শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


বাঁদিক থেকে হেতাল ফল। হেতাল গাছ। বীজসহ গরিয়া গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

 

গরিয়া (Kandelia candel)

গরিয়া হল চিরহরিৎ গুল্ম বা ছোট বৃক্ষজাতীয় গাছ। খুব বেশি হলে ১৮-২০ ফুট লম্বা হয়। গাছের বাকলের রং গাঢ় বাদামি হলেও বাকলের ভিতরের দিকের রং হালকা গোলাপি। বাকল মসৃণ। গুঁড়ির গোড়া থেকে অনেক বায়বীয় মূল ঘনভাবে জন্মায়। সেইসব বায়বীয় মূল পরষ্পরের সাথে এমনভাবে জুড়ে যায় যে অধিমূলের মতো দেখায়। এদের শ্বাসমূলের আকার মোটা ও নলাকার। পাতা উপবৃত্তাকার এবং উপরের দিক গাঢ় সবুজ ও চকচকে। পাতার কিনারা ভিতরের দিকে একটু ভাঁজ। এই গাছে লম্বা পাপড়িযুক্ত সাদা ফুল ফোটে। ফুলে থাকে অসংখ্য লম্বা পুংকেশর। সাধারণত চারটে ফুল মিলে একটি পুষ্পমঞ্জরী গঠন করে। মঞ্জরীদণ্ড হয় বেশ লম্বা। গরিয়ার ফলের রং সবুজ ও ডিম্বাকার। এদের বীজের জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম হয়। অঙ্কুর ১৫-১৫ সেমি লম্বা এবং সবুজ ও নলাকার।

গরিয়া মাঝারি থেকে তীব্র লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাই যেসব জায়গা নিয়মিত জোয়ারের জলে ডুবে যায় সেখানে যেমন জন্মায় আবার অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাতেও জন্মাতে পারে। এদের সাধারণত গরান, গেঁওয়া, বকুল কাঁকড়া, গর্জন, হরগোজা ইত্যাদি গাছের সঙ্গে জন্মাতে দেখা যায়। তবে সুন্দরবনের সর্বত্র গরিয়া গাছের দেখা মেলে না। সুন্দরবনবাসীর কাছে জ্বালানি ও খুঁটি হিসেবে গরিয়া গাছ ব্যবহৃত হয়। পাতা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এর বাকলে বেশি মাত্রায় ট্যানিন থাকার জন্য রং হিসেবেও বাকল ব্যবহৃত হয়।

 

লৌকিক চিকিৎসা

বাকলের ক্বাথ ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে দেখা যায়। পাতা সিদ্ধ করে তার নির্যাস ডায়াবিটিস রোগের কারণে অধিক মূত্রত্যাগ নিয়ন্ত্রণে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

মুভি রিভিউ: সত্যঘটনা অবলম্বনে ভায়োলেন্ট ওয়েব সিরিজ ‘ভাউকাল’ ভালো লাগবে

 

গোলপাতা (Nypa fruticans)

নারকেল গাছের চারা যখন সবেমাত্র মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে গোলপাতা গাছ অনেকটা সেই সময়ের নারকেল গাছের মতো দেখতে। এরা একবীজপত্রী উদ্ভিদ। এর কাণ্ড থাকে মাটির নীচে। আর মাটির ঠিক উপর থেকে নারকেল পাতার মতো প্রায় ৬ মিটার লম্বা অনেক যৌগিক পাতা বেরিয়ে আসে। এদের পাতা শুকিয়ে গেলে পত্রকগুলো গোল হয়ে গুটিয়ে যায় বলেই সম্ভবত এদের স্থানীয় নাম গোলপাতা। এদের মাটির নিচে থাকা কাণ্ড মাটির ঠিক নিচ দিয়ে অনুভূমিকভাবে বৃদ্ধি পায়। সেই কান্ড থেকে মুকুল এবং তা থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। এইভাবে অনেক গাছ একজায়গায় জন্মায় বলে ঘন ঝোপ তৈরি হয়। পুষ্পমঞ্জরী খেজুরের পুষ্পমঞ্জরীর মতো দেখতে। স্ত্রী ও পুরুষ ফুল আলাদা হলেও একই গাছে জন্মায়। উভয় ফুলের রং হলুদ বা কমলা। পুষ্পমঞ্জরীর ডাঁটা ৩-৬ ফুট লম্বা হয়। স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরীর নিচের দিক থেকে পুরুষ পুষ্পমঞ্জরী জন্মায়। প্রায় ৫ সেমি লম্বা বাদামি রঙের গোলাকার বা ডিম্বাকার ফলগুলো একসঙ্গে থেকে গোলাকার গুচ্ছ গঠন করে। এদের বীজের অঙ্কুরোদ্গম সুপ্ত জরায়ুজ প্রকৃতির অর্থাৎ ফলের মধ্যে বীজের অঙ্কুরোদ্গম হলেও সেই অঙ্কুর বাইরে বেরিয়ে আসে না যতক্ষণ না ফল গাছ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

ভোটস্য পরিবেদনা

গোলপাতা গাছের লবন সহন ক্ষমতা উচ্চ প্রকৃতির। এদের বৃদ্ধির জন্য বেশি আলোকিত স্থান দরকার। তাই এদের সচরাচর বড় গাছের নিচে জন্মাতে দেখা যায় না। বরং নদী, খাঁড়ি বা খালের তীরে কিছুটা এলাকা জুড়ে গোলপাতা গাছের জঙ্গল দেখা যায়। তবে এদের সাথে হরগোজা ও বিভিন্ন ঘাস জন্মাতে দেখা যায়। কখনও কখনও জাত বাইন ও কালো বাইনের সাথেও জন্মাতে দেখা গিয়েছে। পশ্চিম সুন্দরবন অংশে গোলপাতা গাছ বেশি দেখা যায় না। সম্ভবত বালুকাময় কাদা ও উপকুলীয় অঞ্চলই এর কারণ। প্রাচীনকাল থেকে মাটির ঘরের ছাউনি হিসেবে গোলপাতার বহুল প্রচলন আছে। এই উদ্দেশ্যে বার বার গাছের পাতা কেটে নেওয়া হলে এই গাছের বৃদ্ধি বাধা পায়। নদীর তীরে ভূমিক্ষয় রোধে এই গাছ খুব কার্যকর। এর ফল অনেকের কাছে উত্তম খাদ্য। পুষ্পমঞ্জরী থেকে অনেকে মদ তৈরি করে। এদের পত্রক শুকিয়ে গেলে পাকিয়ে যাওয়ায় তার মধ্যে তামাক ভরে সিগারেট তৈরি করা যায়। কচি বীজ রান্না করে খাওয়া যায়। নারকেল পাতার মতো গোলপাতার কাঠি থেকে ঝাঁটা তৈরি করা যায়। সুন্দরবনের বাঘের লুকিয়ে থাকার জন্য অন্যতম প্রিয় জায়গা হল গোলপাতা গাছের ঝোপ।

 

লৌকিক চিকিৎসা

চোখের অসুখে ফলের মধ্যে থাকা জল ব্যবহৃত হয়। কচি পাতার ছাই অন্ত্রে ঘা সারাতে, দাঁতের ও মাথার যন্ত্রণায় ব্যবহার হয়। পোড়া নারাঙ্গা (হার্পিস) রোগে কচি কান্ডের রস ব্যবহার হয়। বিছার কামড়ে কাণ্ডের রস ব্যবহৃত হয়। স্বাস্থ্যবর্ধক টনিক হিসেবেও গোলপাতা ফলের রস খাওয়ার প্রচলন আছে।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

 

হেতাল (Phoenix paludosa)

“ক্রোধ ভরে সদাগর ফিরে আসে নিজ ঘর।
বিবাদ করি মনসার সনে॥
হেতাল লইয়া ফিরে দেখা যদি পায় তারে
পাঠাইবে যমের সদনে।।”

মনসামঙ্গল কাব্যে হেতাল গাছের এক মাহাত্ম্য রয়েছে। চাঁদসদাগরের সাথে দেবী মনসার যখন বিবাদ চরমে তখন মনসাকে শায়েস্তা করার জন্য চাঁদ সদাগর সবসময় হাতে রাখতেন হেতালের লাঠি। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও ছোটবেলায় দেখেছি বিষধর সাপ মারার জন্য একটা লম্বা হেতাল লাঠি দরজার পাশে রাখা থাকত। আসলে হেতাল লাঠি যেমন শক্তপোক্ত তেমনই খুব টেকসই। তাছাড়া হেতাল লাঠির সর্বত্র ব্যাস প্রায় সমান হওয়ায় সাপের উপর এক ঘা পড়লে তার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত।

সুন্দরবনের মানুষের কাছে হেতাল গাছের আর এক নাম হল ঝাঁপি। হেতাল হল খেজুর গাছের মতো দেখতে একবীজপত্রী উদ্ভিদ। যেখানে জন্মায় ঘন ঝোপ তৈরি করে। এরা আলোকোজ্জ্বল এলাকায় ভালো জন্মায়। এককভাবে বা হরগোজা গাছের সাথে থেকে এরা নদী বা খাঁড়ির দু’পারে বিস্তৃত জঙ্গল তৈরি করে। এদের তীব্র লবন-সহন ক্ষমতা রয়েছে। ভাটার সময় জল যতদূর নামে সেখান পর্যন্ত কর্দমাক্ত জমিতে এরা বেশি জন্মায়। জোয়ারের সর্বোচ্চ সীমায় এদের দেখা মেলে খুব কম। হেতাল গাছ সোজা হয়ে বেড়ে ওঠে, কোনও শাখা হয় না। লম্বায় এরা সর্বোচ্চ ১৫/১৬ ফুট হয়। অবিকল খেজুর গাছের পাতার মতো দেখতে যৌগিক পাতা হয় এবং পাতার গোড়ার দিকে কিছু পত্রকের আগা সূচালো হয়ে কাঁটা তৈরি করে। গোড়ার দিকের পাতা পুরোনো হয়ে গেলে ক্রমশ হলুদ হয়ে যায় এবং শেষে কান্ড থেকে খসে যায়। হেতাল গাছের জঙ্গল হল বাঘেদের আদর্শ আস্তানা।

বাঁদিক থেকে গোলপাতা গাছে পুরুষ ও স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরী। গোলপাতা ফল। গরিয়া ফুল। গোলপাতা গাছ। ছবি: সংগৃহীত।

হেতালের স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আলাদা হয়, যেমন খেজুর গাছেরও হয়। পুরুষ ও স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরী দেখতেও খেজুরের পুষ্পমঞ্জরীর মতো। ফল দেখতে খেজুরের মতো এবং রসালো। প্রতি ফলে একটি কাষ্ঠল বীজ থাকে। হেতাল কাণ্ড অত্যন্ত দৃঢ়, ঋজু ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সুন্দরবন অঞ্চলে মাটির বাড়ির কাঠামো, খুঁটি, মাচা বা বেড়া তৈরি করতে হেতাল কাণ্ড বহুল ব্যবহৃত হয়। এর ফল অনেকে খায়। কচি পাতা থেকে ঝাড়ু তৈরি করা হয়। সুন্দরবন অঞ্চলে গৃহস্থের বাড়িতে এই ঝাড়ু বহুল ব্যবহৃত হয়্। হেতালের পাতা ও কাণ্ড জ্বালানী হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
 

লৌকিক চিকিৎসা

কচি পাতার রস কৃমিনাশক ও ডায়েরিয়ার ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের কোনও কোনও এলাকার মানুষ যন্ত্রণা কমাতে কাঁচা ফলের শাঁস থেকে তৈরি করা ক্বাথ ব্যবহার করে।—চলবে।

* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content