সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


নবগ্রহ মন্দির।

গুয়াহাটি শুধু অসমেরই নয়, গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের কত কাহিনি। ইতিহাস অতীতের যেমন গল্প শোনায়, তেমনি সময়ের কাছ থেকে ভবিষ্যতের কীভাবে শিক্ষা নিতে হয় সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তবে এ কথাও মেনে নিতে হয় যে, পুরাণের প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে বর্তমানের গুয়াহাটির আধুনিক চেহার লাভের মধ্যে রয়ে গিয়েছে বিশাল সময়ের ব্যবধান। কত রাজা, কত গোষ্ঠীর রাজত্বকালই না এলো এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে।

প্রগযোতিষপুরের রাজা নরকাসুরের পুত্র ছিলেন রাজা ভাগদত্তা। ভাগদত্তা তাঁর কন্যার সয়ম্বর আয়োজন করতে গিয়ে একটি বিশাল জলাশয় খনন করান। বর্তমানে এই জলাসয়টি দীঘলে পুকুরি নামে পরিচিত। বলা হয়, মহাভারতের কর্ণ সেই সয়ম্বরে দুর্যোধনের হয়ে অংশগ্রহণ করে জয় লাভ করেন। পরে রাজকুমারী ভানুমতির সঙ্গে দুর্যোধনের বিবাহ হয়। সেই দীঘলি পুকুরি আজও শহরের বুকে রয়েছে।
এক সময় গুয়াহাটিতে কোচ রাজারাও রাজত্ব কিরেছিল। কোচ রাজা চিলারায়ের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে কামাখ্যা মন্দির। পুরাণের প্রাগজ্যোতিষপুরকে ঠিক কবে থেকে গুয়াহাটি বলা শুরু হল তার কোনও লিখিত তথ্য আমরা পাইনি। ১৩ শো শতকে পারস্যের ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর বইয়ে গুয়াহাটি নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। শহরের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদ সব সময়ই জড়িয়ে রয়েছে। এক সময় এই ব্রহ্মপুত্র নদের জল পথ দিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে সমগ্র উত্তরপূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ হত। ব্রহ্মপুত্রের আরেক নাম লোহিত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে এক ধরনের বিশেষ চন্দন কাঠের। এই চন্দন কাঠ লোহিতের পাড়েই পাওয়া যেত। সুতরাং ব্রহ্মপুত্রের গুরুত্ব যে যথেষ্ট তা মেনে নিতেই হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-২১: গুয়াহাটি শহরের গল্পগাথা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

গুয়াহাটি শহরে অবস্থিত অনেক পুরনো পুকুর সেই ইতিহাসের গল্প বলে। বেশির ভাগ পুকুরই আহোম রাজত্ব কালের নিদর্শন। এই সব পুকুরের জল এখনও যথেষ্ট স্বচ্ছ। প্রায় প্রতিটি পুকুরই কোনও না কোনও মন্দির সংলগ্ন। জনশ্রুতি, এই সব পুকুরের জল আজ পর্যন্ত কোনও দিনই সম্পূর্ণ ভাবে শুকিয়ে যায়নি। শিল পুকুরী নবগ্রহ মন্দিরের পুকুর। এই পুকুরকে বলা হত ‘নো কনিয়া পুকুরি’ অর্থাৎ নয়টি দিক। নবগ্রহ মন্দিরটি সৌর মণ্ডলীর নয়টি গ্রহকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে। শিলপুকুরির জল দিয়ে এই নবগ্রহ মন্দিরের বিগ্রহদের স্নান করানো হয়। উল্লেখ্য, এই নবগ্রহের মধ্যে রাহু, কেতু এবং চাঁদের বিগ্রহ থাকলেও নেপচুন কিংবা প্লুটোর কোনও বিগ্রহ এখানে নেই।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

ভোটস্য পরিবেদনা

উগ্রতারা মন্দির সংলগ্ন পুকুর হচ্ছে জোড় পুকুরি। খাল কেটে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে এই পুকুরকে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেই খালের নাম নৌযান। উগ্রতারা একটি প্রাচীন মন্দির। আহোম রাজা স্বর্গদেও শিব সিংহ এই উগ্রতারা মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। এই মন্দিরটি একটি পীঠস্থানও বটে। বলা হয় এখানে সতীর নাভি পড়েছিল। উল্লেখ্য, এই মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। এখানে ঘটেই পুজো করা হয়। রাজা শিব সিংহের রাজত্বকালে এই পুকুরের জল মন্দিরের কাজে ব্যবহৃত হত। রাজা স্বর্গেও এই খাল দিয়েই নৌকা করে মন্দিরে আসতেন। তবে ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরটির অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। পর্বরতী সময়ে মন্দিরটি আবার বানানো হয়। ব্রিটিশ আমলে এই পুকুরকে দু’ ভাগে ভাগ করে তার মধ্যদিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়। সেই সময় থেকে জোড়পুকুরি নামেই দুই পুকুর পরিচত। উগ্রতারা মন্দিরটি গুয়াহাটির উজান বাজার অঞ্চলে অবস্থিত।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে পানবাজার অঞ্চলে সুক্রেশ্বর শিবের মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের সিঁড়িগুলি সোজা ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে নেমে গিয়েছে। ১৭৪৪ সালে আহোম রাজা প্রমত্ত সিংহ এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। বলা হয়, মন্দির উদ্ঘাটনের দিন একটি বৃহদাকার সাপ কাটা পড়ে যায়। সেই সাপের সেখানেই শেষ কৃত হয়। মন্দির সংলগ্ন পুকুরের পাশে সাপের পুজো হয়। পুকুর নাগকটা পুকুরি নামে পরিচিত। এই পুকুরটি নাকি সুক্রেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে।

শকুন্তলা পুকুরি আরও গুয়াহাটির একটি উল্লেখ যোগ্য পুরনো পুকুর। এই শকুন্তলা পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি। কানোয়া মুনির আশ্রম ছিল নবগ্রহ পাহাড়ের পূর্ব দিকটায়। নবগ্রহ পাহাড়ের অংশ হওয়া সত্ত্বেও কানোয়া পাহাড় নামেই এই পাহাড়টি পরিচিত। বলা হয়, কোনোয় মুনীর কন্যা শকুন্তলাকে তাঁর স্বামী দুশমন্ত অস্বীকার করলে তিনি এই পাহাড়েই থাকতেন। এই পাহাড়ে একটি পুকুর রয়েছে যার নাম শকুন্তলা পুকুরি। কিন্তু এর সঙ্গে শকুন্তলার কিংবা মুনীর কোনও যোগসূত্র আছে বলে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

এই মন্দিরের পাশে রয়েছে নর্থ ব্রুক গেট। ইংরেজ আধিপত্যবাদের এক অন্যতম নিদর্শন। ১৮২৪ সালে বার্মিজদের হাত থেকে গুয়াহাটির রাজদণ্ড চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড নর্থব্রুকের আগমন হয় গুয়াহাটিতে। ১৮৫৩ সালে গুয়াহাটিকে পৌরসভার অধীনে আনা হয়। স্থাপিত হয় ইটভাট্টা। ধীরে ধীরে মাটির তৈরি পুরনো ঘর বাড়ির বদলে শুরু হয় ইটের বাড়িঘর। কয়েক বছরের মধ্যে গুয়াহাটি শহরের রাস্তা, পানীয় জলের ব্যবস্থা এবং রাতের রাস্তায় কেরোসিনের বাতি জ্বলল।

নর্থ ব্রুক গেট।

এরপর এলেন ভাইসরয়। মূলত তাঁর সম্মানার্থে বিশাল সিংহদ্বার নর্থ ব্রুক গেট নির্মাণ করা হয়। থমাস জর্জ বেরিং কে’ই লর্ড নর্থব্রুক নামে জানা যায়। লর্ড ব্রুক কলকাতা থেকে নদী পথে এসে সুক্রেশ্বর ঘাটের এই গেটেই নেমেছিলেন। ১৯০০ সালে লর্ড কার্জনও গুয়াহাটি প্রবেশ করেছিলেন এই নর্থ ব্রুক গেট দিয়েই। ১৯৩৫ সালে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা জয়মতি নামে প্রথম অসমীয়া ভাষায় অসমের প্রথম সিনেমা তৈরি করলেন।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও গুয়াহাটির সাধারণ মানুষের যোগদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র দেশের সঙ্গে গোটা অসম তথা গুয়াহাটির লোকজনও স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরেরও রূপ পাল্টেছে। ফ্লাইওভার, শপিং মল, বড় বড় আবাসন ঘেরা গুয়াহাটির এক দিকে যেমন রয়েছে প্রাচীন পুরাণ কেন্দ্রিক মন্দির কিংবা বিভিন্ন সময়ের রাজা মহারাজাদের চিহ্ন, তেমনি এই টু মিনিট নুডলসের যুগের সঙ্গেও তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছেই গুয়াহাটি শহর।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content