অলঙ্করণ: লেখক।
সম্মিলিত ঋষিগণ বললেন, হে মহাত্মন্, কলিকালে একদিনের ব্যবধানে দুটি বিশ্বদিবস অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ব সাইকেল দিবস আর, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সাইকেল চড়লে প্রকৃতি ভালো থাকবে, এতো বলাই বাহুল্য। তবে কলির জীবগণ যেরূপ ধীমান হবেন বলে জানা যায়, তাতে কৌতূহল জাগে, শঙ্কাও হয়। আপনি আমাদের এই দ্বন্দ্ব দূরীভূত করুন।
বৈশম্পায়ন বললেন, কলির মহাত্মাগণ একটি কিংবদন্তিকে সত্যে পরিণত করবেন। তাঁরা যে ডালে উপবিষ্ট হন, তাকেই সগর্বে ছেদন করেন। তাঁরা বৃক্ষকে দেবজ্ঞানে পূজা করেন, আবার তাকেই উত্পাটিত করেন। তাঁরাই অরণ্য সৃজন, বৃক্ষরোপণ করে ভাবী বিশ্বের সুস্থিতির পক্ষে তত্পর, আবার তাঁরাই তাকে ধ্বস্ত করেন। সুতরাং, এই দিনে বৃক্ষের জন্য কুম্ভীরাশ্রুপাত ও ছদ্ম প্রেম বিতরণ কলির মনুষ্যজাতির দ্বারা অনুষ্ঠিত এক আশ্চর্য দৃশ্যকাব্য বলা যেতে পারে। অবশ্য অতীতের এক মহর্ষি বলেছিলেন বটে, সুখ ও দুঃখ সচল চক্রের তুল্য পরিবর্তমান। সেই কথা ভাবলে আমাকে বরং সাইকেল নামক আশ্চর্য যন্ত্রটি ভাবায়। কথায় আছে, কোনও এক শশীবাবু সকালবেলা সাইকেল চড়ে সেই শ্যামবাজার থেকে সালকিয়াতে শ্বশুরবাড়ি যেতেন।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৯: রাঙা হাসি রাশি রাশি
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল
সে যাই হোক, দুই চাকার সাইকেল যাঁরা অবলম্বন করবেন সেই দেবগণের লীলা কলিকালে অচিন্তনীয় হবে। আদিকালে যেমন ময়ূরবাহন কিংবা সিংহবাহিনী, অথবা হংসারূঢ়া, মূষিকবাহন দেবগণের প্রসিদ্ধি, তেমনই কলিকালে দ্বিচক্রযান অবলম্বন করে মহাত্মাগণ ধরাতলে সচল থাকবেন। এটি চালনা করা ব্যায়ামবিশেষ। দীর্ঘ পথ স্বল্প আয়াসে অতিক্রম করা যায় বলেই কলিতে বালক বালিকা থেকে, নেতা অভিনেতা থেকে, রাজা গজা থেকে, বিশ্রুত পণ্ডিত আর ম্যাট্রিক-প্রসিদ্ধ গঙ্গারাম থেকে, ম্যাটিনি আইডল আর মিউটিনির সেনানী থেকে, চোর পুলিশ ডাকাত বাবু থেকে, সার্কাসের জোকার থেকে…. সকলেরই সাইকেল চড়তে হয় দরকারে অ-দরকারেও।
আরও পড়ুন:
মুভি রিভিউ: মহাভারতের প্রেক্ষাপটে তৈরি টানটান ক্রাইম সিরিজ মৎস্যকাণ্ড
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে
সাইকেলের আরোহীর দল যেমন বিপন্মুক্ত নন, স্টান্টপ্রবণ থেকে গোবেচারা সকলেই সাইকেলে ভর করে বেসামাল হলেই পতনোন্মুখ হন, তেমনই ধ্রুপদী থেকে কেতাদুরস্ত অথবা, সাইকেল স্ট্যান্ডে পরপর গায়ে গায়ে লেগে থাকা সার সার সাইকেল কিংবা পথের পাশের একাকী সাইকেল, কেউই বিপন্মুক্ত নয়। একে তারা সামান্য ধাক্কাতেই তাসের ঘরের মতো হেলে পড়ে, তার ওপর তঞ্চকতার ভয়।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
সন্তান কম মনোযোগী কিন্তু অতি সক্রিয়? সহজ উপায়ে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব
“বাইসাইকেল থিফ” কলির একটি বিশ্রুত চলচ্চিত্র হবে একথা সত্য, তবে চৌর্যকর্মের প্রাথমিক পাঠের বকযন্ত্র হল এই সাইকেল। চোখের নিমেষে হাওয়া খুলে বিপন্ন করা অথবা গোটা সাইকেলটাকেই হাওয়া করে দেওয়ার গণশিল্পের স্বপ্নের কারিগর এই সাইকেল। সেদিক থেকে দেখলে কলির মহামানবগণের সাহচর্যে থাকা এই সাইকেল আর প্রকৃতি, দুটিই কলিকুলজগণের গবেষণা ও বীরত্ব প্রদর্শনের বাহুল্যে খরচের খাতা অবলম্বন করবে। যে সাইকেল একদা বরের যৌতুক, তা-ই কালান্তরে নিতান্ত হেয় হবে, তবে তার মহিমা কমবে না। আরোহী দেবগণ ও অপহারক অসুরগণ স্ব স্ব কর্মে নিরত থাকবেন, আরোহণ ও আহরণ এই দুটি কর্মেই। বরং, পঙ্গু প্রকৃতিদেবীকে যদি কলিকালের ইউজ অ্যান্ড থ্রো ও রিসাইকেলের পৃথিবীর মহামানবগণ কৃপাপরবশ হয়ে উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে একটি সাইকেল দেন, তো তিনি এই কল্পের মতো আত্মরক্ষা করতে পারেন। অলমিতি।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।