিষ্কার সুমিষ্ট জলে পরিপূর্ণ হলেও সেখানে যদি কুমীর থাকে সেই জলাশয় যেমন পরিত্যাগ করা উচিত। এক্ষেত্রেও তাই। আর ভালো মানুষরা রাজার সঙ্গে না থাকলে একদিন না একদিন সেই রাজাও বিনষ্ট হয়ে যায়। কারণ যারা বেশ ভালো ভালো বড় বড় কথা বলে কিন্তু কাজের সময়ে ধনুক পর্যন্ত চালাতে জানে না সেইসমস্ত আধিকারিকদের সঙ্গে রাজা যদি আনন্দ-ফুর্তি করেন তাহলে রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে তার শত্রুরাও আনন্দ করবার সুযোগ পেয়ে যায়। শত্রুপক্ষীয় বিজিগীষু রাজা সবটাই দখল করে নেবে তখন সহজে। তাই তোমার মতন মূর্খকে আর কি উপদেশ দেবো? কারণ মূর্খদের উপদেশ দিলে শুধু দোষই হয় কোনও গুণের দেখা মেলে না। সেই বলে না!

নানাম্য নমতে দারু নাশ্মনি স্যাৎক্ষুরক্রিযা।
সূচীমুখং বিজানীহি নাশিষ্যাযোপদিশ্যতে।। (ঐ, ৪১৭)


অর্থাৎ শুকনো কাঠের লাঠিকে যেমন বেঁকানো যায় না, পাথর দিয়ে যেমন ধারালো ছুরির কাজ হতে পারে না তেমনই উপদেশ দেওয়ার অযোগ্য শিষ্যকেও উপদেশ দেওয়া যায় না; কারণ এগুলি অনমনীয়— কথায় এদের কোনও কাজ হয় না। সূচীমুখ এর যথার্থ উদাহরণ।
দমনক জিজ্ঞেস করলো, “কথমেতৎ” ব্যাপারটা ঠিক কেমন?
দমনক তখন বলতে শুরু করল—
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি

 

১৭: সূচীমুখ আর বানরদলের গল্প

কোনও এক নাম না জানা পর্বতের এক জায়গায় একদল বানর বাস করতো। একবার হেমন্ত ঋতুতে শীতের হিমেল হাওয়া তখন সবে উত্তর দিক থেকে বইতে শুরু করেছে কিন্তু বর্ষার বৃষ্টির প্রকোপ তখনও মেটেনি। সেদিন মুষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল আর গোটা বানরের দলটা বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে উত্তরের হালকা হিমেল হাওয়ায় ঠক্‌-ঠক্‌ করে কাঁপতে শুরু করল। ঠান্ডায় শান্তি পাচ্ছিল না তারা কিছুতেই। মানুষকে ঠাণ্ডায় আগুন পোহাতে তারা দেখেছে কিন্তু আগুন কি করে জ্বালাতে হয় সে বিদ্যে তাদের নেই। কয়েকটা বানর আবার জঙ্গল থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ভেবে আগুনের মতন লাল গুঞ্জাফল তুলে এনে একজায়গায় জড়ো করে তার চারিধারে বসে মানুষের মতন ফুঁ দিয়ে দিয়ে অনেক আগুন জ্বালানোর বৃথা চেষ্টা করছিল। সেখানে সূচীমুখ নামে এক পাখি গাছের উপর নিজের বাসায় বসে বসে এই সব বানরদের কার্যকলাপ দেখছিল।—চলবে।

* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content