মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

তমসাতীরে রামচন্দ্রের বনবাসজীবনের সূচনা। ঘনায়মান রাতের অন্ধকার। রমণীয় তমসা নদী তীরেই হবে রাত্রিযাপন। রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে আশ্বস্ত করেলেন, হে সৌমিত্রি লক্ষ্মণ, উৎকণ্ঠার কোনও কারণ নেই। তোমার কল্যাণ হোক। আজই আমাদের বনবাসের প্রথম নিশিযাপন। ইয়মদ্য নিশা পূর্ব্বা সৌমিত্রে প্রহিতা বনম্। বনবাসস্য ভদ্রং তে ন চোৎকণ্ঠিতুমর্হসি।। প্রাণীবৃন্দ, দ্বিজগণ ফিরেছেন নিজস্ব আবাসে। চারিদিকে অরণ্যভূমি যেন শূন্যতায়, দুঃখে ক্রন্দনমুখর। আজ নিঃসন্দেহে, পিতা দশরথের রাজ্যের রাজধানী অযোধ্যানগরীতে, নারীপুরুষ সকলেই রাম, লক্ষ্মণ ও সীতার বনবাসের কারণে শোককাতর হয়েছেন। প্রজারা যেমন বহুগুণশালী রাজা দশরথের তেমনই রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্নের সমান অনুগত। রামের কষ্ট হচ্ছে পিতা ও যশস্বিনী মায়ের জন্যে। অনবরত পুত্রের কারণে রোদনের ফলে দু’জনে তাঁরা দৃষ্টিশক্তি হারাবেন না তো? ধার্মিক ভরত নিশ্চয়ই ধর্মার্থকামসঙ্গত বচনের দ্বারা পিতামাতাকে আশ্বস্ত করবেন। ভরতের আন্তরিক মমত্ববিষয়ে চিন্তা করে, রাম, পিতামাতার বিষয়ে বিষাদমুক্ত হলেন। তাঁর উপলব্ধি হল, লক্ষ্মণের অনুগমন সার্থক। কারণ বৈদেহীর রক্ষার জন্যে লক্ষ্মণের সাহায্য প্রয়োজন।

চারিদিকে বনজ বিচিত্র আহার্যের অভাব নেই। তবু, স্থির হল রামচন্দ্র শুধু জল পান করেই রাতটুকু অতিবাহিত করবেন। সূর্যাস্ত নিকটবর্তী হলে, রামের নির্দেশে, সারথি সুমন্ত্র, ঘোড়াগুলিব জন্য পর্যাপ্ত ঘাসের ব্যবস্থা করে তাদের বেঁধে রাখলেন। রাত্রি ঘনিয়ে এসেছে। তমসা নদী তীরে রামের শয্যা প্রস্তুত হল। সেই পর্ণশয্যার আশ্রয়ে রাম ও সীতা নিদ্রাভিভূত হলেন। রাম গভীর ঘুমে মগ্ন। লক্ষ্মণ, সুমন্ত্রর সান্নিধ্যে জ্যেষ্ঠর গুণকীর্তনে মুখর হলেন। রামের গুণমহিমাকীর্তন করে, জেগে রইলেন দু’জনেই। অতিবাহিত হল সমস্ত রাত। গোকুলে সমাকীর্ণ তমসাতীর। অদূরে নিদ্রাচ্ছন্ন প্রজাদের সঙ্গে নিশিযাপন করলেন রাম। ঘুম ভাঙ্গল তেজস্বী রামের। বৃক্ষমূলে নিদ্রামগ্ন প্রজাদের দেখে লক্ষ্মণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন রাম। এই সব পুরবাসী সকলে, বাড়িঘর ছেড়ে এই বৃক্ষতলে শয্যা নিয়েছেন। তাঁরা প্রাণত্যাগ করবেন, কিন্তু তাঁদের সঙ্কল্প নয়। আমাদের না নিয়ে তাঁরা ফিরবেন না। যথৈতে নিয়মং পৌরাঃ কুর্বন্ত্যস্মন্নিবর্ত্তনে। অপি প্রাণান্ন শিষ্যন্তি ন তু ত্যক্ষ্যন্তি নিশ্চয়ম্।। যতক্ষণ তাঁরা ঘুমিয়ে আছেন, ততক্ষণে রথে আরোহণ করে অনেকটা পথ নির্ভয়ে অতিক্রম করা যাবে। পুরজনদের স্বকৃত কষ্ট নিবারণ করা, রাজপুত্রের কর্তব্য। আর যেন ইক্ষ্বাকুপুরবাসীদের, রামের কারণে, বৃক্ষতলে শয্যাগ্রহণ করতে না হয়। লক্ষ্মণ ধার্মিক রামের প্রস্তাবে সহমত হলেন। ক্ষিপ্রমারুহ্যতামিতি সত্বর রথে আরোহণ করা যাক। সুত সুমন্ত্রকে নির্দেশ দিলেন, শীঘ্রং সযুজ্যতাং রথঃ। সত্বর রথ যোজনা করুন। গমিষ্যামি ততোঽরণ্যং গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো। এখনই অরণ্য অভিমুখে যাব, দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করুন। শ্রেষ্ঠ অশ্বযুক্ত রথে আরূঢ় রাম, আবশ্যক পরিচ্ছদ এবং লক্ষ্মণ ও সীতাসহ দ্রুত আবর্তসঙ্কুল তমসা নদী উত্তীর্ণ হলেন। শ্রীমান, শৌর্যবান, রাম নদীর পরপারে কণ্টকহীন, ভীরুদেরও নির্ভয়ে চলাচলযোগ্য মঙ্গলময় পথের সন্ধান পেলেন। পুরবাসীদের বিভ্রান্ত করতে রাম, সারথিকে আদেশ দিলেন, উদঙ্মুখঃ প্রয়াহি ত্বং রথমারুহ্য সারথে। সারথি, আপনি উত্তর দিকে রথ নিয়ে যান। মুহূর্ত্তং ত্বরিতং গত্বা নিবর্ত্তয় রথং পুনঃ। যথা ন বিদ্যুঃ পৌরা মাং তথা কুরু সমাহিতঃ।।
এক মুহূর্ত সেখানে থেকে, আবার রথ ফিরিয়ে আনুন। পুরজনেরা আমার গতিপথের টেরটি পর্যন্ত না পান, তেমনটাই করুন। সারথি এই আদেশানুসারে কাজ করে রামের কাছে ফিরে এলেন। রঘুকুলবর্দ্ধক রাম ও লক্ষ্মণ সীতাসহ সেই রথে আরোহণ করলেন। সুমন্ত্র, অরণ্যের উদ্দেশ্যে রথাশ্ব চালনা করলেন। প্রথমে আনুষ্ঠানিক মঙ্গলাচরণের নিমিত্ত রথের গতি হল উত্তরাভিমুখে। পরে অরণ্যের উদ্দেশ্যে ধাবমান হল মহারথ দশরথনন্দনের রথ।

ভোর হল। কোথায় রাম? রামের অদর্শনে শোকে অভিভূত পৌরজনেরা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। আর কী কোন আশা আছে? কর্মতৎপরতাহীন বিবশ হলেন তাঁরা। শোকবিহ্বল অবস্থায় নয়নাশ্রুজলে ভেসে ইতস্তত তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন। কোথায় রাঘব রাম। তাঁর রথের চিহ্ন নেই কোথাও। সেই বিজ্ঞ পুরবাসীরা পরস্পরের প্রতি সমবেদনায় সান্ত্বনা দিতে লাগলেন নিজেদের। ধিক্কার দিলেন চেতনাহরণকারী নিদ্রাকে। হাহুতাশ করলেন, কেন মিথ্যাচার করে অনুগত ভক্তদের ছেড়ে বনবাসে গেলেন রাম? সেই প্রশস্তবক্ষ, মহাবাহু রামকে এখন আর দেখতে পাচ্ছিনা। নাদ্য পশ্যামহে রামং পৃথুরস্কং মহাভুজম্। পিতার মতো যিনি ঔরসজাত সন্তানপ্রতিম আমাদের আগলে রাখতেন, সেই রঘুকুলশ্রেষ্ঠ রাম কেন আমাদের শূন্য করে বনে গেলেন? যো নঃ সদা পালয়তি পিতা পুত্রানিবৌরসান্। কথং রঘূনাং স শ্রেষ্ঠস্ত্যক্ত্বা নো বিপিনং গতঃ।। পৌরদের মনস্তাপের শেষ নেই। রামবিনা এ জীবনের কী প্রয়োজন? তাই মরণই ভালো। এখানেই মৃত্যুবরণ, তা না হলে মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে মহাপ্রস্থানে যাওয়াই শ্রেয়।পড়ে থাকা বড় বড় শুকনো কাঠ যত আছে,তাতে সকলে মিলে অগ্নিসংযোগ করে, সেই চিতায় প্রবেশ করা যাক। কীভাবে ফিরে গিয়ে জবাবদিহি করবেন তাঁরা? সেই দ্বেষহীন, প্রিয়ভাষী, রামকে বনে নিয়ে গেলাম আমরাই। একথা বলব কী করে? কিং বক্ষ্যামো মহাবাহুরনসূয়ঃ প্রিয়ংবদঃ। নীতঃ স রাঘবোঽস্মাভিরিতি বক্তুং কথং ক্ষমম্।। তাঁদেরকে, রাঘবহীন, দীনহীন দেখে স্ত্রী, বালক, বৃদ্ধ সকলের মনের আনন্দ চলে যাবে যে। পুরবাসীরা, শৌর্যবান মহান রামের নিত্যনিয়ত যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন, তাঁকে ছাড়া সেই নগরীতে দেখা দেবেন কীভাবে? ঊর্দ্ধবাহু হয়ে, মৃতবৎসা গাভীর মতো শোকার্ত পুরবাসীরা নানাভাবে বিলাপ করতে লাগলেন। রামের যাত্রাপথে রথচিহ্ন অনুসরণ করে কিছুদূর গেলেন তাঁরা। শেষে আর চিহ্ন খুঁজে পেলেন না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

এ বার কী করবেন? এ যে দৈববিড়ম্বনা। তাঁরা যে পথে গিয়েছিলেন, সে পথেই, শ্রান্ত হয়ে, ব্যথিতহৃদয় সজ্জনের আবাস অযোধ্যা নগরীতে, ফিরে চললেন। অযোধ্যা নগরী দেখে চিন্তাব্যাকুলচিত্তে শোকোভিভূত নাগরিকেরা চোখের জল ফেলতে লাগলেন। কী অবস্থা অযোধ্যার? রামবিহীন অযোধ্যা, শ্রীহীন হয়ে শোভা হারিয়েছে। নগরীর অবস্থা ঠিক গরুড়ের দ্বারা সর্পশূন্য হ্রদের মতোই সৌন্দর্যহীন। তাঁরা দেখলেন, চাঁদহীন আকাশসম নিষ্প্রভ এবং জলশূন্য সমুদ্রতুল্য নিস্তরঙ্গ যেন সেই নগরী। তাঁরা বিরসমনে সেই নিরানন্দ নগরী দেখতে থাকলেন।বিষণ্ণমনে তাঁরা নিজ নিজ গৃহে প্রবেশ করলেন। সেখানে অপেক্ষমান আত্মীয়স্বজন এবং অনাত্মীয়দের দেখেও নিরানন্দ পৌরগণ যেন তাঁদের চিনতেই পারলেন না।

সেখানে ফিরে এসেও পুরবাসীবৃন্দ, শোকার্ত, বিষাদাচ্ছন্ন। যেন পীড়ায় আক্রান্ত, এমন দশায় উপনীত হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের চোখ অশ্রুসজল, দেহে প্রাণ নেই যেন, এমন অবস্থায় গৃহে প্রবেশ করলেন। নিজের আবাসে স্ত্রীপুত্রস্বজনদের সান্নিধ্যে শোক প্রগাঢ় হল আরও। অবিরাম অশ্রুধারায় মুখমণ্ডল প্লাবিত হল। মনে আনন্দ নেই,নেই কোন আমোদের সূচনা। বণিকেরা তাঁদের পণ্যসম্ভার প্রদর্শনে আগ্রহী নন আর। গৃহস্থদের পাঠের অভ্যাসে অনীহা দেখা দিল। নষ্ট অর্থের পরিবর্তে বিপুল ধনাগমেও কোন খুশির বার্তা নেই।প্রথম সন্তানলাভেও মায়ের মনে আনন্দ নেই। মাহুতের অঙ্কুশ দিয়ে হাতী তাড়নার মতো দুঃখিনী গৃহিণীরা তিরস্কারে বিদ্ধ করলেন স্বামীদের। গৃহ, দান, ধন, পুত্র বা সুখের কী প্রয়োজন তাঁদের? যাঁরা রামের দেখা পাননি? কিং নু তেষাং গৃহৈঃ কার্য্যং কিং দানৈঃ কিং ধনেন বা। পুত্রৈর্বা কিং সুখৈর্বাপি যে ন পশ্যন্তি রাঘবম্।।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

ভোটস্য পরিবেদনা

এই পৃথিবীতে লক্ষ্মণ একমাত্র সজ্জন,যিনি রাম ও সীতার পরিচর্যার কারণে তাঁদের বনেও অনুগমন করেছেন। যাত্রাপথে যে নদী, পদ্মদিঘি, সরোবরের পবিত্র জলে রাম অবগাহন স্নান করবেন সেগুলি অর্জিত পুণ্যের অধিকারী হবে। রামের অরণ্যপথে শোভা হবে মনোরম কাননভূমি, উন্নতশিখরবিশিষ্ট পর্বত, জলে ভরা মধ্যবাহিনী নদীগুলি। রাম যেখানেই যাবেন কানন, শৈলশ্রেণি তাঁকে প্রিয় অতিথির সম্মান না দিয়ে পারবে না। মহীরুহগুলি তাঁকে দেখাবে —তাদের মাথায় বিচিত্র ফুলের অলঙ্কার, অনেক ভ্রমরসঙ্কুল কুসুমমঞ্জরী, সেগুলি কেমন ধারণ করে আছে তারা। পর্বতগুলি সমাগত রামের দর্শনে প্রসন্নতায় অনুকম্পাভরে অকালে সর্বোত্তম ফুল ফোটাবে,উৎকৃষ্ট ফলদান করবে।পার্বত্য ঝর্ণাগুলি রামকে উপহার দেবে নির্মল জলধারা। পার্বত্য পাদপেরা রামকে আনন্দ দান করবে।

মহাবাহু, শৌর্যবান, মহান, দশরথতনয়, রাম যেখানে থাকবেন সেখানে নেই কোনও ভয়, নেই পরাভবের আশঙ্কা। তিনি বহূদূরবর্তী নন এখনও, আমরা বরং তাঁকে অনুসরণ করি। যত্র রামো ভয়ং নাত্র নাস্তি তত্র পরাভবঃ।। স হি শূরো মহাবাহুঃ পুত্রো দশরথস্য চ। পুরা ভবতি নো দূরাদনুগচ্ছাম রাঘবম্।। তাঁর মতো মহাত্মার পদচ্ছায়া অনুসরণও সুখাবহ। তিনিই সকলের নাথ, সকলের গতি, সকলের রক্ষক তিনিই। শোকার্ত পুরস্ত্রীদের সকলের এক কথা, অরণ্যবাসে দেবী সীতার পরিচর্যা করবেন তাঁরা, পুরুষেরা করবেন রামের পরিচর্যা। স্বামীদের প্রতি তাঁদের উপদেশ — বনে, রাম পুরুষদের যোগ (অলব্ধবস্তর লাভ) এবং ক্ষেম (লব্ধবস্তুর রক্ষণ) সাধন করবেন। নারীদের যোগ ও ক্ষেম প্রদান করবেন দেবী সীতা। এখানে সকলের মনে অসন্তোষ, উদ্বেগ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে অসুখী মানুষের ভিড় শুধু, কে বাস করতে চায় এখানে? যদি রাজ্য, কৈকেয়ীর করায়ত্ত হয় তবে অধর্ম প্রভুত্ব করবে সেখানে, সেই রাজ্যে আমাদের জীবনের প্রয়োজন কী? ধন, পুত্র সবই নিরর্থক। কুলকলঙ্কিনী কৈকেয়ী অর্থের কারণে স্বামীপুত্রকে ত্যাগ করেছেন। সেই কারণে আর কী না ত্যাগ করতে পারেন তিনি? মহিলারা সন্তানের নামে প্রতিজ্ঞা করলেন,প্রাণ থাকতে তাঁরা কখনও কৈকেয়ীর আজ্ঞাধীনা হয়ে থাকবেন না। যে নিষ্ঠুর নারী রাজশ্রেষ্ঠকে বনে নির্বাসিত করলেন, সেই অধার্মিকা, দুষ্টাচরণকারিণীর রাজ্যে কে সুখে থাকবে? এই উপদ্রববহুল, যাগযজ্ঞবিহীন, অনাথবৎ কৈকেয়ীর রাজ্যে সব কিছুই ধ্বংস হবে। রাম বনবাসী হলে রাজা দশরথ বাঁচবেন না। রাজার প্রয়াণে সবকিছু বিলুপ্ত হবে। সুতরাং পুণ্যক্ষয়হেতু হতভাগ্য পুরবাসীদের বিষপান করাই শ্রেয় অথবা রামের অনুগমন বা এমন স্থানে আশ্রয়লাভ যেখানে কৈকেয়ীর নাম পর্যন্ত শোনা যাবে না। অকারণে নির্বাসিত হয়েছেন সস্ত্রীক রাম ও লক্ষ্মণ। ভরতের অধীনে তাঁদের স্থান এখন নিষাদের হাতে বদ্ধ পশুর মতো। যাঁর বদন পূর্ণ চন্দ্রসম, যিনি শ্যামবরণ, কণ্ঠার হাড় যাঁর গুপ্ত, যিনি শত্রুবিজয়ী, আজানুলম্বিত বাহুবিশিষ্ট যিনি, পদ্মপলাশ আঁখি যাঁর, যিনি প্রথম থেকেই প্রিয়ভাষী, যিনি সত্যবাদী ও মহাবলশালী, সৌম্যকান্তি, সকলের কাছেই চন্দ্রতুল্য অনিন্দ্যদর্শন, প্রমত্ত গজের তুল্য যে রামের অনুগমনরত লক্ষ্মণ, সেই রামচন্দ্র নিশ্চয়ই বনে পরিভ্রমণকালীন অরণ্যের শোভা হয়ে উঠবেন।
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

যেন আসন্ন মৃত্যুভয় উপস্থিত হয়েছে, এমনভাবেই কেঁদে উঠলেন দুঃখদীর্ণ পুরনারীরা। ঘরে ঘরে রামের উদ্দেশ্যে বিলাপরতা মহিলারা, এ ভাবেই সূর্যাস্তের পরে রাত্রি হল। অগ্নিতাপ দূর হল। অধ্যয়ন ও সৎকথা শেষ হলে, অযোধ্যা নগরী অন্ধকারে ঢেকে গেল। বণিকদের পণ্য ক্রয়বিক্রয় বন্ধ হল। আমোদ প্রমোদের অবসান হলে নিরাশ্রয় হল মানুষজন। নক্ষত্রবিহীন আকাশের মতো প্রতীয়মান হল অযোধ্যা নগরী। নিজের পুত্র বা ভাই নির্বাসিত হলে যেমন নারীরা কাতর হয়ে পড়েন সেইরকম ছিল পুরনারীদের প্রতিক্রিয়া। আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তাঁরা।কারণ রাম ছিলেন পুরনারীদের কাছে শুধুমাত্র সন্তানতুল্য নয়, তার থেকেও অধিকতর স্নেহের পাত্র। নিরানন্দ অযোধ্যা নগরীতে নৃত্য, গীত বন্ধ হল, রুদ্ধদ্বার হল বিপণিগুলি। অযোধ্যা নগরী যেন শুষ্ক জলহীন মহাসাগরতুল্য প্রতিভাত হল। তথা অযোধ্যা নগরী বভূব সা। মহার্ণবঃ সংক্ষেপিতোদকো যথা।।

রামের বনবাস, যেন আনন্দের নির্বাসন। সাধারণ মানুষ, মনের আনন্দ খোঁজে অসাধারণের মধ্যে। সেখানেই তাঁরা আত্মতৃপ্তি, আনন্দ, সার্থকতার আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। রাম অভিরাম। আনন্দের প্রতিমূর্তি। প্রজাদের আনন্দানুভব রামকে কেন্দ্রে রেখেই আবর্তিত হয়। রাম যেন আনন্দোচ্ছ্বাসের উৎসবিন্দু। জীবনে সংঘাত আছে, আছে দ্বন্দ্ব, সংক্ষোভ, আলোড়ন, দুঃখ, কষ্টের অভিঘাত। প্রিয়জনের মধ্যে অপূর্ণ আশার চরিতার্থতা খুঁজে না পেলে মানুষ তাঁর প্রত্যাশা পূরণ করেন কোন রোলমডেলের মধ্যে।

ছবি: প্রতীকী।

রাম প্রজাদের প্রত্যাশা পূরণে সফল হয়েছেন কারণ তিনি যে আশার পূর্ণতাজনিত আনন্দানুভবের মূর্ত প্রতীক। সাধারণের মনে আনন্দঘন উচ্ছ্বাসের প্লাবন এনেছেন তিনি। দৈনন্দিন যাপনে আছে প্রত্যহিকতার একঘেয়ে সুর, ক্লান্তিকর দিনযাপন যা মাঝে মাঝেই বেসুরে বেজে ওঠে। মনে ঘনায় আশঙ্কার কালো মেঘ, অমূলক ভীতি, ভিত্তিহীন রাগ দুঃখবোধ। আমরা যা উগরে দিই পারস্পরিক অযাচিত দ্বন্দ্বে। হয়তো সেগুলি সর্বদা অভিপ্রেত নয়। এর মধ্যেই থাকে আনন্দানুভব যা আমাদের বেঁচে থাকার রসদ। অযোধ্যার পুরবাসীরা নিজেদের অনুভবে চেয়েছিলেন সেই আনন্দকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আত্মস্থ করতে যা প্রাকৃতসত্তার কাছে অসম্ভবপ্রায়। সাময়িক বিরতিও তাঁদের অসহনীয় মনে হয়েছে। কিন্তু “দুঃখ বিনা সুখলাভ হয় কী মহীতে।” তাঁরা কাল্পনিক নির্বাসিত আনন্দের সান্নিধ্যে উৎফুল্লা প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন। কল্পনায় চির অম্লান সুখানুভবে আপ্লুত হয়েছেন। আনন্দরূপের সান্নিধ্যে ভয় নেই, নেই ত্রাস, নেই জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কা। পরমাশ্রয় সেই আনন্দকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে ইচ্ছুক অযোধ্যার পুরবাসীবৃন্দ।

আর রাম? যিনি সকলের প্রাণের আশ্বাস, সঞ্জীবনী শক্তি নিহিত রয়েছে যাঁর আনন্দরূপে, আচরণে, সেই পুরবাসীদের হৃদয়হরণ, রামচন্দ্র কী পুরবাসীদের আবেগের মূল্য দিয়েছেন? তিনি বিশ্বস্ত, অনুগত পৌরদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে প্রস্থান করেছেন নিজ গন্তব্যে। শুধু তাই নয় তাঁদেরকে ভুল পথে চালিত করছেন, যাতে তাঁরা তাঁকে অনুসরণ করতে না পারে। অযোধ্যার ভাবি রাজার পাষাণকঠিন মনে হৃদয়াবেগের কোন স্থান নেই।তিনি পিতার কাছে দায়বদ্ধ, প্রজাদের কাছে নয়। যদিও সত্যপরায়ণতা, ধার্মিক প্রশাসকের চরিত্রমাধুর্যের একটি শক্তিশালী দিক। রামচন্দ্র, সার্থক রাজা হওয়ার লক্ষ্যে প্রস্তুত করছেন নিজেকে। চোদ্দো বছর নিমেষে কেটে যাবে,রামের রূপমুগ্ধ, গুণগ্রাহী অপেক্ষমান প্রজাদের দায়িত্বগ্রহণের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছে, সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। এখন শুধু এগিয়ে চলা। প্রজাদের মনের আনন্দ ফিরিয়ে দিতেই হয়তো রামের এই দৃঢ় মনোবল। মহাকাব্যের নায়ক রামের রাজোচিত অনমনীয় মনোবল কী এখনও প্রভাবিত করে দেশের প্রশাসনকে?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content