শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কুসুমকুমারী দেবী।

কুসুমকুমারী দেবী! তাঁর কবিতা আদর্শের মন্ত্র উচ্চারণ। ‘মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন’— এমন মানুষের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়ছিলেন এই মহীয়সী। ছোটদের জন্য তাঁর কবিতা জীবন গঠনের প্রথম সোপান। বঙ্কিম যুগের সাহিত্য যে নীতিবচন মুখ্য বক্তব্যের প্রাধান্য ছিল, কুসুমকুমারীর কবিতা সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে থাকে। কুসুমকুমারী লেখাপড়া জানা কবি। নিয়মিত অধ্যয়নের মধ্যে থাকতেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা— আদর্শ ছেলে। ১৮৮৫ সালে মুকুল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা সকলেই জীবনের কোনও না কোনও সময় সেই আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। চিন্তায় পড়ে গিয়ে ভেবেছি, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’
কুসুমকুমারী দেবী ছোটবেলা থেকেই প্রবন্ধ ও কবিতা লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের স্নেহধন্যা ছিলেন। কুসুমকুমারীর লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অন্তরালে প্রবাসীর এই সম্পাদকের ভূমিকা রয়েছে। ব্রাহ্মসভায় তাঁর লেখা প্রবন্ধ পাঠ করা হত। ‘নারীর আদর্শ’ নামের প্রবন্ধ লেখার জন্য তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। লেখা তাঁর কাছে অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে ধরা দিত। একান্নবর্তী পরিবারে বিরাট দায়িত্বভার সামলে অনায়াসে চলত তাঁর কবিতাযাপন। ছন্দ আর শব্দ যেন ছিল তাঁর দুই সখী। তাঁর শিক্ষক স্বামী সত্যানন্দ দাশ লেখালিখির ক্ষেত্রে তাঁকে উৎসাহ দিতেন। বাড়িতে ছিল লেখাপড়ার আবহাওয়া। তাঁদের সন্তান ছিলেন বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

জীবনানন্দের স্মৃতিচারণে মায়ের কবিতা লেখার কথা আছে—‘কি রকম তাড়াতাড়ি লিখতে পারতেন তিনি। রান্না করছেন, রান্না করছেন, পিসেমশাই আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুণি ‘ব্রহ্মবাদীর ফর্মা প্রেসে যাচ্ছে, অবিলম্বেই একটা কবিতা লিখে দাও কুসুম। …অমনি মা খাতাকলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একহাতে খুন্তি আর একহাতে কলম নাড়ছেন। দেখা যেত— যেন চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছে না কোথাও। আচার্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখুনি কবিতা দিয়ে দিতেন।’ কুসুমকুমার লেখা দিনলিপি প্রকাশিত হয়েছে ‘দৈনন্দিন লিপি’ নামে। সম্পাদনা করেছিলেন ভূমেন্দ্র গুহ। স্মৃতি সুধা নামে একটি আত্মজীবনী লেখার কাজও শুরু করেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনানন্দের মা হিসেবে কুসুমকুমারীর পরিচিতি। কিন্তু আমরা বলছি তাঁর একটি একটি আলাদা সপ্রতিভ অস্তিত্বের কথা। কুসুমকুমারীর মতো মা পেয়েছিলেন বলেই জীবনানন্দ সাহিত্যের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। বরিশালের গৈলার মেয়ে ছিলেন কুসুমকুমারী। তাঁর বাবা চন্দ্রনাথ দাশ ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য। তিনি নিজেও কবি ছিলেন। কুসুমকুমারী বেথুন স্কুলে ফার্স্ট ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের রবিবাসরীয় নীতি বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল মুকুল পত্রিকা। এখানে নিয়মিত লিখতেন কুসুমকুমারী। প্রবাসীতেও তাঁর লেখা বেরিয়েছিল। ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় কুসুমকুমারী দেবীর প্রায় শখানেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কবিতা মুকুল’ তাঁর লেখা কবিতার বই। ‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’ নামের বইটিতে তিনি লিখেছিলেন সংস্কৃত পুরাণের গল্প।
জীবনানন্দ, অশোকানন্দ — দুই ছেলের স্মৃতিচারণেই কুসুমকুমারী এক আলোর দীপশিখার মতো। সারাদিন গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থেকেও কীভাবে যশস্বী কবি হয়ে উঠলেন তাঁদের মা, সন্তানদের কাছে এ ছিল এক বিস্ময়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৫: রাজনীতি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বারে বারে টেনে আনে ধর্মকে, আর এতেই প্রাণ যায় ধর্মভীরু সাধারণদের

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

আসলে উনিশ শতকের শুধু নয়! সময় গড়িয়ে গেলেও মহিলা লেখকদের লেখার পৃথিবী এখনও বড় একপেশে। কতজন তাঁদের কদর করেন? জীবনানন্দের আপশোস —‘মা খুব বেশি সুযোগ পেতেন না, তিনি খুব বড় সংসারের মধ্যে এসে পড়েছিলেন যেখানে শিক্ষা আর শিক্ষিতদের আবহ ছিল বটে কিন্তু দিন রাতের অবিশ্রান্ত কাজের ফাঁকে সময় করে লেখা — তখনকার দিনের অস্বচ্ছল সংসারের একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না আর। কবিতা লেখার চেয়ে কাজ ও সেবার ভিতরে ডুবে গিয়ে তিনি ভালোই করেছেন হয়তো। তাঁর কাজকর্মের আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখে সেই কথা মনে হলেও ভিতরের খবর বুঝতে পারিনি, কিন্তু তিনি আরো লিখলে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারতেন বলে মনে হয়।’
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৫: রাজা যযাতির উপাখ্যান—পৌরবদের বর্ণ বিপর্যয় না উত্তরণের কাহিনি?

তবে সেই আমলে কুসুমকুমারী যথেষ্ট কাজ করেছেন। বরিশাল মহিলা ব্রাহ্ম সভার সম্পাদনা করেছেন। ১৩১৯ থেকে ১৩৩৮ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই বরিশাল ছাত্র সংঘের সপ্তাহকালব্যাপী মাঘোৎসবের মহিলা দিবসের উপাসনায় আচার্যের কাজও করেছিলেন কুসুমকুমারী। সাহিত্য সমালোচক হিসেবে কুসুমকুমারীকে গুরুত্ব দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। সেই আমলে দেশি বিদেশি সাহিত্যের তুলনা করে ছেলের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতেন কুসুমকুমারী। ১৯৪৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।—চলবে।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content