অলঙ্করণ: লেখক।
বিশ্ব অট্টহাস্য দিবসের বয়স যে খুব বেশি এমন নয়, তরতাজা যৌবন তার অঙ্গে, বলা যেতে পারে। গত শতাব্দীর শেষের দিকে মুম্বইতে এর সূত্রপাত, যোগচর্চার হাত ধরে। লাফিং ক্লাবের হাহাহা হোহোহো শুনেছেন? প্রতি মে মাসের প্রথম রবিবার এই হাসির দিন, ওয়ার্ল্ড লাফটার ডে। হাসিতে ভেঙে পড়তে হবে, হিজিবিজবিজের মতো হাত পা ছুড়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসবেন কী না সে আপনার ব্যাপার, কিন্তু হাসিটা জরুরি।
নবরসের মধ্যে হাস্যরস অন্যতম। স্বভাবগত কারণেই মানুষ হাসতে পারে। মুচকি হাসি, মিচকে হাসি, সরু হাসি, বোকা হাসি, পাকা হাসি, বাঁকা হাসি, ট্যারা হাসি ইত্যাদি ইত্যাদি। খিলখিলে, খলখলে, হাহা হাসি হোহো হাসি এমনকী করুণ হাসি কী দারুণ হাসিতেও মানুষ উদাস ও উদ্বেল হয়। তবু ‘সিরিয়াস’ বলে একটি পৃথক ধারা আছে, হাসির গল্প, হাসির গান, হাসির কথা বুঝিয়ে দেয় জীবনে হাসিটা নেসেসিটি নয়, চয়েস, অপ্রয়োজনীয় অথবা বৈকল্পিক। অথচ, জীবন যেন অন্য কথা বলতে চায়।
আরও পড়ুন:
পর্ব-৫৮: মিনার্ভার জন্য গিরিশচন্দ্র লিখেছিলেন সামাজিক নাটক ‘শাস্তি কি শান্তি’
জিৎ সত্রাগ্নি’র গল্পে এবার জিৎ-রুক্মিণীর ছবি ‘বুমেরাং’
হাসির চেহারায় যেমন আবিল ও অনাবিল ভাব আছে, তেমনই হাসির উত্সতেও শুদ্ধ, অশুদ্ধ, মিশ্র, মোটা, সরু, লঘু, গুরু নানা ব্যাপার থাকে। রুচিবোধ শেখায়, কোনটায় হাসতে হয় আর কোনটায় নয়। এমন গল্প শোনা যায় যে, মৃত ব্যক্তির শোকে যখন সকলে কাতর, কেউ একজন হেসেছিল। সে নাকি বুঝেছিল যে, দুঃখের কারণ নেই, গতায়ু সেই মানুষের একটি আনন্দময় নবজীবনের আভাস সে পেয়েছিল। কিন্তু সে যাই হোক, হাসতে পারা সহজ নয়, হাসি কান্নার হীরা পান্না অদৃষ্টে ভাস্বর জ্যোতিতে জ্বলতে থাকে। বিশেষতঃ চোখে জল নিয়ে ঠোঁটের কোণের ঐশ্বরিক অভিব্যক্তিকে ধরে রাখা সহজ কি?
অট্টহাসি শরীরকে নিশ্চয়ই সুস্থ রাখে, হৃদ্-ক্রিয়া আর তার সহযোগিদের নানা প্রতিক্রিয়া অনুকূল হয় ভালো রকম নিশ্চয়ই, নইলে লাফিং ক্লাবে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে কেন সকলের এত পরিশ্রম? কষ্ট করে হাসির ব্যায়াম সত্যিই জীবনে হাসি আনে তো? নাকি গোমড়াথেরিয়াম আর রামগরুড়ের দলের হাসির ফিল গুড মুখোশ টেনে থাকে?
অট্টহাসি শরীরকে নিশ্চয়ই সুস্থ রাখে, হৃদ্-ক্রিয়া আর তার সহযোগিদের নানা প্রতিক্রিয়া অনুকূল হয় ভালো রকম নিশ্চয়ই, নইলে লাফিং ক্লাবে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে কেন সকলের এত পরিশ্রম? কষ্ট করে হাসির ব্যায়াম সত্যিই জীবনে হাসি আনে তো? নাকি গোমড়াথেরিয়াম আর রামগরুড়ের দলের হাসির ফিল গুড মুখোশ টেনে থাকে?
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
ভোটস্য পরিবেদনা
হায়েনার হাসির কথা শোনা যায়, পশু পাখির গল্পে হাতি-হাঁস-বাঁদররা হাসে। তবে মানুষের জগতে না-মানুষদের হাসির হিসেব কেউ রাখে না, সব মানুষের হাসিও হিসেবের মধ্যে থাকে না। সমাজে সকলের মুখে হাসিফোটার তত্ত্ব আজও কি সূর্যোদয়ের মুখ দেখেছে? দেবতা থেকে মানুষ সকলেই হাসেন। বিশেষ কেউ হাসলে তা আনন্দ দেয়, আবার দুঃখেও হাসি ফোটে দেখা যায়। হাসি সুন্দর হলেও, সব হাসি সুন্দর নয়। হিরো হাসে, ভিলেন-ও হাসে। সাহেবরা হাসিকে হিউমার, স্যাটায়ার, উইট ইত্যাদি নানা পর্যায়ে ফেলেন। অর্থবহ হাসিতে বক্রোক্তি, ব্যঙ্গোক্তির, বিদ্রুপের আভাস থাকতে পারে, থাকতে পারে শুদ্ধ নির্মলতা। অট্টহাসিটা বরাবরের জন্য অসুর, রাবণ, কুম্ভকর্ণ কিংবা ভীমসেনের বরাদ্দ। রাক্ষস খোক্কশ অথবা বেজায় বদমাশ কিংবা নিখাদ ধূর্ত শয়তানি বুদ্ধির কারখানা ভিলেনের ঘর কাঁপানো হাসির ফোয়ারা, দারোগার হাসি, চোরের হাসি, রাজার হাসি, প্রজার হাসি, শেয়ালের হাসি, বিদূষকের হাসি, সন্তানের হাসি, মায়ের হাসি, তৃপ্তির হাসি, না পাওয়ার হাসি, “হাসছি মোরা হাসছি দেখো”র আহ্লাদীর হাসি; সব তো এক নয়, এক হতে পারে না বলেই পৃথিবী সুন্দর।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা
সুন্দরের বোধে প্রফুল্লতার ভাবে যে হাসি জাগে তা আর সার্কাসে জোকারের হাসিয়ে হাসিল করার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান থাকে। কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর, হাসিমুখে “দেখা হলেই মিষ্ট অতি”র অথবা “হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে পরিহাসের” যে হিসেব-নিকেশ তার বাইরেও একটা হাসির, বিস্ময়বোধের দুনিয়া আছে। সামাজিক পরিণতমনস্ক মানুষের হাসি অসঙ্গতি থেকে আসে। আবার, পাগলেও হাসে। হৃদয় আর যুক্তি বলবে হাসো, মস্তিষ্ক হয়তো বাধা দিয়ে বসবে। যথার্থ সামাজিক-রাজনৈতিক আচরণ করতে গেলে, হাসিটা চাপতেও হয় বটে। মানুষের জগতে অবদমনের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন একথাও সত্য, তবু দুষ্টু হাসি, মিষ্টি হাসি, জয়ের হাসি, শয়তানি হাসি হেসে, না হেসেও, লোক হাসিয়ে, হাস্যাস্পদ হয়েও ‘বেশি হাসি ভালো নয়’ বলে যারা হাসিকে কুক্ষিগত রাখতে চায় তাদের, অথবা হাসি দেখলেই যাদের কম্প দিয়ে জ্বর আসে তাদেরও পাগলা দাশু কিংবা মোনালিসার মতোই অভিভূত করে অদৃষ্টের বা জীবনের মুচকি হাসিটা পড়তে পারার সহজপাঠ আর প্রথম ভাগটা পড়ে উঠতে না পারলে…।—চলবে।
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।