বিধু বিনোদ চোপড়া, আরডি বর্মণ ও ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’ ছবির একটি দৃশ্য।
এ ভাবেই কাটছিল এক একটি দিন। শুধুই হতাশা। আর্থিক দিক থেকেও তিনি অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিলেন এতদিনে। এক কথায় বলতে গেলে প্রায় কপটদক শূন্য। সেইভাবে বৈষয়িক ছিলেন না কোনওদিনই। সঞ্চয়ও বলার মতো তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে। ভাবা যায়? এক সময়ের বলিউড মিউজিকের বেতাজ বাদশাহ! ভবিতব্য বোধহয় একেই বলে। ঘুরে দাঁড়াবার ক্ষীণ আশাটুকুও দৃশ্যমান হচ্ছিল না। একা থাকতেই যেন বেশি পছন্দ করতেন। তাছাড়া সঙ্গ অথবা স্বান্তনা দেওয়ার ছিলই বা কজন? তাদের যে ততদিনে স্বার্থ ফুরিয়েছে! তাই পঞ্চম তখন তাদের খরচের খাতায়। শুধু ফেলে আসা দিনের বহু সুখের স্মৃতি রোমন্থন করেই বয়ে চলেছিল দিনগুলি।
এমন এক সময়, হঠাৎ একদিন বিধু বিনোদ চোপড়া দেখা করতে এলেন পঞ্চমের সঙ্গে। পরিচারক পঞ্চমের অনুমতি নিয়ে তাঁকে নিয়ে গেলেন মিউজিক রুমে। পঞ্চম এর দু’চোখে তখন কিছুটা বিস্ময়, আর বাকিটা জিজ্ঞাসা। কেন এসেছেন বিধু? এটি কি নিছকই সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ? নাকি তিনি অন্য কোনও বার্তা নিয়ে এসেছেন? কিছু বুঝে ওঠার আগেই পঞ্চমকে জড়িয়ে ধরেন বিধু। পঞ্চমের বিস্ময় এ বার আরও কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে।
এমন এক সময়, হঠাৎ একদিন বিধু বিনোদ চোপড়া দেখা করতে এলেন পঞ্চমের সঙ্গে। পরিচারক পঞ্চমের অনুমতি নিয়ে তাঁকে নিয়ে গেলেন মিউজিক রুমে। পঞ্চম এর দু’চোখে তখন কিছুটা বিস্ময়, আর বাকিটা জিজ্ঞাসা। কেন এসেছেন বিধু? এটি কি নিছকই সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ? নাকি তিনি অন্য কোনও বার্তা নিয়ে এসেছেন? কিছু বুঝে ওঠার আগেই পঞ্চমকে জড়িয়ে ধরেন বিধু। পঞ্চমের বিস্ময় এ বার আরও কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে।
করার কথা ভাবছেন তিনি। ছবির নাম ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’। অর্থাৎ, সময়কাল ভারতের স্বাধীনতার পূর্বের একটি সময়। এই ছবির গানগুলিতে সুরারোপ করার দায়িত্ব পঞ্চমকেই দিতে চান তিনি। গীতিকার হিসেবে তিনি জাভেদ আখতার সাহেবকে বেছে নিয়েছেন। মোদ্দা কথা হল, জাভেদ আখতারের লেখা গানগুলিকে সুরে সাজাবেন পঞ্চম। এইটুকুই বিধুর অনুরোধ। তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও নিজেকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সংযত রাখেন পঞ্চম। বিধুকে তাঁর সটান প্রশ্ন, তিনি কেন? তিনি তো শেষ হয়ে গিয়েছেন! সংগীতের আধুনিক সাম্রাজ্যে তাঁর স্থান কোথায়? তিনি তো এখন অচল মুদ্রার মতো ব্রাত্য। তবু বিধুর তরফ থেকে তাঁকে এই মহাপ্রস্তাব দেওয়ার হেতু কী?
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৭: দিল লেনা খেল হ্যায় দিলদার কা…
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার
পরিচালক বিধু বেশ বুঝতে পারেন পঞ্চমের এই চরম অভিমানের কারণ। তিনি উঠে এসে পঞ্চমের হাত দুটি ধরে যে কথাগুলি তাঁকে বলেন, সেগুলি শুনে অশ্রু যেন বাধা মানে না সুরের জাদুকরের। বস্তুত, পঞ্চম তাঁর মিউজিক রুমে ঠিক যেখানে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন, তার ঠিক পিছনের দেয়ালে ছিল শচীনকর্তার একটি লাইফ সাইজ ছবি। সেই ছবির দিকে তিনি পঞ্চমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আজ যদি শচীনদেব বর্মন জীবিত থাকতেন, তিনি তাঁকেই এই প্রস্তাব দিতেন। তাঁর অবর্তমানে সারা ভারতের মধ্যে পঞ্চমই একমাত্র মানুষ, যাঁর উপর তিনি চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারেন। এই কাজের জন্য পঞ্চম ব্যতীত আর কাউকে তিনি বেছে নিতে অপারগ। সে যাই হয়ে যাক, শিশুর মতো কেঁদে ফেলেন পঞ্চম। এ কি শুনছেন তিনি! এমন সিংহ হৃদয়ের অধিকারী মানুষটি কোথায় ছিলেন এতদিন? ভেবে কুল পান না ‘অপাংক্তেয়’ সুরকার। বিধু বিনোদ চোপড়া পঞ্চমকে আশ্বাস দেন, তিনিই এই ছবিতে কাজ করবেন। তাঁর স্থান অটুট। তিনি আর কারও কথা ভাবছেনই না। সুতরাং যত শীঘ্র সম্ভব তিনি যেন সুর রচনার কাজ আরম্ভ করে দেন। এতক্ষণে হাসি ফোটে পঞ্চমের মুখে। রাজি হয়ে যান সদ্য পাওয়া দুর্লভ এই প্রস্তাবে।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা
এ বার গীতিকার, অর্থাৎ জাভেদ আখতারের সঙ্গে বসার পালা। বসলেনও দু’জনে একদিন। গানের বিষয়বস্তু, প্রেক্ষাপট সব কিছু নিয়ে সুগভীর আলোচনা চলল। জাভেদ ফিরে যাওয়ার পর ‘কুছ না কহো কুছ ভি না কহো’ গানটি নিয়ে গবেষণায় বসলেন আরডি। কিছুদিনের মধ্যে কাঠামোটি তৈরি করে বিধু বিনোদকে অনুরোধ করলেন একদিন এসে গানটি শুনে নিজের মতামত জানাতে। কথামতো এলেন বিধু। শুনলেন গানটি। কিন্তু তিনি মোটেই খুশি হতে পারলেন না। কারণ সুর এবং ছন্দ দুটিই চূড়ান্ত আধুনিক। ছবিটি যে সময়ের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হচ্ছে সেটির সঙ্গে এই ছন্দ সার্বিকভাবে বেমানান। তবু খুব নম্রভাবে তিনি এই মতামত ব্যক্ত করেন পঞ্চমকে। পঞ্চমের পাল্টা যুক্তি, আজকাল তো এই রকমই চলছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এমন ছন্দ ব্যবহার না করলে বক্স অফিসে ছবিটি মুখ থুবড়ে পড়বে না তো? নির্দেশক উত্তরে বলেন, সেই দায়িত্ব তাঁর নিজের। পঞ্চম যেন সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় না রাখেন মনে। তিনি যেন সব কিছু ভুলে শুধু ছবির সময়কালের কথা মাথায় রেখে সুরগুলি রচনা করেন। তিনি এও বলেন, তিনি যত খুশি সময় নিন। নির্দেশকের তরফ থেকে কোনও তাড়া নেই।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা
আশ্বস্ত হয়ে এ বার নতুন উদ্দীপনায় শুরু করেন পঞ্চম। তাঁর মনে পড়ে যায় তাঁর বাবার গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘রঙ্গিলা রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে রঙ্গিলা’। এই গানের সুরের ধাঁচে তৈরি করে ফেলেন ‘কুছ না কহো’ গানটির প্রেলুড। আর বাকি গানটি সুরারোপ করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। গানটি যখন তৈরি, তখন পঞ্চম আরও একবার গানটি শোনার অনুরোধ করেন বিধু বিনোদ চোপড়াকে। ছুটে আসেন তিনি। পঞ্চম শুধু দুটি পংক্তি গাওয়ার পরই প্রবল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকেন বিধু। পঞ্চম তো হতবাক! আরে পুরো গানটি তো শুনুন! পঞ্চমের অনুরোধ। কিন্তু বিধু খানিকটা ভবিষ্যৎবাণী করার মতো করেই বলেন, এই গান বাজিমাত করবেই। কথাটি সত্য বলে প্রমাণিত হয় পরবর্তীতে। মেলোডির কথা না হয় বাদই দিলাম। হাতেগোনা কিছু বাদ্যযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে জন্ম দেওয়া এই গানে রয়েছে এমন কোন জাদুর ছোঁয়া যা আপনাকে মোহিত করে তুলবেই। কুমার শানুর কণ্ঠ এই গানে অনেকটাই অন্যরকম। টেক্সচার যথেষ্ট আলাদা। ইনস্ট্রুমেন্টের সেইরকম কোনও আড়ম্বর নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু ভায়োলিন আর বাঁশিকে আশ্রয় করে গড়ে তোলা হয়েছে গানটিকে। রেকর্ডিংয়ের পর জাভেদ আখতার এবং বিধু বিনোদ চোপড়া দু’জনেই যে যারপরনাই উৎফুল্ল হয়েছিলেন, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কুর্নিশ আরডি বর্মনকে। কুর্নিশ গীতিকারকে। এবং অবশ্যই কুর্নিশ কুমার শানুকে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪১: দুধ না খেলে?
প্রসঙ্গত, উপরোক্ত ঘটনাটি স্বয়ং বিধু বিনোদ চোপড়া পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত ভাবে ব্যক্ত করেছিলেন। এই স্মৃতিগুলি তাঁর মনে আজও উজ্জ্বল হয়ে থেকে গিয়েছে। একই ভাবে থেকে গিয়েছে, পঞ্চমের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। আজও কোনও অনুষ্ঠানে অথবা কোনও সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় পঞ্চমের প্রসঙ্গ চলেই আসে তাঁর। স্মৃতিগুলি যে ভোলার নয়।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।