পশুর (Xylocarpus moluccensis)
● পশুর হল অধিমূলবিশিষ্ট বিশালাকার বৃক্ষ। উচ্চতা হয় প্রায় ৬০-৬৫ ফুট। এরা পর্ণমোচী এবং উপরের দিকে প্রচুর শাখাপ্রশাখা হয়। গাছের বাকল বেশ পুরু ও বাদামি রঙের হয়। বাকল অমসৃণ এবং সরু সরু ফাটলযুক্ত। বাকলের ভিতরের দিকের রং লাল হলেও কাঠের রং হলদেটে-বাদামি। এদের প্রচুর শাঙ্কবাকার শ্বাসমূল হয়। আবার মাঝে মাঝে ছোট তক্তার আকারের শ্বাসমূলও দেখা যায়। এদের পাতা যৌগিক প্রকৃতির। পত্রকগুলির আকার ডিম্বাকার এবং পত্রকের উপরের দিকের রং গাঢ় সবুজ ও নিচের দিকের রং হালকা সবুজ। পত্রকের শিরা ও কিনারার রং হলুদ। ১০-৩৫ টি ছোট ছোট গোলাপি রঙের ফুল নিয়ে তৈরি হয় পুষ্পমঞ্জরী। এদের স্ত্রী এবং পুরুষ ফুল আলাদা হয় অর্থাৎ একলিঙ্গ ফুল। পশুরের প্রমাণ সাইজের বেলের মতো বড় আকারের ফল হয়। ফলের রং সবুজ ও গা মসৃণ। ফলের ভিতর ৮-১২টি প্রায় ত্রিকোণাকার বীজ থাকে।
পশুর গাছের তীব্র লবণ-সহন ক্ষমতা রয়েছে। তবে এরা মধ্যম লবণাক্ত এলাকাতেও জন্মায়। জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী সীমানায় নদী ও খাঁড়ির তীর বরাবর বা কর্দমাক্ত সমতল এলাকাতেও জন্মায়। এরা সাধারণত গর্জন, গরান, গেঁওয়া, কাঁকড়া ইত্যাদি গাছের সঙ্গে সহাবস্থান করে। সুন্দরবনের যে সব অঞ্চল নিয়মিত জোয়ারের জলে প্লাবিত হয় সেখানে পশুর গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। পশুরের কাঠ খুব দৃঢ় হওয়ায় গৃহস্থালির আসবাব, খুঁটি, কাঠামো, কড়িকাঠ ইত্যাদি তৈরি করতে এই গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। জ্বালানী হিসেবেও এই গাছের শাখা ব্যবহৃত হয়।
লৌকিক চিকিৎসা
● গোদ রোগ বা স্তনের ফোলায় ফলের ক্বাথ প্রলেপ দেওয়া হয়। আমাশয় রোগে বাকলের ক্বাথ ব্যবহৃত হয়।
ধুধুল (Xylocarpus granatum)
● ধুধুল গাছ পশুর গাছের এক জাতভাই! তাই উভয়ের বেশ মিল আছে। ধুধুল গাছ পশুর গাছের মতোই বড় আকারের বৃক্ষ। তবে এই গাছ চিরহরিৎ এবং এর নিচের দিকে শাখা কম থাকলেও আগার দিকে প্রচুর শাখা বেরিয়ে ছাতার আকার ধারণ করে। এর বাকল মসৃণ হলেও পশুরের মতো সরু সরু ফাটলযুক্ত। বাকলের রং পশুরের তুলনায় সামান্য বিবর্ণ। বাকলের বাকি সব বৈশিষ্ট্য একইরকম। ধুধুলের কাঠের ভিতরের দিকের রং পশুরের মতো লালচে হলেও কম দৃঢ় এবং কিছুদিন পর কাঠে চিড় ফাটল ধরে যায়। বয়স্ক গাছের গোড়ার দিকে অধিমূল দেখা যায়। এই অধিমূল থেকে আবার মাটির উপরে ফিতের মতো বায়বীয় মূল তৈরি হতেও দেখা যায়। এদের যৌগিক পাতায় সাধারণত দু’জোড়া পত্রক থাকে। পত্রক ডিম্বাকার। পাতার বৃন্তের রং লাল বা বাদামি। ক্রিম রঙের ছোট ছোট কয়েকটি ফুল নিয়ে তৈরি হয় পুষ্পমঞ্জরী। মঞ্জরীতে স্ত্রী এবং পুরুষ উভয় ফুল থাকে। ফলের আকার হয় খুব বড়। দেখে মনে হবে বিশালাকার বেল। এক একটা ফলের ব্যাস ১৫-২৫ সেমি পর্যন্ত হয়। ফলের রং মরিচা-বাদামি এবং গা হয় সামান্য খসখসে বা মসৃণ। পরিণত ফলের গায়ে সামান্য ফাটলও দেখা যায়। ফলের মধ্যে ৮-১০টি শক্ত ও প্রায় ত্রিকোণাকার বীজ থাকে।
এদের তীব্র লবণ-সহন ক্ষমতা থাকলেও মাঝারি লবণাক্ত জায়গাতেও ভালোই জন্মায়। জোয়ারের জলের সর্বোচ্চ সীমায় এদের কম দেখা যায়। নদী ও খাঁড়ির দু’দিকে বা কর্দমাক্ত সমতল ভূমিতে গর্জন, গরান, গেঁওয়া, কাঁকড়া গাছেদের সাথে ধুধুল জন্মায়। গৃহস্থালির আসবাব, নৌকো, পেনসিল ইত্যাদি তৈরি করতে ধুধুলের কাঠ ব্যবহৃত হয়। ভালো জ্বালানী হিসেবেও ধুধুলের ডালপালা সুন্দরবনবাসীর কাছে গ্রহণীয়। ধুধুল বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল দিয়ে অতীতে সুন্দরবনের মানুষ আলো জ্বালাত। অনেকে সেই তেল মাথাতেও মাখত।
লৌকিক চিকিৎসা
● আন্ত্রিক হলে অনেক সুন্দরবনবাসী আজও ধুধুল বাকলের ক্বাথ ওষুধ হিসেবে সেবন করে। পাতা, ফল ও বাকলের রস ম্যালেরিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়। কলেরা ও আন্ত্রিক রোগে মূলের রসও ব্যবহৃত হয়।
হাবল, হাবলি, পরশ পিপুল (Thespesia populnea)
● হাবল গাছের সঙ্গে আমার পরিচিতি আশৈশব কারণ আমাদের গ্রামের বাড়ির পুকুরপাড়ে দুটো বড় বড় হাবল গাছ ছিল। প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝেই ওই গাছের ডাল কেটে নিয়ে যেত লাগানোর জন্য। বিশেষ করে নতুন পুকুর খোঁড়া হলে তার পাড়ে নতুন মাটিতে হাবল গাছ লাগানো হত। তিন-চার ফুট লম্বা পাতা ও শাখাহীন খুঁটির মতো মোটা একটা শাখা মাটিতে পুঁতে দিয়ে মাটির উপরে থাকা শাখাটির কাটা অংশে কাদা মাটি লেপে দিয়ে খড় জড়িয়ে দেওয়া হত। গ্রামেগঞ্জে হাবল গাছের এ ভাবেই বংশবৃদ্ধি করা হত। এখনও হয়।
হাবল কিন্তু পূর্ণ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ নয়। এ হল ম্যানগ্রোভ-সহযোগী উদ্ভিদ। এর মাঝারি থেকে উচ্চ লবণ-সহন ক্ষমতা রয়েছে বলে সুন্দরবন অঞ্চলসহ ভারতের পূর্ব, পশ্চিম ও আন্দামান উপকূলীয় অঞ্চলে হাবল গাছ দেখা যায়। অবশ্য অরণ্যের মধ্যে হাবল গাছকে সুন্দরবনে ভোলা, নোনা ঝাউ, মন্দার, পিটালি, ইত্যাদি গাছের সঙ্গে পাশাপাশি দেখা যায়। সুন্দরবনে অরণ্য বা জনবসতি অঞ্চলে নদী, খাল বা খাঁড়ির তীরে এমনকি পুকুর পাড়ে হাবল অনায়াসে জন্মায়।
পূর্ণ বয়স্ক হাবল বা পরশ পিপুল গাছ উচ্চতায় ৪০-৫০ ফুট হয়। তবে এরা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে বড়সড় ঝোপ তৈরি করে। এরা চিরহরিৎ বৃক্ষ। বেশ লম্বা বৃন্তওয়ালা হাবল পাতার আকার বেশ চওড়া এবং হৃৎপিণ্ডের মতো। তাই আমরা ছোটবেলায় হাবল গাছের পাতাকে পান পাতা বানিয়ে খেলতাম। হাবলের বাকলের রং বাদামি। অবশ্য বাকলের ভিতর দিকের রং হলুদ। পরিণত বাকলের উপরে ফাটল দেখা যায়। তবে হাবল গাছের আসল সৌন্দর্য তার ফুলে। বেশ বড় আকারের, উজ্জ্বল হলুদ রঙের ফুল হয়। শাখা থেকে এক একটা ফুল লম্বা বৃন্তের সাহায্যে ঘণ্টার মতো ঝুলে থাকে। অনেকটা টিউলিপ ফুলের মতো আকার বলে ইংরেজিতে হাবল গাছকে ‘ইন্ডিয়ান টিউলিপ ট্রি’ বলা হয়। অনেক দূর থেকে হাবল গাছের পুষ্পশোভা দেখা যায়। ফোটার পর থেকে ঝরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ফুল যত পুরোনো হয় ততই তার রং গোলাপি হয়ে যেতে থাকে। ফলগুলো গোলাকার কিন্তু উপর-নিচে সামান্য চাপা। ফল পেকে গেলে পাঁচ খণ্ডে ফেটে যায়। ফলের ভিতর অনেক ডিম্বাকার বীজ থাকে।
সুন্দরবন অঞ্চলে দৃঢ় কিন্তু সস্তা কাঠ হিসেবে হাবলের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। কোনও হাবল গাছের গুঁড়ি যদি সোজা ও মোটা হয় তার দাম হয় অনেক বেশি। স্কুলের বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, বাড়ির আসবাব, তক্তাপোশ, এমনকি অনেক সময় দরজা ও জানালার চৌকাঠ ও পাল্লা হাবল কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়।
লৌকিক চিকিৎসা
● সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ হাবল গাছের পাতা বেটে সেই লেই শরীরের কোনও ফোলা স্থানের ওপরে লাগায় ফোলা কমানোর জন্য। রক্তপাত বন্ধ করতেও পাতা বেটে লাগানো হয়। দাদ, হাজা, চুলকানি ইত্যাদি ত্বকের রোগে বাকলের ক্বাথ বা কাঁচা ফলের রস আক্রান্ত স্থানে লাগালে নিরাময় হয়। স্মৃতিবর্ধক টনিক হিসেবে মূলের রস খাওয়ার প্রচলনও আছে। কোথাও কোথাও পেট পরিষ্কার করতে পাতার রস খাওয়া হয়।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।