হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ বাতে ভুগে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। পরীক্ষা না দিলেও মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়েছেন। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তারিও করেছেন। ডাক্তারি জানতেন, ব্যায়াম করা চেহারা, তবু অকালে তাঁর মৃত্যু হয়। হাওড়ার সাঁতরাগাছির নীপময়ীর সঙ্গে হেমেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছিল। এগারোটি সন্তান-সন্ততি। আট কন্যা ও তিন পুত্র। কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীর সঙ্গে বিয়ে হয় অসমের লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার। ঠাকুরবাড়িতে ভিনদেশি বিবাহ, প্রাদেশিক বিবাহ অনেকগুলিই হয়েছে। প্রজ্ঞাসুন্দরীকে দিয়ে প্রাদেশিক বিবাহের সূচনা। পরে স্বর্ণকুমারীর কন্যা সরলা বিয়ে করেছিলেন পাঞ্জাব-তনয় রামভজ দত্তচৌধুরীকে।
লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে প্রজ্ঞার কোনও যোগাযোগ ছিল না। রীতিমতো দেখেশুনে বিয়ে। লক্ষ্মীনাথ প্রজ্ঞার ছবি দেখে কতখানি আবিষ্ট হয়েছিলেন, তা তাঁর ‘আমার জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যায়। সুখী দাম্পত্যের কত টুকরো ছবি ছড়ানো আছে লক্ষ্মীনাথের এই আত্মকথায়। সরসতায় ভরপুর নানা কৌতুকময় চিত্র রয়েছে এই বইটিতে। বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন আরতি ঠাকুর।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা
লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে কলকাতার নিবিড় সম্পর্ক, গভীর ভালোবাসা সেই ছাত্রাবস্থা থেকে। তাঁর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা এই কলকাতাতেই। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ছেন। কষ্ট করে এই শহরে থাকতেন। জোড়াসাঁকোর সঙ্গে সংযোগসাধনে ঘটকমশায়ের বড় ভূমিকা ছিল। বিবাহে মধ্যস্থতা করেছিলেন ঘটকমশায় বৈকুন্ঠনাথ দত্ত ঠিকই, লক্ষ্মীনাথের কয়েকজন বন্ধুরও ভূমিকা ছিল। তাঁর বইতে আছে, ‘ঠাকুরবাড়িতে আমার বিবাহ এক প্রকার ঠিক হয়ে গেল। সেই ব্যাপারে আমার প্রিয়তম বন্ধু ‘মাজিউ’ এবং হেম গোস্বামী বিচার-বিবেচনা করে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন। আর একজন সাহায্য করেছেন, তাঁর নাম যজ্ঞেশ্বর নেওগ।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
লক্ষ্মীনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত। সেই পরিবারের জামাই হবেন, কবির সান্নিধ্য পাবেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পৌত্রীর সঙ্গে বিবাহের সম্ভাবনা তখন সত্যি হওয়ার মুখে। কত রঙিন ভাবনা, স্বপ্নের আনাগোনা। লক্ষ্মীনাথের আর বিস্ময়ের শেষ থাকে না। খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়িতে ঘরজামাই রাখার যে প্রচলন ছিল, তা তো সকলেরই জানা। লক্ষ্মীনাথকে আবার থাকতে হবে না তো! এমন ভেবে নিয়ে আত্মীয় ও বন্ধুজনের মধ্যে এই বিবাহকে ঘিরে আলোড়ন পড়েছিল।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা
শেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, শুভদৃষ্টি। শুভদৃষ্টির সময় প্রজ্ঞাসুন্দরী নাকি লক্ষ্মীনাথের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসেছিলেন। যেন কতকালের চেনা। পরে অবাক বিস্ময়ে হাসির কারণ জানতে চেয়েছিলেন লক্ষ্মীনাথ। প্রজ্ঞা জানিয়েছিলেন, ‘বিয়ের অনেকদিন আগেই তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম।’ এ যেন স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র! সেই রাজপুত্রকে বরণ করার জন্য কত না ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর বির্জিতলার বাড়িতে অভিনয় হয়েছিল ‘মায়ার খেলা’। ‘মায়ার খেলা’য় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও এই নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। লক্ষ্মীনাথের লেখায় আছে, ‘মেয়েদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদুষী গ্রাজুয়েট কন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী, ভারতীর সম্পাদিকা মহর্ষিকন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর গ্রাজুয়েট কন্যা শ্রীমতী সরলা ঘোষাল এবং ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য মেয়েরাও ছিল।’ হ্যাঁ, প্রজ্ঞাসুন্দরীও অভিনয় করেছিলেন। লক্ষ্মীনাথের লেখা থেকেই জানা যায়, স্ত্রী অভিনয় করবেন কিনা, সে ব্যাপারে স্বামী লক্ষ্মীনাথের ‘অনুমতি নেওয়া হয়েছিল’।
লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া।
প্রজ্ঞা ভালো রান্না করতেন। রন্ধনপটিয়সী। রান্নার বইও লিখেছিলেন। পিতা হেমেন্দ্রনাথও ভেবেছিলেন রান্নার বই লিখবেন। পিতার সে আশা পূরণ না হলেও কন্যা রান্না নিয়ে একাধিক বই লিখেছিলেন। লক্ষ্মীনাথের রসনা পরিতৃপ্তির আয়োজনে প্রজ্ঞা ছিলেন ক্লান্তিহীন। প্রজ্ঞা ‘পুণ্য’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথও লিখেছেন। তথ্যনিষ্ঠ প্রবন্ধ লিখেছিলেন অসমের ভাষা নিয়ে।
লক্ষ্মীনাথের পিতৃদেব দীননাথ ব্রিটিশের চাকরি করতেন। প্রথমে নওগাঁ, পরে বরপেটা। বরপেটায় তেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। জলপথে যেতে হত। নৌকোয় সস্ত্রীক দীননাথ চলেছিলেন চাকরির স্থলে। পথে লক্ষ্মীনাথের জন্ম। সেদিন ছিল লক্ষ্মীপূর্ণিমা।
লক্ষ্মীনাথের পিতৃদেব দীননাথ ব্রিটিশের চাকরি করতেন। প্রথমে নওগাঁ, পরে বরপেটা। বরপেটায় তেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। জলপথে যেতে হত। নৌকোয় সস্ত্রীক দীননাথ চলেছিলেন চাকরির স্থলে। পথে লক্ষ্মীনাথের জন্ম। সেদিন ছিল লক্ষ্মীপূর্ণিমা।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লক্ষ্মীনাথ ছিলেন চিন্তায়-চেতনায় প্রগতিশীল। শোনা যায়, ঠাকুরপরিবারের তরফে দশ হাজার টাকা যৌতুক দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। লক্ষ্মীনাথ ছিলেন নির্লোভী, একরোখা মানুষ। সে যৌতুক নিতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে আছে, ‘ঠাকুরবাড়িতে যখন বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেল, তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বস্ত কর্মচারী একজন আমার বাসায় এসে জিজ্ঞাসা করে বিয়েতে আমার দিক থেকে কিছু দাবি আছে কিনা অর্থাৎ আমি কত টাকা চাই।’ লক্ষ্মীনাথ স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আসামে অসমীয়া লোকদের মধ্যে টাকা নিয়ে মেয়ে বিয়ে করার প্রথা নেই।’
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী।
দীর্ঘ চার বছর পরে ঠাকুরবাড়িতে বিয়ে। এর আগের বিবাহ-অনুষ্ঠান হয়েছিল প্রজ্ঞার অগ্রজার, প্রতিভাসুন্দরীর সঙ্গে আশুতোষ চৌধুরীর। আশুতোষ ছিলেন রবীন্দ্র-বান্ধব। অনেকদিন পর বিবাহ-অনুষ্ঠান, ফলে খুবই আনন্দোল্লাস হয়েছিল। সাড়ম্বরে বিবাহ-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর দু’জনে গিয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কাছে। মহর্ষিদেব তখন পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। তিনিই নব দম্পতিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর কথা মতোই হেমেন্দ্রনাথের কন্যা ও জামাতা উপস্থিত হয়েছিলেন ওই বাড়িতে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ লক্ষ্মীনাথকে আশীর্বাদ করে দিয়েছিলেন সোনার কলম। দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই কলম থেকে সুনিপুণ লেখা বেরুবে।’ পৌত্রীকে আশীর্বাদ করে দিয়েছিলেন একগুচ্ছ গোলাপ। ফুলের তোড়া হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার যশ-সৌরভ এই ফুলের সৌরভের মতোই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে।’ শুধু ফুলের তোড়া নয়, দিয়েছিলেন একজোড়া ব্রেশলেট। ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবহিতে আছে ব্রেশলেট কিনতে খরচ হয়েছিল একশো পঁয়ত্রিশ টাকা। সোনার কলমের জন্য পঞ্চাশ টাকা।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৫: জঙ্গি তৎপরতায় স্তব্ধ উন্নয়ন
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নব দম্পতিকে দিয়েছিলেন অন্যরকম উপহার। দিয়েছিলেন নিজের হাতে আঁকা তাঁদের দুটি স্কেচ। আত্মীয়-স্বজনের আগমন, জোড়াসাঁকো থেকে বির্জিতলা পর্যন্ত যে আনন্দোল্লাস, তা সহসাই থেমে গিয়েছিল। বিবাহ-অনুষ্ঠানের দিন আটেক পর আকস্মিক মৃত্যু হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির এক বধূমাতার। দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী সুশীলার।
লক্ষ্মীনাথের আত্মজীবনী : বাংলা অনুবাদের প্রচ্ছদ।
সেই শোক-আবহ অবশ্য দ্রুত ফিকে হয়ে যায়। এক মাস পাঁচ দিন পর দ্বিপেন্দ্রনাথ আবার বিয়ে করেন। লক্ষ্মীনাথের বড় ভালো লাগে ঠাকুরবাড়ির আনন্দ-সমারোহ। নিয়ম করে চলে নাট্যাভিনয়, গান-বাজনা। সাহিত্য-রচনা, সাহিত্যালোচনা—এসব তো ছিলই। এই আনন্দ-যজ্ঞে লক্ষ্মীনাথও নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় বেশ ক’বার অভিনয় করেছেন। একবার অভিনয় হয়েছিল কলকাতার রয়েল থিয়েটারে। ওড়িশার সম্বলপুরেও অভিনয় করেছেন। লক্ষ্মীনাথ সাজতেন দস্যুসর্দার। কন্যা অরুণাও অভিনয় করতেন। অরুণা ছিলেন লক্ষ্মীনাথের দ্বিতীয় সন্তান। লক্ষ্মীনাথ ও প্রজ্ঞাসুন্দরীর চারটি কন্যাসন্তান। ‘সোনার প্রতিমা’র মতো দেখতে সুরভি অকালে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মারা গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই, তবু প্রজ্ঞাসুন্দরীকে লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘সুরভি ছিল তোমার নাম,/ তাই বুঝি ফুলের মতন/ সৌরভ করিয়া বিতরণ/ দুদিনে ত্যাজিলে মর্ত্যধাম।/ সে সৌরভ চির দিনরাত/ রহিল মোদের এই ঘরে,/ তুমি থাকো দেবতার তরে/ অমর অমল পারিজাত।’
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।